অপরিহার্য কবীর চৌধুরী by হাসান আজিজুল হক
বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সোচ্চার এক বিবেকবান মানুষ। দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের এই অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিত্ব গত ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন। তার স্মৃতির প্রতি কালের খেয়ার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি কেউ কেউ গোটা দেশের জন্য_ সমস্ত জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। অপরিহার্য হয়ে ওঠেন সমকালীন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের জন্য। তবে কখন, কোথায়,
কীভাবে একজন মানুষ এমন হয়ে ওঠেন_ তা হিসাব করে বলা যায় না। কবীর চৌধুরী মারা গেছেন। এ কারণে আমাদের হিসাব করতে হচ্ছে এখন। সবটা হিসাব করে দেখতে হচ্ছে যে, তিনি আমাদের জন্য কেমন প্রয়োজনীয় ছিলেন। আসলে দেশের এবং কালের পরিবর্তনের ধারায় থেকেও কিছু মানুষ নিজেকে কালের ঊধর্ে্ব নিয়ে যেতে পারেন অতি সন্তর্পণে। কখন যে একজন মানুষ এমন অপরিহার্যতা অর্জন করেন তা বলা যায় না। এটা অনেকটা সময়ের, অনেকটা কর্মের ব্যাপার।
আমি তো তাকে দেখেছি_ নানা কিছুর সঙ্গে জড়িত থেকে বহুমাত্রার কর্মধারায় সম্পৃক্ত হয়ে তিনি যতটা নিয়েছেন_ দিয়েছেন তার চেয়েও বেশি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম_ একটি মানুষের কাছে যে শিক্ষা পায় তা একটা ধরন তৈরি করে। সে ধরনটাই একটা দিকনির্দেশনা হয়ে থাকে আমাদের কাছে।
১৯৬০ সালের দিকে কবীর চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি। রাজশাহীতে একটা গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে এসেছিলেন। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, 'ট্রেডিশন অ্যান্ড চেঞ্জ ইন আর্ট' নামের সেই সেমিনারে মুনীর চৌধুরীও ছিলেন। সেমিনারে পঠিত রচনাগুলো এবং সংশ্লিষ্ট আলোচনার সম্পূর্ণটাই ইংরেজিতে হয়েছিল। তখনকার দিনের এ ধরনের সেমিনার বেশিরভাগ সময়েই ইংরেজিতে হতো। এ কথা উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, সেখানে কবীর চৌধুরীর বক্তৃতা শুনে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
সেদিনের সে সেমিনারে কবীর চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী দু'ভাই ছাড়াও ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসানসহ আরও অনেক গুণীজন। আমার সেই তরুণ বয়সে এই মানুষদের পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। রাজশাহীতে তারা ছিলেন। আমার তো উৎসাহের কমতি নেই। সারাক্ষণ তাদের আশপাশে ঘুর ঘুর করছিলাম। কখন তাদের কী দরকার লাগে। সেখানে মুনীর চৌধুরী একবার আমাকে ডেকে দূরে বসে থাকা একটা লোককে দেখিয়ে বলেছিলেন_ ওই যে ওনার কাছে গিয়ে আমার জন্য সিগারেট নিয়ে আয়। মুনীর ভাইয়ের দেখানো সেই লোকটিই ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
কবীর চৌধুরী ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সুদর্শন আর গোছানো এমন মানুষ কমই দেখা যায়। দেখার সৌন্দর্যের সঙ্গে চিন্তাভাবনা এবং মেধারও কমতি ছিল না তার। নানা বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টিই ধীরে ধীরে তাকে অপরিহার্য মানুষ হয়ে উঠতে সহায়তা করেছিল। সেই সঙ্গে তার ছিল পরিশ্রমী মানসিকতা। সমাজ, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। শুধু তাই নয়, এসব বিষয়কে সময়োচিত ভঙ্গিমায় আমাদের কাছে তুলে ধরার এক আন্তরিক প্রচেষ্টাও ছিল তার চরিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশ্ব সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা তার হাত দিয়ে আমরা পেয়েছি বাংলায়। যা আমাদের জন্য যেমন ছিল দরকারি_ তেমনি অপরিহার্য ভবিষ্যৎ প্রত্যেক প্রজন্মের জন্যও। শুধু যে বিদেশি ভাষার বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন, তা নয়। বাংলা গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বইও তিনি ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন। এগুলো এখন আমাদের কাছে রেখে যাওয়া তার সম্পদ।
শিক্ষকতা করেছেন বহুদিন। তার আন্তরিক শিক্ষাদানের সুনামও শুনেছি। আর তাঁকে দেখেছি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন-সংগ্রামে। দেশের প্রায় সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই থাকত তার সরব সম্পৃক্ততা। এক কথায় তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিপ্রাণ প্রগতিশীল মানুষ।
যে অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে পরবর্তীকালে কবীর চৌধুরী প্রতীয়মান হয়েছেন_ তা তখন, সেই ষাট সালে ছিল না। তখনও তা পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তাকে যে কারণে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল তা হলো তার সৌন্দর্য ও আচরণগত মাধুর্য। যৌবনে তিনি যে কতটা সুপুরুষ ছিলেন তা ভেবে ওঠা যায় না। সাধারণ ধারার চেয়ে অর্থাৎ সচরাচর যে ধরনের মানুষ দেখা যায়_ কবীর চৌধুরী ছিলেন তা থেকে আলাদা। সে তুলনায় মুনীর চৌধুরী ততটা সুপুরুষ ছিলেন না। কণ্ঠও ছিল খসখসে। তাই কবীর চৌধুরীকে সেই প্রথমবার দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। তার কথা বলা, পরিপাটি আচার-ব্যবহার, চিন্তাশৈলী আকৃষ্ট করার মতোই।
তার গুরুত্ব সে সময় আমরা বুঝতে না পারলেও_ বাঙালি-বাংলাদেশ তার জাতীয়তার সত্তার ভিত্তি নিয়ে দাঁড়ালে, স্বাধীন হলে তিনি যে সবার পছন্দের মানুষ হবেন, তা তখনই বোঝা গিয়েছিল। তার সঙ্গে অনেক দিন আর তেমন দেখা হয়নি ১৯৬০-এর পর। ঢাকায় এসেছি বহুবার। পরে তার সঙ্গে বিশেষ করে দেখা হতো, কথা হতো_ তিনি যখন বাংলা একাডেমীর পরিচালক হলেন তখন। আমি প্রায়ই যেতাম বাংলা একাডেমীতে। তরুণদের ব্যাপারে তার আন্তরিকতা এবং সহযোগিতা ছিল বলার মতো। আন্তরিকতার এক দারুণ দৃষ্টান্ত ছিলেন সর্বদাই হাসিমুখের এই মানুষটি।
আমি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাই ১৯৭০ সালে। তখন তো সময়টা এমন ছিল না। চরম সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দিনকাল। আন্দোলন-সংগ্রামে প্রচণ্ড উষ্ণ সে সময়ে বাংলা একাডেমী থেকে পুরস্কারটা আর নেওয়া হয়নি। ১৯৭১ সাল এলো। এরই মধ্যে ২৫ মার্চের জঘন্য হত্যাকাণ্ডও ঘটে গেল। দেশজুড়ে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। আমি তখন খুলনা শহরে থাকি। শহরের একটা পাড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকতাম। আজ এখানে কাল ওখানে করে দিন চলছে। দারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করছি। অর্থকষ্টও নিদারুণ। আমি তখন দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে পড়াতাম। সেই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে '৭১-এর জুন মাসে হঠাৎ করে ডাকযোগে আমি একটা চেক পাই। বাংলা একাডেমী পুরস্কারের চেক। মূল্যমান ৩০০০ টাকা। ১৯৭১ সালের ৩ হাজার টাকা। এমন দুর্দিনে এ রকম আশীর্বাদের কথা ভাবা যায় না। সেদিন কবীর চৌধুরী সম্পর্কে আমার ধারণার পরিধি বেড়ে গিয়েছিল আরও বহু গুণ। যুদ্ধকালীন এমন পরিবেশে বাংলা একাডেমীর কর্মকাণ্ড তিনি পালন করে গেছেন। তার সে দিনের দায়িত্বশীলতায় আমি চিরকালের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ রয়ে গেলাম। তার সহযোগিতা বহুকাল লাভ করে এসেছি। উপকৃত হয়েছি।
সমাজ, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। শুধু তাই নয়, এসব বিষয়কে সময়োচিত ভঙ্গিমায় আমাদের কাছে তুলে ধরার এক আন্তরিক প্রচেষ্টাও ছিল তার চরিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
তার আরেকটি বড় গুন হল অফুরন্ত প্রাণশক্তি। তিনি সর্বদাই যুক্ত থাকতেন কোন না কোন কাজে। লেখালেখি ছাড়াও বৈচিত্র্যময় কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পছন্দ করতেন। সংস্কৃতি জগতের প্রায় সকল জায়গাতেই তাকে দেখতে পেয়েছি।
তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনে সর্বদাই নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতেন। শুধু যে অংশগ্রহণ করতেন তাই না, সংস্কৃতির পরিসর উন্নয়নের জন্য লিখতেনও। সেই চিহ্ন রয়ে গেছে তার অসংখ্য প্রবন্ধে। তার প্রবন্ধগুলো আমাদের তো বটেই, পাথেয় হয়ে থাকবে আগামী প্রজন্মের জন্যও। তার এই কর্মব্যস্ততা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থামেনি। আমাদের জীবনেও থামবে না তার সৃষ্টির এ অপরিহার্য যাতায়াত।
এতসবকিছুর সাথে সম্পৃক্ত থেকেও তার ছিল আড়ম্বরহীন এক পরিচ্ছন্নতা। কথা বলা থেকে শুরু করে তার আচরণে অসাধারণ এক সরলতাও ছিল। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি যেমন ছিল তার আন্তরিক আগ্রহ_ তেমনি আন্তরিকতা ছিল মানুষের প্রতিও। আন্তরিকতা ও আড়ম্বরহীনতার যে দৃষ্টান্ত জীবনব্যাপী তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তা মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছাতেও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সংস্কৃতিপ্রাণ এমন মানুষ দেশের জন্য, জাতির জন্য বারবার প্রয়োজন। যে প্রয়োজনীয়তা এবং একই সাথে সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে আমাদের জাতীয় জীবনে।
একটা স্থাপনা যে যে স্তম্ভের ওপর দৃশ্যত দাঁড়িয়ে থাকে, সেই স্তম্ভগুলোর নিচে থাকে আরও অনেক শক্তি। একটি দেশের দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সেই রকম স্তম্ভের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের প্রাণশক্তির উৎস সেই স্তম্ভগুলোর একটি ছিলেন কবীর চৌধুরী। তার প্রয়াণে আমরা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেলাম। া
আমি তো তাকে দেখেছি_ নানা কিছুর সঙ্গে জড়িত থেকে বহুমাত্রার কর্মধারায় সম্পৃক্ত হয়ে তিনি যতটা নিয়েছেন_ দিয়েছেন তার চেয়েও বেশি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম_ একটি মানুষের কাছে যে শিক্ষা পায় তা একটা ধরন তৈরি করে। সে ধরনটাই একটা দিকনির্দেশনা হয়ে থাকে আমাদের কাছে।
১৯৬০ সালের দিকে কবীর চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি। রাজশাহীতে একটা গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে এসেছিলেন। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, 'ট্রেডিশন অ্যান্ড চেঞ্জ ইন আর্ট' নামের সেই সেমিনারে মুনীর চৌধুরীও ছিলেন। সেমিনারে পঠিত রচনাগুলো এবং সংশ্লিষ্ট আলোচনার সম্পূর্ণটাই ইংরেজিতে হয়েছিল। তখনকার দিনের এ ধরনের সেমিনার বেশিরভাগ সময়েই ইংরেজিতে হতো। এ কথা উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, সেখানে কবীর চৌধুরীর বক্তৃতা শুনে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
সেদিনের সে সেমিনারে কবীর চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী দু'ভাই ছাড়াও ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসানসহ আরও অনেক গুণীজন। আমার সেই তরুণ বয়সে এই মানুষদের পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। রাজশাহীতে তারা ছিলেন। আমার তো উৎসাহের কমতি নেই। সারাক্ষণ তাদের আশপাশে ঘুর ঘুর করছিলাম। কখন তাদের কী দরকার লাগে। সেখানে মুনীর চৌধুরী একবার আমাকে ডেকে দূরে বসে থাকা একটা লোককে দেখিয়ে বলেছিলেন_ ওই যে ওনার কাছে গিয়ে আমার জন্য সিগারেট নিয়ে আয়। মুনীর ভাইয়ের দেখানো সেই লোকটিই ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
কবীর চৌধুরী ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সুদর্শন আর গোছানো এমন মানুষ কমই দেখা যায়। দেখার সৌন্দর্যের সঙ্গে চিন্তাভাবনা এবং মেধারও কমতি ছিল না তার। নানা বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টিই ধীরে ধীরে তাকে অপরিহার্য মানুষ হয়ে উঠতে সহায়তা করেছিল। সেই সঙ্গে তার ছিল পরিশ্রমী মানসিকতা। সমাজ, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। শুধু তাই নয়, এসব বিষয়কে সময়োচিত ভঙ্গিমায় আমাদের কাছে তুলে ধরার এক আন্তরিক প্রচেষ্টাও ছিল তার চরিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশ্ব সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা তার হাত দিয়ে আমরা পেয়েছি বাংলায়। যা আমাদের জন্য যেমন ছিল দরকারি_ তেমনি অপরিহার্য ভবিষ্যৎ প্রত্যেক প্রজন্মের জন্যও। শুধু যে বিদেশি ভাষার বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন, তা নয়। বাংলা গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বইও তিনি ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন। এগুলো এখন আমাদের কাছে রেখে যাওয়া তার সম্পদ।
শিক্ষকতা করেছেন বহুদিন। তার আন্তরিক শিক্ষাদানের সুনামও শুনেছি। আর তাঁকে দেখেছি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন-সংগ্রামে। দেশের প্রায় সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই থাকত তার সরব সম্পৃক্ততা। এক কথায় তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিপ্রাণ প্রগতিশীল মানুষ।
যে অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে পরবর্তীকালে কবীর চৌধুরী প্রতীয়মান হয়েছেন_ তা তখন, সেই ষাট সালে ছিল না। তখনও তা পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তাকে যে কারণে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল তা হলো তার সৌন্দর্য ও আচরণগত মাধুর্য। যৌবনে তিনি যে কতটা সুপুরুষ ছিলেন তা ভেবে ওঠা যায় না। সাধারণ ধারার চেয়ে অর্থাৎ সচরাচর যে ধরনের মানুষ দেখা যায়_ কবীর চৌধুরী ছিলেন তা থেকে আলাদা। সে তুলনায় মুনীর চৌধুরী ততটা সুপুরুষ ছিলেন না। কণ্ঠও ছিল খসখসে। তাই কবীর চৌধুরীকে সেই প্রথমবার দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। তার কথা বলা, পরিপাটি আচার-ব্যবহার, চিন্তাশৈলী আকৃষ্ট করার মতোই।
তার গুরুত্ব সে সময় আমরা বুঝতে না পারলেও_ বাঙালি-বাংলাদেশ তার জাতীয়তার সত্তার ভিত্তি নিয়ে দাঁড়ালে, স্বাধীন হলে তিনি যে সবার পছন্দের মানুষ হবেন, তা তখনই বোঝা গিয়েছিল। তার সঙ্গে অনেক দিন আর তেমন দেখা হয়নি ১৯৬০-এর পর। ঢাকায় এসেছি বহুবার। পরে তার সঙ্গে বিশেষ করে দেখা হতো, কথা হতো_ তিনি যখন বাংলা একাডেমীর পরিচালক হলেন তখন। আমি প্রায়ই যেতাম বাংলা একাডেমীতে। তরুণদের ব্যাপারে তার আন্তরিকতা এবং সহযোগিতা ছিল বলার মতো। আন্তরিকতার এক দারুণ দৃষ্টান্ত ছিলেন সর্বদাই হাসিমুখের এই মানুষটি।
আমি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাই ১৯৭০ সালে। তখন তো সময়টা এমন ছিল না। চরম সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দিনকাল। আন্দোলন-সংগ্রামে প্রচণ্ড উষ্ণ সে সময়ে বাংলা একাডেমী থেকে পুরস্কারটা আর নেওয়া হয়নি। ১৯৭১ সাল এলো। এরই মধ্যে ২৫ মার্চের জঘন্য হত্যাকাণ্ডও ঘটে গেল। দেশজুড়ে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। আমি তখন খুলনা শহরে থাকি। শহরের একটা পাড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকতাম। আজ এখানে কাল ওখানে করে দিন চলছে। দারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করছি। অর্থকষ্টও নিদারুণ। আমি তখন দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে পড়াতাম। সেই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে '৭১-এর জুন মাসে হঠাৎ করে ডাকযোগে আমি একটা চেক পাই। বাংলা একাডেমী পুরস্কারের চেক। মূল্যমান ৩০০০ টাকা। ১৯৭১ সালের ৩ হাজার টাকা। এমন দুর্দিনে এ রকম আশীর্বাদের কথা ভাবা যায় না। সেদিন কবীর চৌধুরী সম্পর্কে আমার ধারণার পরিধি বেড়ে গিয়েছিল আরও বহু গুণ। যুদ্ধকালীন এমন পরিবেশে বাংলা একাডেমীর কর্মকাণ্ড তিনি পালন করে গেছেন। তার সে দিনের দায়িত্বশীলতায় আমি চিরকালের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ রয়ে গেলাম। তার সহযোগিতা বহুকাল লাভ করে এসেছি। উপকৃত হয়েছি।
সমাজ, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। শুধু তাই নয়, এসব বিষয়কে সময়োচিত ভঙ্গিমায় আমাদের কাছে তুলে ধরার এক আন্তরিক প্রচেষ্টাও ছিল তার চরিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
তার আরেকটি বড় গুন হল অফুরন্ত প্রাণশক্তি। তিনি সর্বদাই যুক্ত থাকতেন কোন না কোন কাজে। লেখালেখি ছাড়াও বৈচিত্র্যময় কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পছন্দ করতেন। সংস্কৃতি জগতের প্রায় সকল জায়গাতেই তাকে দেখতে পেয়েছি।
তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনে সর্বদাই নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতেন। শুধু যে অংশগ্রহণ করতেন তাই না, সংস্কৃতির পরিসর উন্নয়নের জন্য লিখতেনও। সেই চিহ্ন রয়ে গেছে তার অসংখ্য প্রবন্ধে। তার প্রবন্ধগুলো আমাদের তো বটেই, পাথেয় হয়ে থাকবে আগামী প্রজন্মের জন্যও। তার এই কর্মব্যস্ততা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থামেনি। আমাদের জীবনেও থামবে না তার সৃষ্টির এ অপরিহার্য যাতায়াত।
এতসবকিছুর সাথে সম্পৃক্ত থেকেও তার ছিল আড়ম্বরহীন এক পরিচ্ছন্নতা। কথা বলা থেকে শুরু করে তার আচরণে অসাধারণ এক সরলতাও ছিল। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি যেমন ছিল তার আন্তরিক আগ্রহ_ তেমনি আন্তরিকতা ছিল মানুষের প্রতিও। আন্তরিকতা ও আড়ম্বরহীনতার যে দৃষ্টান্ত জীবনব্যাপী তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তা মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছাতেও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সংস্কৃতিপ্রাণ এমন মানুষ দেশের জন্য, জাতির জন্য বারবার প্রয়োজন। যে প্রয়োজনীয়তা এবং একই সাথে সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে আমাদের জাতীয় জীবনে।
একটা স্থাপনা যে যে স্তম্ভের ওপর দৃশ্যত দাঁড়িয়ে থাকে, সেই স্তম্ভগুলোর নিচে থাকে আরও অনেক শক্তি। একটি দেশের দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সেই রকম স্তম্ভের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের প্রাণশক্তির উৎস সেই স্তম্ভগুলোর একটি ছিলেন কবীর চৌধুরী। তার প্রয়াণে আমরা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেলাম। া
No comments