ধর নির্ভয় গান-'৭১ এবং আমাদের আজকের তরুণরা by আলী যাকের

ইংরেজি মাধ্যমের অনেক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের বলেন, 'কোনো মতে বাংলাটা পাস করলেই হবে। ইংরেজিটা ভালো করে শেখো। বাংলা শেখা সময়ের অপচয় মাত্র।' আমার ধারণা, এসব তরুণের সঙ্গে একটা সংলাপ অচিরেই শুরু করতে হবে, যেন তাদের স্বার্থান্বেষী অভিভাবকদের প্রভাব কাটিয়ে তাদের মুক্তির পথ দেখানো যায়। অন্যথায় যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মের শেষ মানুষটি এই সমাজ থেকে বিদায় নেবে, তখন একটি


বিকৃতমনা, স্বাধীনতাবিরোধী, অর্ধশিক্ষিত জাতি আমাদের দেশে বিচরণ করবে সম্প্রতি বিজয় দিবস উপলক্ষে তরুণদের এক সমাবেশে আমার ডাক পড়ে তাদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য। এই সমাবেশটির পেছনে কেবলই বিজয় দিবস উদযাপন নয়, উদ্দেশ্য ছিল যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ নিয়ে বাঙালি নিধনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিল '৭১-এ, তাদের পুনরুত্থানের ওপর মতবিনিময়। ওই আলোচনায় একটি সত্য বেরিয়ে আসে যে, '৭১-এর পরাজিত শক্তিরা আবারও মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং তাদের প্রতিহত না করা গেলে যে মূল্যবোধ ও আদর্শ নিয়ে আমরা '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং অগণিত বাঙালি আত্মদান করেছিল, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা সকলেই গর্বিত বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ফলে আমরা সবাই বৈষয়িক কিংবা মানসিক দিক দিয়ে যৎকিঞ্চিৎ লাভবান হয়েছি। আমার মনে হয়, এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে আমাদের অনেকেই এমন স্থানে পেঁৗছেছি আজ, যা হয়তো পাকিস্তানের অধীনে থাকলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের চাকরির সময় হয়তো পার হয়ে যেত, কিন্তু উচ্চাসনে বসার সুযোগ তারা পেতেন না কোনোকালেই। মাঝামাঝি কোনো একটি স্থানে এসে আটকে যেতেন। একজন বাণিজ্যিক নির্বাহী মধ্যম মানের একজন প্রশাসক হিসেবেই চাকরি শেষ করতে বাধ্য হতেন। একজন ব্যবসায়ীর ছোটখাটো ব্যবসা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো এবং একজন সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার নিশ্চিতভাবে কর্নেল পদের ওপরে আরোহণ করতে পারতেন না। অন্ততপক্ষে ইতিহাস আমাদের এই কথাই বলে।
আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সব ক্ষেত্রে যেসব ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এসে পেঁৗছেছি, তার কারণ আমরা নিজেরাই হয়েছি নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী। বলা হয়ে থাকে, একটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা প্রতিনিয়ত ব্যাহত হয় কিংবা শিল্পীর কণ্ঠ রোধ করে তার চর্চাকে স্তিমিত করে দেওয়ার একটি চেষ্টা উপনিবেশবাদীরা সবসময়ই করে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভ করে আমরা স্বাধীন হলাম ঠিকই, কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য আমাদের দেশজ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। এই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ই। দেশ মুক্ত হওয়ার পর কিছুদিন এই দেশদ্রোহীদের কর্মকাণ্ড কিছুটা স্তিমিত ছিল বটে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নষ্টামি করার সুযোগ আবার তৈরি করে নিল। ততদিনে যারা অস্ত্র হাতে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তারা সকলেই নিজ নিজ পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং পেশাগত কারণে রাজনীতি থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছেন। এই প্রায় অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি এই দুরভিসন্ধিকারীরা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে চলেছে।
আমি সেদিনের ওই সমাবেশে বক্তাদের কথা শুনছিলাম আর হতাশার বাণী শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যে, আমরা কি তবে আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে সংহত রাখতে পারব না? তবে কি আমাদের আর কোনো আশা নেই? আমরা এই মুক্ত বাংলাদেশেই দেখেছি নব্য পাকিস্তানিদের পুনরুত্থান এবং এতই সুচারুরূপে এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছে যে, কোমলমতি বালক-বালিকাদেরও বাংলাদেশের জন্মের ওপর ভ্রান্ত ইতিহাস পড়ানো শুরু হয়েছিল। আমি সম্প্রতি নবপ্রজন্মের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে শুরু করেছি। আমার দৃঢ় ধারণা যে, আমাদের ভবিষ্যৎ এখন ওদের ওপরই ন্যস্ত। তারা যদি ঠিক পথে চলে তবে কোনো অশুভ শক্তির সাধ্য নেই আমাদের আদর্শের বাংলাদেশকে তারা আবার একটি মিনি পাকিস্তানে পরিণত করে। আমি এই তরুণদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের মনমানসিকতা জানার চেষ্টা করি এবং আনন্দিত হই এই দেখে যে, ওই তরুণদের সিংহভাগ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং বিশ্বাস করে যে, সঠিক ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান আহরণ ছাড়া দেশের মঙ্গল সম্ভব নয়। আমি তাদের প্রায়ই জিজ্ঞেস করি, 'অতীত' সম্বন্ধে জানা কি কোনো জাতির জন্য প্রয়োজনীয়? এই প্রশ্নটি আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এক জোড়া তরুণ-তরুণীকে যারা ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে এসেছে। তরুণীটি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী এবং একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। আর তরুণটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র। তারা উভয়ে সমস্বরে আমার এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিল, আমরা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীন হয়েছিলাম আজ থেকে ৪০ বছর আগে, সেই সময়টা তো অতীতই বটে। ফলে অতীতকে কী করে আমরা ভুলে যেতে পারি? তারা এও বলেছিল, আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ হয়েছিল ১৯৭০-এর একটি নির্বাচনের মাধ্যমে, সেটিও অতীতেরই ঘটনা।
আমি এই তরুণ-তরুণীর অমন নিঃশঙ্ক কথাবার্তায় আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে, আমাদের স্বাধীন দেশের ভাগ্য নির্ধারণ যারা করবে, তারা এই তরুণ বয়সেই তৈরি হয়ে গেছে। অতএব, আমাদের ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও যে নেই, তা নয়। একটু অনুসন্ধান করলেই আমরা দেখতে পাব, আমাদের তরুণদের অনেকেই বলে, আমাদের ইতিহাস সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান ওদের নেই। আর এই অনুসন্ধানের একটু গভীরে গেলেই এ কথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তারা আসলে ইতিহাসে আগ্রহী নয়। তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'কেন নয়?' তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে জবাবটি তারা দেয়, তা হচ্ছে তাদের বাবা-মা অথবা অভিভাবকরা তাদের কখনোই ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু বলেননি অথবা এর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কখনও কিছু উল্লেখ করেননি। অনেকে আমায় এ কথাও বলেছে, কিছু কিছু বাবা-মা তাদের সন্তানদের ঐতিহাসিক সত্য থেকে দূরে থাকতেই উপদেশ দেন। যখন আমি তাদের কাছে ইতিহাসের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছি, তারা অবলীলায় স্বীকার করেছে যে, তাদের কোনো কিছুই জানা ছিল না। এর জবাবে আমি সবসময় বলি, এখনও বলব, ইতিহাস না জানার কোনো ক্ষমা নেই। ইতিহাস জানাটা তাদের কর্তব্য। আজকাল আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপর অনেক তথ্যসমৃদ্ধ বইপত্র সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি ওয়েবসাইটে গেলেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল খুব সহজেই চোখে পড়বে। কাজে কাজেই এই অজ্ঞতা কোনো অজুহাতেই সমর্থন করা যায় না।
তবে আজ আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এই তরুণ-তরুণীরা যদি ইতিহাস সম্বন্ধে অসচেতন হয়েই থাকে, তবে তা আমাদের প্রজন্মের কারণেই। আমরাই কখনও সচেষ্ট হইনি আমাদের সন্তানদের দেশ সম্বন্ধে সচেতন করতে। আমি জানি, এমন অনেক অভিভাবক আছেন যারা তাদের সন্তানদের বাংলাদেশ সম্পর্কীয় সব বিষয় থেকে দূরে রাখতেই অধিক উৎসাহী। তারা বলেন, স্কুল কি কলেজ পর্যায়ে কেবল সেটুকুই শেখা দরকার, যা তাদের সন্তানদের জন্য বিদেশে পড়াশোনা করার পথ করে দেবে। ইংরেজি মাধ্যমের অনেক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের বলেন, 'কোনোমতে বাংলাটা পাস করলেই হবে। ইংরেজিটা ভালো করে শেখো। বাংলা শেখা সময়ের অপচয় মাত্র।'
আমার ধারণা, এসব তরুণের সঙ্গে একটা সংলাপ অচিরেই শুরু করতে হবে, যেন তাদের স্বার্থান্বেষী অভিভাবকদের প্রভাব কাটিয়ে তাদের মুক্তির পথ দেখানো যায়। অন্যথায় যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মের শেষ মানুষটি এই সমাজ থেকে বিদায় নেবে, তখন একটি বিকৃতমনা, স্বাধীনতাবিরোধী, অর্ধশিক্ষিত জাতি আমাদের দেশে বিচরণ করবে। আমরা নিক্ষিপ্ত হবো অন্ধকারের অতল গহ্বরে।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.