অসহিষ্ণু সমাজের অসহায় শিশুরা by লুৎফর রহমান রনো

দুঃখজনক! অত্যন্ত মর্মস্পর্শী এ অপমৃত্যু এবং উদ্বেগজনক। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া শিশুটির নাম হৃদিতা। চমৎকার নাম রেখেছিলেন মা-বাবা। কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ এই মা-বাবার মধ্যকার হৃদয়হীনতা। মা-বাবা-মেয়ে মিলে একটি পরিবার। আর পরিবার হলো একটি সমাজের নিউক্লিয়াস। অনেক পরিবারের সমষ্টিতে সমাজ গঠিত হয়। সমাজের পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রভাব পড়ে পরিবারে; যেমন_পরিবারগুলোর ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ-আচরণ বা তাদের সংস্কৃতির


সম্মিলিত প্রকাশ ঘটে সামাজিক সংস্কৃতিতে। এ জন্য কোনো একজন যেমন পরিবারের সদস্য, তেমনি সমাজেরও। তাই হৃদিতার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ঘটনা নয়, একটি সামাজিক দুর্ঘটনা।
উদ্বেগজনক হারে আমাদের সমাজে শিশুদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা একাধিক শিশু বয়সী বা কিশোরী মেয়ের নাম উল্লেখ করতে পারি, যারা বিভিন্ন সময় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সবাই যে তাদের মা-বাবার প্রতি অভিমান করে তা করেছে, তা নয়। গোটা সমাজের ওপর ছিল তাদের অভিমান ও অভিযোগ। সমাজকে স্পষ্টত তারা অভিযুক্ত করে গেছে; যারা বখাটেদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে বা নির্যাতিতা হিসেবে নিজের মুখ সমাজের কাছে আড়াল করতে আত্মহত্যা করেছে। আমরা আরো স্মরণ করতে পারি একাধিক মা তাঁদের শিশুসন্তানসহ বিষপানে ও ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে জীবনজ্বালা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এসব হৃদয়বিদারক ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। প্রতিটি ঘটনার কারণ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট সমান নয়। কিছুদিন আগে চতুর্থ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী সোনাবুরুর করুণ কাহিনী সারা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এতটুকু মেয়ে, ক্লাসের সেরা মেয়ে। তার জন্মদিন ছিল সেদিন। পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, সে হয়েছে প্রথম। বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখল শূন্য ভাতের হাঁড়ি। ব্যস, পিতৃহীন মেয়ে ঘরের দারিদ্র্য সহ্য করতে পারল না। সে নাকি তার মাকে প্রশ্ন করত, তারা গরিব কেন? সোনাবুরু তার মায়ের কাছ থেকে এ প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব পেয়েছিল কি? আমাদের কাছে আছে কি এ প্রশ্নের সদুত্তর? সবাই এ নিয়তি মেনে নিয়েই বেঁচে আছে। বেঁচে থাকে। সোনাবুরু মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তাকে ওই বয়সে যদি বোঝানো যেত, সোনাবুরু, অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরে পড়াশোনা করো, জানতে পারবে মানুষ কেন এমন গরিব হয়। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে সে জবাব খোঁজার পথে যুদ্ধ করত হয়তো। কিন্তু হলো না।
হৃদিতাও তার জবাব পায়নি_মা-বাবা এমন নির্দয় প্রকৃতির হয় কেন? তার মা-বাবার মধ্যে তেমন সম্পর্ক আর ছিল না একসঙ্গে বসবাসের। দুজন দুই জায়গায় থাকতেন। হৃদিতা থাকত মায়ের সঙ্গে। কিন্তু হৃদিতা দুজনকেই ভালোবাসত এবং দুজনের ভালোবাসার প্রত্যাশী ছিল। বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইলে মা তাতে বাধা দিতেন। পারিবারিক এই বিচ্ছিন্নতা, ভালোবাসাহীনতা, তিক্ততা দেখতে দেখতে বালিকা হৃদিতার মন বিষিয়ে উঠেছিল মা-বাবা-সংসার-সমাজের প্রতি। সবার অলক্ষ্যে নীরবে দিনের পর দিন অবাঞ্ছিত কষ্ট বইতে যেন আর পারছিল না। তারপর যা ঘটার তা-ই ঘটল। মা-বাবা শিক্ষিত ও সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও সন্তানকে তার প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু দিতে পারেননি নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিরোধের কারণে। এটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, ঝগড়া হতে পারে। তা আবার যদি স্থায়ীভাবে দুজনের মনে গেড়ে বসে, তাহলে বিচ্ছিন্ন বা ছাড়াছাড়ি হতেও পারে, অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কিন্তু প্রত্যেক মা-বাবার অবশ্যই সন্তানের দিক বিবেচনা করতেই হবে। কারণ সে নির্দোষ ও অসহায়। আর একটি শিশুর সহায় কেবল ভালো বাড়িঘর, খাওয়া-পরার নিশ্চয়তাই নয়। মা-বাবার ভালোবাসা পাওয়া তার অধিকার। যদিও আমাদের দেশে বেশির ভাগ শিশুরই খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা নেই। তবু শিশুর অধিকারের কথা বলতে হলে মা-বাবা, পরিবার ও সমাজের ভালোবাসা পাওয়া এবং এই পরিবেশে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তার কথা বলতেই হয়।
বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্রই প্রায় সব জাতি, সমাজ ও সম্প্রদায়ে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে। চীনে সচ্ছলতা বেড়েছে মানুষের। কিন্তু প্রতিদিন সে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে। সেখানকার বিশেষজ্ঞদের অভিমত, তাদের এক সন্তান নীতি, দ্রুত শিল্পায়ন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের কারণে তা হচ্ছে। শুধু ২০০৯ সালেই চীনে ২৪ লাখ ৭০ হাজার দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।
বিবাহবিচ্ছেদের মেলা বসে পাশ্চাত্যের অনেক দেশে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনেও হচ্ছে। লাখ লাখ দম্পতির বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। মেলার উদ্দেশ্য কম ঝামেলা ও কম সময়ে আইনি বিষয় সমাধা ও নতুন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা। কানাডার বিবাহবিচ্ছেদ মেলার আয়োজক সোসাইটি অব নোভা স্কটিয়ার এঙ্িিকউটিভ মারিয়া ফ্রান্স বলেন, 'সুন্দর জীবনের জন্য বিবাহবিচ্ছেদ কোনো সমাধান নয়। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসাই জীবনকে সুখী করতে পারে।' তিনি বলেন, 'বিচ্ছেদের কারণে শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের মনের ওপর প্রচণ্ড মন্দ প্রভাব পড়ে।' তাই বিচ্ছেদকে নিরুৎসাহ করতে চায় ফ্রান্স। এ জন্য দম্পতির সঙ্গে আলোচনাও করেন। মধ্যপ্রাচ্যের মতো রক্ষণশীল দেশগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক হারে। সবচেয়ে বেশি মিসরে, তার পরই জর্দান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার প্রভৃতি দেশে প্রতি হাজারে ৩০টি বিয়ে ভাঙছে।
সারা বিশ্বে পারিবারিক-সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, এ জন্য বৈবাহিক পারিবারিক সম্পর্ক তথা মানবিক চেতনা ভেঙে পড়ছে। এর পরিণতি দাঁড়াচ্ছে, শিশুদের সীমাহীন বঞ্চনা। এত কিছুর পরও বলা যায়, যত পরিবার বা বিয়ে ভাঙছে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক সংসার ভাঙার উপক্রম থেকে ফিরে আসছে স্থিতিশীলতায় একমাত্র সন্তানদের কল্যাণ কামনা করে। তাই শিশুদের প্রতি ভালোবাসা মানবজীবনের একটি অপরিহার্য আশীর্বাদ। শিশুরা আমাদের শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানের সাংসারিক সুখ ও শৃঙ্খলার দূত। আমাদের হৃদিতা-সোনাবুরুদের রক্ষা করতে মাকে 'মা', বাবাকে হতে হবে 'বাবা'। স্বামী-স্ত্রীতেই মা-বাবার মধ্যকার সম্পর্ক সীমাবদ্ধ নয়। শিশুদের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে আরো আন্তরিক হতে হবে। আর সমাজ যদি এমন হয়, সবাই সব শিশুর জন্যই স্নেহশীল, তাহলে আত্মহত্যা, বখাটেদের উৎপাত, মা-বাবার নির্দয়তা কমে আসবে। সবাই মিলে শিশুদের স্বার্থে চেষ্টা করে কি সমাজটাকে একটু পাল্টানো যায় না?
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.