আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫৫)-বুকটা ভরে গেল by আলী যাকের
পশ্চিম পাকিস্তানে এবং এখনকার পাকিস্তানে একটি শ্রেণী আছে, যারা সামন্তবাদসৃষ্ট শিক্ষিত শ্রেণী। এরা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সেই শিক্ষা থেকে আহরিত গণতন্ত্র, মুক্তবুদ্ধি, বাকস্বাধীনতা এবং মানুষের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। তবে আমি দেখেছি, যেহেতু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষ নিতান্তই কৃষক এবং শ্রমিক শ্রেণীর, সেহেতু এসব শিক্ষিত মানুষ দুঃশাসন, কি শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণত সোচ্চার হয় না। সোচ্চার হলেও এদের কথায়
পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা কখনোই কর্ণপাত করে না। কেননা তারা জানে যে তাদের দুরাচার বা ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত শঙ্কিত থাকে। ফলে কখনোই সোচ্চার হবে না। আমরা তো জানি যে স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে মুক্তির জন্য যে দুঃসাহসী আন্দোলনের প্রয়োজন হয়, তাতে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে। সেই তখন থেকে অনেক বছর পর বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমি পাকিস্তানের একজন শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীরকে প্রশ্ন করেছিলাম যে 'আপনারা যত আন্দোলনই করুন না কেন, আপনাদের কি মনে হয় পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী কখনো আপনাদের কথায় কর্ণপাত করে?' জবাবে তিনি আমতা আমতা করেছিলেন; কিন্তু স্পষ্ট কিছুই বলতে পারেননি। পাকিস্তানি সমাজ সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতদরিদ্র কৃষক কিংবা মজুর শ্রেণী আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সামন্তবাদ উদ্ভূত ধনিক শ্রেণী। আর তৃৃতীয়টি এদের সবার ওপর ছড়ি ঘোরানো সামরিক শাসকরা। এদের হাতেই সব ক্ষমতা। এবং আশ্চর্য ব্যাপার হলো যে এই সামরিক শ্রেণীর মানুষ সামন্ত শ্রেণী থেকে এলেও একবার উর্দি চড়ালে তাদেরই মা-বাবা তাদের প্রতি ভয়ের চোখে তাকান। যে পরিবারে একজন সামরিক অফিসার রয়েছে, সেই পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুই হয়ে দাঁড়ায় সে। এই অদ্ভুত এক শ্রেণীবিন্যাস বোধ করি কোনোকালে পাকিস্তানে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠতে দেবে না। এ কথাগুলো বললাম এ কারণে যে সেই ষাটের দশকের মধ্যভাগেই পাকিস্তানে থাকাকালীন এসব বিষয়ে আমার মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিত। আমরা তখনো কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করিনি। এখন জানি, সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানে বাঙালিদের কোনো সম্মানজনক অবস্থান হওয়ার নয়।
প্লেনে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি নিজের মনেই হাসছিলাম। হাসছিলাম এ ভেবে যে আমাদের পূর্বপুরুষরা কী করে এ ধরনের একটি অসম্ভব রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেছিলেন, যার দুই অংশের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুতে মিল নেই। এমনকি ধর্মেরও যে আনুষ্ঠানিকতা, সেটিও আমাদের চেয়ে অনেক ভিন্ন ওদের। যদি ধর্মই কোনো রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণ করতে পারে, তাহলে তো ইন্দোনেশিয়া থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত যত মুসলিম রাষ্ট্র আছে, সব মিলে এক দেশ হতো। যা হোক, এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঢাকায় পেঁৗছে গেছি তা লক্ষ করিনি। এয়ার হোস্টেসের সিটবেল্ট বাঁধার আহ্বানে প্লেনের ঘুলঘুলি দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমার শস্য-শ্যামল বাংলাদেশ। বুকটা ভরে গেল।
বুকটা যেমন আনন্দে ভরে গেল, চোখ দিয়ে তখন ঝরছে আনন্দাশ্রু। মন কেমন করা ভাবনা আমায় ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল যে আমি ফিরে এসেছি আমার দরিদ্র মায়ের কাছে। যত হতদরিদ্রই হোক, আমার মা তো বটে! যেন দুই হাত তুলে সন্তানকে আহ্বান করছে উদাত্ত কণ্ঠে। মরুভূমির দেশ থেকে ফিরে এলাম জলাভূমির দেশে। নিচে দেখা যাচ্ছে পদ্মা নদী। কত পুরনো কথা মনে পড়ে গেল এ নদীকে ঘিরে। এ নদীর ওপর দিয়ে কতবার যাওয়া-আসা করেছি, তার হিসেব দেওয়া মুশকিল। মনে পড়ল নৌকার দুলুনি, স্টিমারে খাওয়া, রাতের অন্ধকার ভেদ করে জেলেনৌকার কেরোসিন বাতি আর বিক্রমপুরের কোনো স্টেশনে যাত্রী এবং কুলিদের হৈচৈ। পিআইএর বোয়িং এসে নামল ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে। প্লেন থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখি, ভাইয়া হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। পরনে তাঁর পিআইএর ইউনিফরম। পিআইএর চাকরির সুবাদেই তিনি ওই ইউনিফরম পরে একেবারে বিমানের কাছ অবধি আসতে পেরেছিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের দেখে কারো মনে হওয়া সম্ভব ছিল না বোধ হয় যে এত দিন বাদে দুই ভাইয়ের দেখা। এ ছিল প্রায় প্রতিদিন সাক্ষাতের মতোই। তখন দুই পাকিস্তানে যাতায়াত করতে মালামাল পরীক্ষা করা হতো। কাস্টমস কর্তৃপক্ষই করত। একই দেশের দুই ভাগের মধ্যে যাতায়াত অথচ কাস্টমসের পরীক্ষার বিষয়টি আমার কাছে কেমন গোলমেলে লেগেছিল। এটাই যদি হয়, তাহলে আর ইমিগ্রেশনের অসুবিধা কোথায়? দুই বিভাগের দুই পাসপোর্ট হলেই হয়ে যায়।
আমি ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর ছোট্ট বাসাটিতে এসে উঠলাম। সেটি ছিল মগবাজারের নয়াটোলায়। খুবই সরু একটি গলির শেষ মাথায় একতলা বাসা। মাঝখানে একটি পাকা আঙিনা। কিন্তু নিজের দেশের বাসা তো? প্রচণ্ড আনন্দ লেগেছিল। সেখানে বসে এক পেয়ালা চা হাতে আমার প্রবাসজীবনের নানা গল্প শোনাতে লাগলাম ভাইয়াকে। ইতিমধ্যে আমার দু-তিনজন বন্ধু এসে হাজির। তারাও সানন্দে যোগ দিল এ আড্ডায়। অল্পক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে এলে মুড়ি বানানো হলো সরিষার তেল দিয়ে। তা খেতে খেতে আবারও গল্প চলতে লাগল। রাত ১০টায় রাতের খাবার শেষে পাড়ায় বেড়াতে বেরোলাম। একটা রিকশা নিয়ে প্রথমেই আমার ছোট বোনের বাসায়। তারপর বড় আপার ওখানে। সব জায়গায় নানা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্তি এসে গেল। বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব প্রত্যুষে ঘুম ভাঙল। প্রথমদিকে চারদিক কেমন অপরিচিত মনে হলো। তখন ভোরের আলো কেবল ফুটছে।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
প্লেনে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি নিজের মনেই হাসছিলাম। হাসছিলাম এ ভেবে যে আমাদের পূর্বপুরুষরা কী করে এ ধরনের একটি অসম্ভব রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেছিলেন, যার দুই অংশের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুতে মিল নেই। এমনকি ধর্মেরও যে আনুষ্ঠানিকতা, সেটিও আমাদের চেয়ে অনেক ভিন্ন ওদের। যদি ধর্মই কোনো রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণ করতে পারে, তাহলে তো ইন্দোনেশিয়া থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত যত মুসলিম রাষ্ট্র আছে, সব মিলে এক দেশ হতো। যা হোক, এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঢাকায় পেঁৗছে গেছি তা লক্ষ করিনি। এয়ার হোস্টেসের সিটবেল্ট বাঁধার আহ্বানে প্লেনের ঘুলঘুলি দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমার শস্য-শ্যামল বাংলাদেশ। বুকটা ভরে গেল।
বুকটা যেমন আনন্দে ভরে গেল, চোখ দিয়ে তখন ঝরছে আনন্দাশ্রু। মন কেমন করা ভাবনা আমায় ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল যে আমি ফিরে এসেছি আমার দরিদ্র মায়ের কাছে। যত হতদরিদ্রই হোক, আমার মা তো বটে! যেন দুই হাত তুলে সন্তানকে আহ্বান করছে উদাত্ত কণ্ঠে। মরুভূমির দেশ থেকে ফিরে এলাম জলাভূমির দেশে। নিচে দেখা যাচ্ছে পদ্মা নদী। কত পুরনো কথা মনে পড়ে গেল এ নদীকে ঘিরে। এ নদীর ওপর দিয়ে কতবার যাওয়া-আসা করেছি, তার হিসেব দেওয়া মুশকিল। মনে পড়ল নৌকার দুলুনি, স্টিমারে খাওয়া, রাতের অন্ধকার ভেদ করে জেলেনৌকার কেরোসিন বাতি আর বিক্রমপুরের কোনো স্টেশনে যাত্রী এবং কুলিদের হৈচৈ। পিআইএর বোয়িং এসে নামল ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে। প্লেন থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখি, ভাইয়া হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। পরনে তাঁর পিআইএর ইউনিফরম। পিআইএর চাকরির সুবাদেই তিনি ওই ইউনিফরম পরে একেবারে বিমানের কাছ অবধি আসতে পেরেছিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের দেখে কারো মনে হওয়া সম্ভব ছিল না বোধ হয় যে এত দিন বাদে দুই ভাইয়ের দেখা। এ ছিল প্রায় প্রতিদিন সাক্ষাতের মতোই। তখন দুই পাকিস্তানে যাতায়াত করতে মালামাল পরীক্ষা করা হতো। কাস্টমস কর্তৃপক্ষই করত। একই দেশের দুই ভাগের মধ্যে যাতায়াত অথচ কাস্টমসের পরীক্ষার বিষয়টি আমার কাছে কেমন গোলমেলে লেগেছিল। এটাই যদি হয়, তাহলে আর ইমিগ্রেশনের অসুবিধা কোথায়? দুই বিভাগের দুই পাসপোর্ট হলেই হয়ে যায়।
আমি ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর ছোট্ট বাসাটিতে এসে উঠলাম। সেটি ছিল মগবাজারের নয়াটোলায়। খুবই সরু একটি গলির শেষ মাথায় একতলা বাসা। মাঝখানে একটি পাকা আঙিনা। কিন্তু নিজের দেশের বাসা তো? প্রচণ্ড আনন্দ লেগেছিল। সেখানে বসে এক পেয়ালা চা হাতে আমার প্রবাসজীবনের নানা গল্প শোনাতে লাগলাম ভাইয়াকে। ইতিমধ্যে আমার দু-তিনজন বন্ধু এসে হাজির। তারাও সানন্দে যোগ দিল এ আড্ডায়। অল্পক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে এলে মুড়ি বানানো হলো সরিষার তেল দিয়ে। তা খেতে খেতে আবারও গল্প চলতে লাগল। রাত ১০টায় রাতের খাবার শেষে পাড়ায় বেড়াতে বেরোলাম। একটা রিকশা নিয়ে প্রথমেই আমার ছোট বোনের বাসায়। তারপর বড় আপার ওখানে। সব জায়গায় নানা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্তি এসে গেল। বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব প্রত্যুষে ঘুম ভাঙল। প্রথমদিকে চারদিক কেমন অপরিচিত মনে হলো। তখন ভোরের আলো কেবল ফুটছে।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments