শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি এবং কিছু কথা by আবুল কাসেম হায়দার
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করাটা যেন সোনার টুকরায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিগত দুই বছরে প্রায় আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা পড়ে রয়েছে এমপিওভুক্তির জন্য। মহাজোট প্রথম বছর ক্ষমতায় আসার পর দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র এক হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে। এর পর দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, আর এমপিওভুক্ত করা হলো না। মহাজোট সরকার তিন বছরে পদার্পণ করেছে।
দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এখনো জানেন না কখন তাঁদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে।
দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ আট হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে আর্থিক দৈন্যের ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিষয়টিকে সরকার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। সরকার অপ্রয়োজনীয় বহু খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, অথচ শিক্ষা খাতের এই অবহেলা পুরো জাতির সঙ্গে_এটি খুব একটা ভালো আচরণ নয় বলে সবাই মনে করে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা ও শিক্ষকদের টাইম স্কেল প্রদানে অর্থ বরাদ্দ কম থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সংসদীয় কমিটি এ খাতে জরুরি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রতি যোগ দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিজন এমপির সুপারিশের ভিত্তিতে তিনটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওই এলাকায় এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনার কথা এর আগে বিভিন্ন সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন। আর এ জন্য প্রয়োজন ২২০ কোটি টাকার। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় মাত্র ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। তাই কাজটি বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। শিক্ষকদের টাইম স্কেল দিতে হলে প্রয়োজন ৩২৭ কোটি টাকা। অথচ মন্ত্রণালয় এ খাতে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি। কিছুদিন আগে খুব সুন্দর শিক্ষানীতি সরকার পাস করে বাস্তবায়নের কথা বলেছে। অর্থ ছাড়া কিভাবে শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হবে?
কয়েক দিন আগে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক গাড়ি চলাচলের জন্য একবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বাস মালিকরা ধর্মঘট করেন। প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত ৯৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে রাস্তাকে বাস চলাচলের উপযোগী করেন। বাস ধর্মঘট না হলে এবং মিডিয়া রাস্তাঘাটের এই দুরবস্থার কথা তুলে না ধরলে হয়তো রাস্তা মেরামতও হতো না। তেমনি বেসরকারি শিক্ষকরাও কোনোভাবে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি না দিলে, ধর্মঘট না করলে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর খুব সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থও দেবে না, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিভুক্তও হবে না। দেশের অবস্থা আমার কাছে তা-ই মনে হয়। কারণ শিক্ষামন্ত্রী বারবার বলেও অর্থ পাচ্ছেন না।
অর্থ পাচ্ছেন না বলে দুই বছর পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও উন্নত বাংলাদেশ কি শিক্ষা ছাড়া করা যাবে? কখনো করা যাবে না। তাহলে কেন অর্থ মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেবে না?
এদিকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কমিটি জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। কিন্তু কোনো কিছুই যেন কাজে লাগছে না। সংসদীয় কমিটি জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষার সব দিক নিয়ে বেশ আলোচনা করছে। শিক্ষার কয়েকটি দিকে জোর দেওয়ার কথা বলেছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে সরকারের ধীরগতিতে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। শিক্ষা ভবন নির্মাণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ছাড়ের ধীরগতি সব কাজকর্ম স্থবির করে দিয়েছে। অবিলম্বে শিক্ষা খাতের ভবন নির্মাণসহ নানা প্রকল্পের অর্থ দ্রুত ছাড় দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো শুনতে আমাদের বেশ ভালো লাগছে। কমিটি আবার শিক্ষামন্ত্রীর ব্যর্থতা দূর করার জন্য নিজেরা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশে এখন কোনো কাজই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া দ্রুত করাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। অথবা প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে তা দ্রুত করার ব্যবস্থা করছেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে এক ব্যক্তির ওপর সব কিছুর নির্ভরতা তেমন ভালো লক্ষণ নয়।
দেশের সব শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যায়ে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান ও ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড আইনের খসড়া কেবিনেটে চূড়ান্ত করা এবং চলতি বছরে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষায় আরো দক্ষ জনবল তৈরির জন্য 'জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি' এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিদ্যালয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের টিফিন সার্ভিস চালু করার সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। খবরগুলো বেশ আনন্দের এবং চমৎকার। কিন্তু বাস্তবায়ন কিভাবে কবে হবে, তা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলতে পারবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য ২২০ কোটি টাকার বিপরীতে এখন পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র ১৫ কোটি টাকা। দুই বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা দিন গুনছেন কখন এমপিওভুক্ত হবেন। কিন্তু ২০১০ সাল চলে গেছে, ২০১১-ও চলে যাওয়ার পথে, আজও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২২০ কোটি টাকা দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী এমপিওভুক্তির ফাইল সব ঠিকঠাক করে আলমারির তালা বন্ধ করে রেখেছেন। তা-ই তো করবেন। টাকা না দিলে তিনিই বা কিভাবে এমপিভুক্ত করার ঘোষণা দেবেন। টাকাটা তো আসল সমস্যা। দেশের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অর্থের অভাবে দীনহীনভাবে জীবন কাটাচ্ছেন। এখনো বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি। সাত-আট বছর হয় পড়ে রয়েছে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা তো হাজার হাজার রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের তথা শিক্ষার স্বার্থে অবিলম্বে আবেদনকৃত সব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনের ভাষণে শান্তির নতুন উন্নয়ন মডেল উপস্থাপন করেছেন। এর ছয়টি প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে_
১. ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ
২. বৈষম্য দূরীকরণ
৩. বঞ্চনার লাঘব
৪. ঝরে পড়া মানুষকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা
৫. মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং
৬. সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন।
প্রধানমন্ত্রী এর নাম দিয়েছেন 'জনগণের ক্ষমতায়ন এবং শান্তিকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল'। প্রধানমন্ত্রীর শান্তির এই মডেল কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন দুনিয়াজুড়ে শিক্ষিত, সুশিক্ষিত, নৈতিকতাসম্পন্ন, মানবতাবাদী বিশাল জনগোষ্ঠীর। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন। সারা বিশ্বে অবশ্য শিক্ষার হার ও গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার গুণগত মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১ সালে শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশ। কিন্তু সরকার দাবি করে আসছে, শিক্ষার হার ৬০ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষিত করে দেওয়া হলো। তাই প্রধানমন্ত্রীর এই মডেল কার্যকর করতে হলে আগে নিজের দেশে তথা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে হবে; তারপর সারা বিশ্বের কথা আসবে।
দুই বছর ধরে যেখানে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার অভাবে সাত হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিভুক্ত করা যাচ্ছে না, তাহলে কিভাবে শান্তির মডেল সারা বিশ্বে কাজে লাগবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আগে নিজ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করে শিক্ষার দ্বার খুলে দিন। দলভিত্তিক এমপিও না করে মানভিত্তিক এমপিও করুন। দুই বছর আগে এক হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে দলগতভাবে। এবার আমরা সরকারকে জনগণের সরকার মনে করব। সরকার শুধু আওয়ামী লীগের নয়। তাই এমপিও করার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে একান্ত প্রাপ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিও করার বিষয় চূড়ান্ত করার পরামর্শ ও দাবি রাখব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই
দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ আট হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে আর্থিক দৈন্যের ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিষয়টিকে সরকার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। সরকার অপ্রয়োজনীয় বহু খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, অথচ শিক্ষা খাতের এই অবহেলা পুরো জাতির সঙ্গে_এটি খুব একটা ভালো আচরণ নয় বলে সবাই মনে করে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা ও শিক্ষকদের টাইম স্কেল প্রদানে অর্থ বরাদ্দ কম থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সংসদীয় কমিটি এ খাতে জরুরি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রতি যোগ দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিজন এমপির সুপারিশের ভিত্তিতে তিনটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওই এলাকায় এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনার কথা এর আগে বিভিন্ন সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন। আর এ জন্য প্রয়োজন ২২০ কোটি টাকার। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় মাত্র ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। তাই কাজটি বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। শিক্ষকদের টাইম স্কেল দিতে হলে প্রয়োজন ৩২৭ কোটি টাকা। অথচ মন্ত্রণালয় এ খাতে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি। কিছুদিন আগে খুব সুন্দর শিক্ষানীতি সরকার পাস করে বাস্তবায়নের কথা বলেছে। অর্থ ছাড়া কিভাবে শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হবে?
কয়েক দিন আগে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক গাড়ি চলাচলের জন্য একবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বাস মালিকরা ধর্মঘট করেন। প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত ৯৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে রাস্তাকে বাস চলাচলের উপযোগী করেন। বাস ধর্মঘট না হলে এবং মিডিয়া রাস্তাঘাটের এই দুরবস্থার কথা তুলে না ধরলে হয়তো রাস্তা মেরামতও হতো না। তেমনি বেসরকারি শিক্ষকরাও কোনোভাবে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি না দিলে, ধর্মঘট না করলে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর খুব সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থও দেবে না, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিভুক্তও হবে না। দেশের অবস্থা আমার কাছে তা-ই মনে হয়। কারণ শিক্ষামন্ত্রী বারবার বলেও অর্থ পাচ্ছেন না।
অর্থ পাচ্ছেন না বলে দুই বছর পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও উন্নত বাংলাদেশ কি শিক্ষা ছাড়া করা যাবে? কখনো করা যাবে না। তাহলে কেন অর্থ মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেবে না?
এদিকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কমিটি জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। কিন্তু কোনো কিছুই যেন কাজে লাগছে না। সংসদীয় কমিটি জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষার সব দিক নিয়ে বেশ আলোচনা করছে। শিক্ষার কয়েকটি দিকে জোর দেওয়ার কথা বলেছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে সরকারের ধীরগতিতে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। শিক্ষা ভবন নির্মাণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ছাড়ের ধীরগতি সব কাজকর্ম স্থবির করে দিয়েছে। অবিলম্বে শিক্ষা খাতের ভবন নির্মাণসহ নানা প্রকল্পের অর্থ দ্রুত ছাড় দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো শুনতে আমাদের বেশ ভালো লাগছে। কমিটি আবার শিক্ষামন্ত্রীর ব্যর্থতা দূর করার জন্য নিজেরা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশে এখন কোনো কাজই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া দ্রুত করাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। অথবা প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে তা দ্রুত করার ব্যবস্থা করছেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে এক ব্যক্তির ওপর সব কিছুর নির্ভরতা তেমন ভালো লক্ষণ নয়।
দেশের সব শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যায়ে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান ও ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড আইনের খসড়া কেবিনেটে চূড়ান্ত করা এবং চলতি বছরে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষায় আরো দক্ষ জনবল তৈরির জন্য 'জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি' এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিদ্যালয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের টিফিন সার্ভিস চালু করার সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। খবরগুলো বেশ আনন্দের এবং চমৎকার। কিন্তু বাস্তবায়ন কিভাবে কবে হবে, তা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলতে পারবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য ২২০ কোটি টাকার বিপরীতে এখন পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র ১৫ কোটি টাকা। দুই বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা দিন গুনছেন কখন এমপিওভুক্ত হবেন। কিন্তু ২০১০ সাল চলে গেছে, ২০১১-ও চলে যাওয়ার পথে, আজও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২২০ কোটি টাকা দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী এমপিওভুক্তির ফাইল সব ঠিকঠাক করে আলমারির তালা বন্ধ করে রেখেছেন। তা-ই তো করবেন। টাকা না দিলে তিনিই বা কিভাবে এমপিভুক্ত করার ঘোষণা দেবেন। টাকাটা তো আসল সমস্যা। দেশের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অর্থের অভাবে দীনহীনভাবে জীবন কাটাচ্ছেন। এখনো বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি। সাত-আট বছর হয় পড়ে রয়েছে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা তো হাজার হাজার রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের তথা শিক্ষার স্বার্থে অবিলম্বে আবেদনকৃত সব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনের ভাষণে শান্তির নতুন উন্নয়ন মডেল উপস্থাপন করেছেন। এর ছয়টি প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে_
১. ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ
২. বৈষম্য দূরীকরণ
৩. বঞ্চনার লাঘব
৪. ঝরে পড়া মানুষকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা
৫. মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং
৬. সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন।
প্রধানমন্ত্রী এর নাম দিয়েছেন 'জনগণের ক্ষমতায়ন এবং শান্তিকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল'। প্রধানমন্ত্রীর শান্তির এই মডেল কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন দুনিয়াজুড়ে শিক্ষিত, সুশিক্ষিত, নৈতিকতাসম্পন্ন, মানবতাবাদী বিশাল জনগোষ্ঠীর। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন। সারা বিশ্বে অবশ্য শিক্ষার হার ও গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার গুণগত মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১ সালে শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশ। কিন্তু সরকার দাবি করে আসছে, শিক্ষার হার ৬০ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষিত করে দেওয়া হলো। তাই প্রধানমন্ত্রীর এই মডেল কার্যকর করতে হলে আগে নিজের দেশে তথা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে হবে; তারপর সারা বিশ্বের কথা আসবে।
দুই বছর ধরে যেখানে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার অভাবে সাত হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিভুক্ত করা যাচ্ছে না, তাহলে কিভাবে শান্তির মডেল সারা বিশ্বে কাজে লাগবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আগে নিজ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করে শিক্ষার দ্বার খুলে দিন। দলভিত্তিক এমপিও না করে মানভিত্তিক এমপিও করুন। দুই বছর আগে এক হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে দলগতভাবে। এবার আমরা সরকারকে জনগণের সরকার মনে করব। সরকার শুধু আওয়ামী লীগের নয়। তাই এমপিও করার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে একান্ত প্রাপ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিও করার বিষয় চূড়ান্ত করার পরামর্শ ও দাবি রাখব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই
No comments