প্রচ্ছদ রচনা-কবীর চৌধুরী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর by গনজালেস ডি কস্তা
১৯৯২ সালে গোলাম আযমসহ একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে গড়ে তোলা হয়েছিল গণ-আদালত। সেই আদালতের পুরোভাগে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, কবীর চৌধুরী এবং শাহরিয়ার কবিরসহ আরো অনেকে। সেসব দিনে রাজপথে মানুষের মিছিল নেমেছিল। দাবি উঠেছিল জোরালো কণ্ঠে_গণতন্ত্রের, মানবতাবাদের এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা-রক্ষার। তরুণ সমাজ বুঝতে পেরেছিল কবীর চৌধুরীরা কেন রাজপথে নেমে আসেন, কেন
দিনের পর দিন সারা বাংলাদেশ চষে বেড়ান। নিজের দেশকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি নতুন ধ্যান, প্রজ্ঞা ও সাধনার সুন্দর ভূমিতল। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনিও দেখতে চেয়েছিলেন সুন্দর ও সত্যের জয়। ২০০১ সালের ২২ নভেম্বর শাহরিয়ার কবিরকে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার আটক করে নির্যাতন করে। সেই সময় কবীর চৌধুরী তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তারপর যখন জোট সরকার দেশের সর্বত্র হত্যা-ধর্ষণ চালিয়েছে তার প্রতিবাদও তিনি জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের নিকটজন ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড তাঁকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল। তিনি আশাহত হয়েছিলেন কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে যাননি। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন, কিন্তু শ্রেণীকক্ষে বাংলায় পড়াতে পছন্দ করতেন। তিনি ইংরেজির চেয়ে বাংলায় লিখেছেন বেশি। আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে কাজ করেছেন বিচিত্র গ্রন্থ অনুবাদ করে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে। মনে পড়ে তাঁর অনূদিত কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' ইংরেজিতে আশ্চর্যরকমের ছন্দময় হয়ে রয়েছে। তিনি বিশ্বসাহিত্যের আধুনিকতমদের সানি্নধ্য পছন্দ করতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তাঁর একটি অনুবাদ বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছিল বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার পত্রিকায়।
কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সরকারি চাকুরে বাবার উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা তাঁর শৈশব থেকে মর্মে প্রবেশ করেছিল। তাঁর বাবা ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে ছিলেন সব ধর্মান্ধতা থেকে দূরে। স্কুলজীবনে কবীর চৌধুরীর অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল ঘনিষ্ঠজন। ১৯৪০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সময় এইচ জি ওয়েলস, জর্জ বার্নার্ড শ', বার্ট্রান্ড রাসেলের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধনের সময়গুলো তাঁকে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে গণতন্ত্রের মূল্যবোধগুলো চূর্ণ হয়ে যেতে। কবীর চৌধুরীর গণতন্ত্রে বিশ্বাস, ধর্মনিরপেক্ষকতায় আস্থা এবং মুক্তচিন্তার দিগন্ত দিনের পর দিন বিকশিত হয়েছে। সমাজচিন্তক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন একসময়। দেশভাগের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মীয় উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফের শুরু হয়। কবীর চৌধুরীরা হতাশ হন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে পূর্ব পাকিস্তানে নয়া ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালিদের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল সেই সময় উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার মুখ্য অনুষঙ্গ। ষাটের দশকে পাকিস্তানিরা যখন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে, ঠিক সেই সময় স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে বাঙালির সঙ্গে রাজপথে ছিলেন কবীর চৌধুরী।
ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানিদের বিরোধিতার মধ্যেও বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রস্তুতে অনিবার্য অভিঘাত তৈরি করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে এ সময় অনেক বাঙালি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্য পর্যন্ত কবীর চৌধুরী ছিলেন বাংলা একাডেমীর প্রধান। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং '৭০-এর নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পেছনেও তাঁর অবদান ছিল। ১৯৭১ সালের গণহত্যার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কবীর চৌধুরী প্রায় অর্ধশত বছর শিক্ষকতার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চত্বরে কাজ করেছেন শান্তি ও আন্তধর্ম অনুষঙ্গে মানুষের বিকাশে নির্ভীক সৈনিক হিসেবে। আফ্রো-এশিয়ান লেখক সংঘ, আফ্রো এশিয়ান সলিডারিটি সংঘ, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, ইউনেস্কো ন্যাশনাল কমিশন এবং বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বিশ্বশান্তিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি এক নাগাড়ে অনুবাদ করে গেছেন বিশ্বখ্যাত লেখক ও চিত্রকরদের জীবন এবং সৃষ্টিকর্ম। তিনি শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে সর্বদা চেষ্টা করেছেন সংঘাতকে পরিহার করে জাতীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। অনেক দিনের শিক্ষকতা জীবন, বাংলাদেশ সরকারের সচিব এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল থেকে কাজ করে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। ১৯৯৮ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন। কবীর চৌধুরী বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ-সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি হিসেবে নির্ভীকভাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে রাজপথে কাজ করেছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর সাহসী কথা আমাদের সমাজের জন্য ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে দেশি-বিদেশি লেখকদের সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন। সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল। তিনি জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, বুলগেরিয়া, আঙ্গোলা, জাপান, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একই মঞ্চে আসীন হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি অনেক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বশান্তি নিয়ে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কবীর চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে তিনি সব সময়ই মুক্ত কণ্ঠে কথা বলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের জাতীয় জীবনের আলোকবর্তিকা নিষ্প্রভ হলো। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ড আমাদের জাতীয় জীবনে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি ছিল। তিনি তাঁর সৃষ্টি ও কর্মের জন্য স্বাধীনতা দিবস পদক থেকে শুরু করে অনেক মর্যাদাকর পদকে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবীর চৌধুরী তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নিরলস আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির সেবা করেছেন। নতুন স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা, উদারনৈতিক মানবতা_এসব চিন্তা-চেতনা তাঁর হাত ধরে আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে প্রথম পেঁৗছায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন বিশিষ্টজন। শিক্ষাসচিব হিসেবে কাজ করার সময় তাঁকে দেশের সাধারণ মানুষের অধিকারের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি আশাহত হয়েছিলেন। বলা চলে দেশের পেছন দিকে হাঁটার চিত্র তাঁকে ব্যথিত করেছিল। তিনি একাধিকবার চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরোধী সরকারের সময় গণতন্ত্রের জন্য কাজ করতে। তাঁর সেই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে স্বৈরশাসকরা।
কবীর চৌধুরী কীর্তিমান অনুবাদক ছিলেন। তিনি 'সাহিত্যকোষ' লিখেছেন। গ্রন্থটি একটি ইংরেজি গ্রন্থের অনুসরণে লেখা। অথচ তিনি কী অদ্ভুত সাবলীলতায় বলে গেছেন জটিল সব কথাবার্তা। তিনি এ গ্রন্থে সাহিত্যের জটিল তত্ত্বগুলো সুন্দর করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি শহীদ মুনীর চৌধুরীর অসম্পূর্ণ নাটকের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। তিনি নিজে ইংরেজি থেকে আধুনিক নাটক অনুবাদ করে আমাদের দেশের পাঠককে বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করেছেন। কবীর চৌধুরী ইংরেজি উপন্যাসের সুবৃহৎ গ্রন্থ অনুবাদ করে দেখিয়ে গেছেন পরিশ্রম কাকে বলে। প্রতিটি অনুবাদে তাঁকে মূলের প্রতি অনুগত থাকতে হয়েছে। নির্মাণ করতে হয়েছে বাঙালির উপযোগী ভাষা। তিনি আমাদের বাংলা গ্রন্থ অনুবাদ করে বিশ্বসাহিত্যে আমাদের সৃজনশীলতার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস 'রাইফেল রোটি আওরাত' ইংরেজিতে অনুবাদ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার প্রতি। তাঁর 'শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ' পাঠ করলে বোঝা যায় তাঁর দুর্বলতা ছিল নাটকের প্রতি। কারণ অধিকাংশ প্রবন্ধ বিশ্বের কীর্তিমান নাট্যকারদের ওপর রচিত। এ ছাড়া ভ্রাতা মুনীর চৌধুরী ছিলেন নাট্যপাগল। তাঁর ভগি্ন ফেরদৌসী মজুমদার নাট্যজন। কবীর চৌধুরীও ছিলেন থিয়েটার স্কুলসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান পুরুষ। তবে থিয়েটারকে তাঁর নিজস্ব আঙিনার জিনিস মনে হতো।
কবীর চৌধুরী আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল চেতনার অনন্ত উৎস। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাবে, ধর্মান্ধতা দূর করে পরিশীলিত মানুষ হিসেবে দাঁড়ানোর স্বপ্নে মোহিত করবে। তিনি ছিলেন আমাদের ইতিহাস। আমাদের মতো ক্ষুদ্র দেশে খুব কম মানুষই ইতিহাস হন। তার মধ্যে কবীর চৌধুরী কাজ দিয়ে আমাদের সৃজনের দ্বার নির্মাণ করলেন। সেই দ্বার দিয়ে আমাদের এগিয়ে চলা ভবিষ্যতের দিকে। তাঁকে আবিষ্কার করা আরো বেশি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার সাধনার অংশ। মৃত্যুর পর তাঁর সৎকার সম্পর্কে তিনি যে নির্দেশনা রেখে গেছেন তা আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। তিনি তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে নিতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কেন? যে শহীদ মিনার আমাদের গণতন্ত্রের প্রতীক, যে শহীদ মিনার আমাদের প্রতিবাদের স্মারক, যে শহীদ মিনার আমাদের অধিকার আদায়ের দৃষ্টান্ত_সেই চত্বরকে কেন তিনি বর্জন করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আড়ম্বরহীন আয়োজন। সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা তিনি দেখে গেছেন। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাই শহীদ মিনার তিনি বর্জন করলেন? তিনি ভেবেছিলেন যে চত্বর পবিত্র রক্তের আল্পনায় সিক্ত সেখানে এ ধরনের আয়োজন কি গুরুত্ব বহন করে? তাই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সেই সব নির্দেশনা আমাদের মানুষটির বড় আত্মা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। তিনি ছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের একজন অথচ তিনি সৃষ্টি করলেন ভিন্নতর রীতিনীতি। আমাদের অনেক দিন পর্যন্ত তাঁর এই চেতনা তাড়া করে ফিরবে।
কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সরকারি চাকুরে বাবার উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা তাঁর শৈশব থেকে মর্মে প্রবেশ করেছিল। তাঁর বাবা ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে ছিলেন সব ধর্মান্ধতা থেকে দূরে। স্কুলজীবনে কবীর চৌধুরীর অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল ঘনিষ্ঠজন। ১৯৪০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সময় এইচ জি ওয়েলস, জর্জ বার্নার্ড শ', বার্ট্রান্ড রাসেলের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধনের সময়গুলো তাঁকে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে গণতন্ত্রের মূল্যবোধগুলো চূর্ণ হয়ে যেতে। কবীর চৌধুরীর গণতন্ত্রে বিশ্বাস, ধর্মনিরপেক্ষকতায় আস্থা এবং মুক্তচিন্তার দিগন্ত দিনের পর দিন বিকশিত হয়েছে। সমাজচিন্তক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন একসময়। দেশভাগের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মীয় উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফের শুরু হয়। কবীর চৌধুরীরা হতাশ হন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে পূর্ব পাকিস্তানে নয়া ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালিদের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল সেই সময় উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার মুখ্য অনুষঙ্গ। ষাটের দশকে পাকিস্তানিরা যখন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে, ঠিক সেই সময় স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে বাঙালির সঙ্গে রাজপথে ছিলেন কবীর চৌধুরী।
ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানিদের বিরোধিতার মধ্যেও বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রস্তুতে অনিবার্য অভিঘাত তৈরি করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে এ সময় অনেক বাঙালি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্য পর্যন্ত কবীর চৌধুরী ছিলেন বাংলা একাডেমীর প্রধান। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং '৭০-এর নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পেছনেও তাঁর অবদান ছিল। ১৯৭১ সালের গণহত্যার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কবীর চৌধুরী প্রায় অর্ধশত বছর শিক্ষকতার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চত্বরে কাজ করেছেন শান্তি ও আন্তধর্ম অনুষঙ্গে মানুষের বিকাশে নির্ভীক সৈনিক হিসেবে। আফ্রো-এশিয়ান লেখক সংঘ, আফ্রো এশিয়ান সলিডারিটি সংঘ, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, ইউনেস্কো ন্যাশনাল কমিশন এবং বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বিশ্বশান্তিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি এক নাগাড়ে অনুবাদ করে গেছেন বিশ্বখ্যাত লেখক ও চিত্রকরদের জীবন এবং সৃষ্টিকর্ম। তিনি শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে সর্বদা চেষ্টা করেছেন সংঘাতকে পরিহার করে জাতীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। অনেক দিনের শিক্ষকতা জীবন, বাংলাদেশ সরকারের সচিব এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল থেকে কাজ করে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। ১৯৯৮ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন। কবীর চৌধুরী বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ-সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি হিসেবে নির্ভীকভাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে রাজপথে কাজ করেছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর সাহসী কথা আমাদের সমাজের জন্য ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে দেশি-বিদেশি লেখকদের সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন। সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল। তিনি জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, বুলগেরিয়া, আঙ্গোলা, জাপান, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একই মঞ্চে আসীন হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি অনেক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বশান্তি নিয়ে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কবীর চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে তিনি সব সময়ই মুক্ত কণ্ঠে কথা বলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের জাতীয় জীবনের আলোকবর্তিকা নিষ্প্রভ হলো। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ড আমাদের জাতীয় জীবনে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি ছিল। তিনি তাঁর সৃষ্টি ও কর্মের জন্য স্বাধীনতা দিবস পদক থেকে শুরু করে অনেক মর্যাদাকর পদকে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবীর চৌধুরী তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নিরলস আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির সেবা করেছেন। নতুন স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা, উদারনৈতিক মানবতা_এসব চিন্তা-চেতনা তাঁর হাত ধরে আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে প্রথম পেঁৗছায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন বিশিষ্টজন। শিক্ষাসচিব হিসেবে কাজ করার সময় তাঁকে দেশের সাধারণ মানুষের অধিকারের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি আশাহত হয়েছিলেন। বলা চলে দেশের পেছন দিকে হাঁটার চিত্র তাঁকে ব্যথিত করেছিল। তিনি একাধিকবার চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরোধী সরকারের সময় গণতন্ত্রের জন্য কাজ করতে। তাঁর সেই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে স্বৈরশাসকরা।
কবীর চৌধুরী কীর্তিমান অনুবাদক ছিলেন। তিনি 'সাহিত্যকোষ' লিখেছেন। গ্রন্থটি একটি ইংরেজি গ্রন্থের অনুসরণে লেখা। অথচ তিনি কী অদ্ভুত সাবলীলতায় বলে গেছেন জটিল সব কথাবার্তা। তিনি এ গ্রন্থে সাহিত্যের জটিল তত্ত্বগুলো সুন্দর করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি শহীদ মুনীর চৌধুরীর অসম্পূর্ণ নাটকের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। তিনি নিজে ইংরেজি থেকে আধুনিক নাটক অনুবাদ করে আমাদের দেশের পাঠককে বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করেছেন। কবীর চৌধুরী ইংরেজি উপন্যাসের সুবৃহৎ গ্রন্থ অনুবাদ করে দেখিয়ে গেছেন পরিশ্রম কাকে বলে। প্রতিটি অনুবাদে তাঁকে মূলের প্রতি অনুগত থাকতে হয়েছে। নির্মাণ করতে হয়েছে বাঙালির উপযোগী ভাষা। তিনি আমাদের বাংলা গ্রন্থ অনুবাদ করে বিশ্বসাহিত্যে আমাদের সৃজনশীলতার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস 'রাইফেল রোটি আওরাত' ইংরেজিতে অনুবাদ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার প্রতি। তাঁর 'শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ' পাঠ করলে বোঝা যায় তাঁর দুর্বলতা ছিল নাটকের প্রতি। কারণ অধিকাংশ প্রবন্ধ বিশ্বের কীর্তিমান নাট্যকারদের ওপর রচিত। এ ছাড়া ভ্রাতা মুনীর চৌধুরী ছিলেন নাট্যপাগল। তাঁর ভগি্ন ফেরদৌসী মজুমদার নাট্যজন। কবীর চৌধুরীও ছিলেন থিয়েটার স্কুলসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান পুরুষ। তবে থিয়েটারকে তাঁর নিজস্ব আঙিনার জিনিস মনে হতো।
কবীর চৌধুরী আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল চেতনার অনন্ত উৎস। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাবে, ধর্মান্ধতা দূর করে পরিশীলিত মানুষ হিসেবে দাঁড়ানোর স্বপ্নে মোহিত করবে। তিনি ছিলেন আমাদের ইতিহাস। আমাদের মতো ক্ষুদ্র দেশে খুব কম মানুষই ইতিহাস হন। তার মধ্যে কবীর চৌধুরী কাজ দিয়ে আমাদের সৃজনের দ্বার নির্মাণ করলেন। সেই দ্বার দিয়ে আমাদের এগিয়ে চলা ভবিষ্যতের দিকে। তাঁকে আবিষ্কার করা আরো বেশি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার সাধনার অংশ। মৃত্যুর পর তাঁর সৎকার সম্পর্কে তিনি যে নির্দেশনা রেখে গেছেন তা আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। তিনি তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে নিতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কেন? যে শহীদ মিনার আমাদের গণতন্ত্রের প্রতীক, যে শহীদ মিনার আমাদের প্রতিবাদের স্মারক, যে শহীদ মিনার আমাদের অধিকার আদায়ের দৃষ্টান্ত_সেই চত্বরকে কেন তিনি বর্জন করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আড়ম্বরহীন আয়োজন। সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা তিনি দেখে গেছেন। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাই শহীদ মিনার তিনি বর্জন করলেন? তিনি ভেবেছিলেন যে চত্বর পবিত্র রক্তের আল্পনায় সিক্ত সেখানে এ ধরনের আয়োজন কি গুরুত্ব বহন করে? তাই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সেই সব নির্দেশনা আমাদের মানুষটির বড় আত্মা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। তিনি ছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের একজন অথচ তিনি সৃষ্টি করলেন ভিন্নতর রীতিনীতি। আমাদের অনেক দিন পর্যন্ত তাঁর এই চেতনা তাড়া করে ফিরবে।
No comments