২৭ ডিসেম্বর কবির ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে-দুটি কবিতা by সৈয়দ শামসুল হক


জেব্রা!
বাংলার প্রান্তরে হঠাৎ আফ্রিকার সাভানার রোদ ঝলসে ওঠে।
তুমিই কি? থেকে থেকে লাফিয়ে উঠতে চাও কোলে।
আমি স্তম্ভিত। এই তুমি! বন্য ও উদ্দাম! এবং উৎকর্ণ।
চাবুকের শব্দ সপাং সপ। বাতাস হচ্ছে রক্তাক্ত।


তোমার ভীতিগুলোই কালো কালো ডোরা—
তোমার মখমল শুভ্রতায় সেই কালো ডোরা—
পোষ-না-মানা তোমার সত্তাকে যারা
চাবুকের তাড়নায় ছিন্ন করে,
তাদেরই তো দাগ তোমার কালোসাদা শাড়িতে।
এবং লাল ফোঁটা মাঝে মাঝে!
তোমার তো রক্তাক্ত হবার কথা নয়।
বরং তুমিই সেই উজ্জ্বল লোহিতের দিকে চোখ পেতে আছো
যা নববধূর অঙ্গে ভোরের নদীটির স্রোতের মতো
প্রবাহিত হয় শাড়ি থেকে!
তুমি এখন শব্দিত হয়ে উঠছ।
তুমি বারবার লাফিয়ে উঠতে চাইছো আমার নিঃসঙ্গ কোলে।
ও আমি তোমার সবুজ প্রান্তর! তোমার অবাধ বিচরণভূমি!
রোদ গলে পড়া জলাশয় যে আমি তোমারই।
আমি তোমার ঘুমিয়ে পড়বার ছায়া-বিতান।
তোমার খুরের দাপট!
তোমার জন্মসহচর স্বাধীনতা।
জেব্রা! অরণ্য থেকে প্রান্তরে!
প্রান্তর থেকে সত্তার এখনো সবুজ চত্বরে।
এবং সেই চত্বরেও তুমি শমিত বা শান্ত নও,
আমার মানব-শরীরে
তুমি জেব্রা উপগত! তুমি ও আমি!
আমাদের ভেতরে জেব্রার দুরন্ত বন্যা—জেব্রাপালের বিশুদ্ধতা
এবং গতিবেগ—মহাদেশ ভেঙে এই বদ্বীপেই তো—
এই গতিবেগেই তো লাফিয়ে ওঠে অক্ষর আমার কলমে
এবং লিখিত হয়ে চলে আমাদের ভালোবাসার বিদ্যুতলেখা।।

দরজা
তাহলে দরজারই সমুখে! সেই দরজা! তোমার দরজা!
একদিন যে-দরজা ছিল গরমের খরতাপে বন্ধ ও রঙচটা!
কত সড়কেই না আমি সন্ধান করেছি এমন একটি দরজা
যার পাল্লার কাঠে এসে পড়বে শ্রাবণ-বৃষ্টির সন্তাপহর ধারা।
কিন্তু বিবর্ণ এই সময়, আর আমিও দেখো কী রকম বটে—
তিমির পেটের ভেতরে প্রত্যাদিষ্ট একজন আছি অপেক্ষায়,
কখন বেরুব! তাঁর অপেক্ষারই চাপ আমার সব উচ্চারণে।
একটি বেদনাবৃক্ষ লেবু ফলিয়ে চলেছে জ্যোৎস্নার ভেতরে,
আর সেই জ্যোৎস্না তো আসলে ছিল তোমার ভালোবাসা।
তোমাকে ভালোবেসেই তো আমি দূরপাল্লার যাত্রী, আমি
লেবুগন্ধে মাতাল, আমি প্রতি স্বজনেরই তো দৈনন্দিন পাতে।
সন্ধান আমার শেষ হয় না। দাঁড়াও!—আমি নিজেকে বলছি!
আর এটাও বলে চলেছি, সড়ক তোমাকে একদিন তো ঠিক
ফেরাবেই তোমার প্রার্থিত দরজায়, না হয় এখন খরায়!
নিপুণ তীর, তীক্ষ তীর, রক্তমুখী ভোর, নির্জন সব সড়ক।
এই সব দেখে দেখে নিজের ভেতরেই এক বিচলন আমি
নীলগাইয়ের মতো অনুভব করে চলেছি সেই কতকাল থেকে!
কাল? তার বর্ণটাই বা কেমন? সে কি ঘোর কৃষ্ণলেপিত?
পাটল যেন জমাট রক্ত? নাকি মাঠ ভেসে যাওয়া সর্ষে ফুল?
এই আয়না! ওই দৃশ্যপট! এই সড়ক! আর, ওই দরজা!
নীলগাইয়ের খুরে খুরে উৎপাটিত নক্ষত্র থেকে অগ্নিকণা
এখন আমার সর্বাঙ্গে। কালের আয়নায় আমার চিত্রিত শরীর।
উৎসুক দুটি চোখ, ত্বরিত আমার চলা, পায়ের নিচে পাথর—
আমি তো পৌঁছে যাবারই স্বপ্ন দেখেছি চিরকাল—দরজায়—
তোমারই দরজায়—এখন বৃষ্টিভেজা, শ্রাবণের তুলিতে তার
পাল্লার কাঠে সজল পুষ্পের ছবি ফুটছে একটির পর একটি—
এখনই তো! বৃষ্টিমাথায় দাঁড়িয়ে আছি—খোলো! খুলবে না?

No comments

Powered by Blogger.