শেকড়ের ডাক-টিপাইমুখ থেকে ডারবান : কেবলই রাজনীতি by ফরহাদ মাহমুদ
বাংলাদেশের কোনো পূর্বানুমতি না নিয়ে ভারতের মণিপুর রাজ্য সরকার গত ২২ অক্টোবর টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ নিয়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের গণমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে দুটি দেশ যখন দীর্ঘ শৈত্যাবস্থা কাটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরকে দুই
দেশেরই বিশিষ্টজনরা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ একে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিলি্ল সফর এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরিত দুটি যৌথ ঘোষণারও লংঘন বলে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া এটি ঢাকায় স্বাক্ষরিত কাঠামোগত চুক্তিরও পরিপন্থী। অনেক বিশেষজ্ঞই এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী কেন পত্রপত্রিকা ও সংবাদ সংস্থাকে মৌখিক ও লিখিতভাবে বারবার বলে বেড়াচ্ছেন যে এতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। তিনি তো পানিসম্পদ বিষয়ের কোনো বিশেষজ্ঞও নন। যেখানে বিশেষজ্ঞরা যুক্তি এবং তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলছেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে এই বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেখানে তিনি কিছু খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরে কেন বারবার একই কথা বলে বেড়াচ্ছেন? তাঁর কথাবার্তা শুনলে এমনও মনে হতে পারে, তিনি বাংলাদেশের নয়, ভারতের স্বার্থরক্ষায়ই বড় বেশি উদগ্রীব! তাঁর নিয়োগ পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
আমাদের আরো একটি বিষয় বোধগম্য নয়, সরকারের মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা থাকতে, যিনি সাংবিধানিকভাবে জবাবদিহি করার জন্য কোথাও দায়বদ্ধ নন, এমন একজন অনির্বাচিত উপদেষ্টা কেন সরকারের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন? বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমরা তো আমাদের গালে স্পষ্ট চপেটাঘাত অনুভব করতে পারছি। উপদেষ্টা সাহেবের গালের ত্বকটা সম্ভবত একটু বেশি ভারী! এর আগে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে তিনি যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি কি তা বেমালুম ভুলে গেছেন? অথচ তিস্তার কারণে পুরো উত্তরাঞ্চল আজ মরতে বসেছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে খরা ও বন্যার প্রকোপ। কথায় বলে, 'মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না!' উপদেষ্টা সাহেব তার পরও ভারতপ্রেমে গদগদ হতে পারেন, কিন্তু আমরা তা পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, এসব উপদেষ্টার উপদেশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। তার পরিবর্তে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের উপযোগী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করুন। সংসদ ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আপনার নির্ভরতা বৃদ্ধি করুন। তা না হলে, অসময়ে এসব উপদেষ্টার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, তখন আপনাকে একাই সব কিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ ইতিহাস থেকে কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না, যেমন হারিয়ে যায়নি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আবার এ নিয়ে বিরোধী দলের হরতাল আহ্বান, লংমার্চ, গাড়ি ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ_এগুলোকেও আমরা সমর্থন করতে পারছি না। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও যে হারে লম্ফ-ঝম্ফ করছেন, তাতে তাঁরা লজ্জা অনুভব না করলেও আমরা সাধারণ বাংলাদেশিরা লজ্জা অনুভব করছি। কারণ মণিপুর রাজ্যের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ কাউন্সিল ১৯৮৪ সালে এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা পেশ করেছিল। তখন এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ভারতের বিদ্যুৎ আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পরিপত্রই জারি করা হয়। তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এ দেশের ক্ষমতায় ছিল। সেদিন তারা টুঁ শব্দটি না করে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন কেন? আর এখন হরতাল ডাকছেন কেন? আমরা বুঝতে পারি, এই হরতাল আহ্বান ও অপরাজনীতির পেছনে টিপাইমুখ যতটা না মুখ্য, বর্তমান সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মুখ্য। আর শাবাশ, ...পন্থী বুদ্ধিজীবীদের! আপনারা এখন পত্রপত্রিকায় ইনিয়ে-বিনিয়ে নিবন্ধের পর নিবন্ধ লিখে যাচ্ছেন, কিন্তু ২০০৩ সালে একটি নিবন্ধ লিখে নূ্যনতম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন কি? পেছনে তাকিয়ে কথা বলুন। বরং এমন অনেকে আছেন, যাঁরা সেদিনও প্রতিবাদ করেছিলেন এবং আজও প্রতিবাদ করছেন_তাঁরা কিন্তু হরতাল ডাকেন না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেরও চেষ্টা করেন না।
আমরা মনে করি, বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ ও ফুলের তলে জোড়া বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের নদী, ফসল, মানুষের জীবনযাত্রা ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অববাহিকায় ব্যাপকভিত্তিক জরিপ ও গবেষণা হলেই কেবল আমরা প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে পারব। এই যৌথ সমীক্ষায় তৃতীয় দেশকে বা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অথবা জাতিসংঘের নেতৃত্বে এমন একটি সমীক্ষা পরিচালনার জন্যও আমরা জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানাতে পারি। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকার ও বিরোধী দলের যে ভূমিকা আমরা দেখছি, তার কোনোটিই আমাদের কাছে সুস্থ মনে হয় না। কাম্য তো নয়ই।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও আমরা যত বেশি কথা বলছি, কাজে আমরা তত বেশি উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছি। ডারবান সম্মেলন থেকে ফিরে এসে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী কিছুটা হতাশাই ব্যক্ত করেছেন। কারণ সম্ভবত তিনি বড় বেশি আশাবাদী হয়ে পড়েছিলেন। রিও ডি জেনিরোর ধরিত্রী সম্মেলন, বালি সম্মেলন, কিয়োটো প্রটোকল ইত্যাদি নিয়ে আমাদের মধ্যেও অনেক বেশি প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিল। বাস্তবে যখন দেখছি, পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ না কমে বরং দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, তখন আমরাও হতাশ হয়েছিলাম বৈশ্বিক পরিবেশ নিয়ে উন্নত দেশগুলোর নোংরা রাজনীতি দেখে। কিয়োটো প্রটোকলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ডারবান সম্মেলনের প্রতিনিধিরা অনেক চেষ্টা করেছেন এবং অঙ্েিজন সিলিন্ডার দিয়ে কিছুটা হলেও আয়ু বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু তাতে লাভ কী? যে প্রটোকল কেউ মানে না, তার সময় বৃদ্ধি করেই বা কী লাভ? কানাডা তো প্রটোকল থেকে নিজেকে সরিয়েই নিল। আমেরিকা তো আগেই বাইরে। এদিকে বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো কেবল আন্তর্জাতিক সহায়তার দিবাস্বপ্নই দেখে যাচ্ছে, আর কেবলই হতাশ হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল পরিমাণ আবাদি ভূমি নোনাপানির অব্যাহত অনুপ্রবেশের কারণে ইতিমধ্যেই অনাবাদি হয়ে পড়েছে। আর তার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তায়। ১৯৯২ সালে সরকারের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি উপকূল রক্ষাবাঁধকে আরো উঁচু করার পরামর্শ দিয়েছিল। সে বাঁধ আজ পর্যন্ত উঁচু তো হয়ইনি, বরং সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের অংশগুলো সম্পূর্ণ মেরামতও করা যায়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নতুন করে পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়নি, যাতে জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলের নিরুপায় মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। বরং অতীতে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও ক্রমে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। খোদা না করুন, এ বছর যদি সিডর বা আইলার মতো আরেকটি জলোচ্ছ্বাস হয় কী অবস্থা হবে? নিঃসন্দেহে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। উপকূলের আবাদযোগ্য ভূমি এবং উপকূলবাসীদের জানমাল রক্ষায় আমরা কি কেবলই বিদেশি সাহায্যের জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকব? এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কি কিছুই করার নেই? থাকলে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি কেন? রাষ্ট্রীয় বাজেটে যেখানে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে প্রকল্প নিতে দেখা যায়, সেখানে উপকূল রক্ষাবাঁধ নির্মাণ নয়, মেরামতেও কেন পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা যায় না? বিদেশি সাহায্য যেটুকু আসে, তার সদ্ব্যবহার নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ যে ভয়াবহভাবে বিপজ্জনক এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিংবা অভিন্ন নদীগুলোতে ভারতের একতরফা কর্মকাণ্ড যে আমাদের ক্রমশ শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদরা সম্ভবত তা বিশ্বাস করেন না। সেটি পর্যায়ক্রমে সরকারি দলে থাকা নেতাদের বেলায় যেমন সত্য, বিরোধী দলে থাকা নেতাদের বেলায়ও সত্য। তাঁরা সুবিধাজনক মনে হলে এগুলো নিয়ে রাজনীতি করতেই বেশি অভ্যস্ত। এই মানসিকতা না বদলালে ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি এগোবে না, ধ্বংস বা ক্ষয়ক্ষতিও রোধ করা যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক
আমাদের আরো একটি বিষয় বোধগম্য নয়, সরকারের মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা থাকতে, যিনি সাংবিধানিকভাবে জবাবদিহি করার জন্য কোথাও দায়বদ্ধ নন, এমন একজন অনির্বাচিত উপদেষ্টা কেন সরকারের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন? বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমরা তো আমাদের গালে স্পষ্ট চপেটাঘাত অনুভব করতে পারছি। উপদেষ্টা সাহেবের গালের ত্বকটা সম্ভবত একটু বেশি ভারী! এর আগে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে তিনি যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি কি তা বেমালুম ভুলে গেছেন? অথচ তিস্তার কারণে পুরো উত্তরাঞ্চল আজ মরতে বসেছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে খরা ও বন্যার প্রকোপ। কথায় বলে, 'মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না!' উপদেষ্টা সাহেব তার পরও ভারতপ্রেমে গদগদ হতে পারেন, কিন্তু আমরা তা পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, এসব উপদেষ্টার উপদেশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। তার পরিবর্তে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের উপযোগী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করুন। সংসদ ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আপনার নির্ভরতা বৃদ্ধি করুন। তা না হলে, অসময়ে এসব উপদেষ্টার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, তখন আপনাকে একাই সব কিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ ইতিহাস থেকে কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না, যেমন হারিয়ে যায়নি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আবার এ নিয়ে বিরোধী দলের হরতাল আহ্বান, লংমার্চ, গাড়ি ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ_এগুলোকেও আমরা সমর্থন করতে পারছি না। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও যে হারে লম্ফ-ঝম্ফ করছেন, তাতে তাঁরা লজ্জা অনুভব না করলেও আমরা সাধারণ বাংলাদেশিরা লজ্জা অনুভব করছি। কারণ মণিপুর রাজ্যের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ কাউন্সিল ১৯৮৪ সালে এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা পেশ করেছিল। তখন এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ভারতের বিদ্যুৎ আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পরিপত্রই জারি করা হয়। তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এ দেশের ক্ষমতায় ছিল। সেদিন তারা টুঁ শব্দটি না করে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন কেন? আর এখন হরতাল ডাকছেন কেন? আমরা বুঝতে পারি, এই হরতাল আহ্বান ও অপরাজনীতির পেছনে টিপাইমুখ যতটা না মুখ্য, বর্তমান সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মুখ্য। আর শাবাশ, ...পন্থী বুদ্ধিজীবীদের! আপনারা এখন পত্রপত্রিকায় ইনিয়ে-বিনিয়ে নিবন্ধের পর নিবন্ধ লিখে যাচ্ছেন, কিন্তু ২০০৩ সালে একটি নিবন্ধ লিখে নূ্যনতম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন কি? পেছনে তাকিয়ে কথা বলুন। বরং এমন অনেকে আছেন, যাঁরা সেদিনও প্রতিবাদ করেছিলেন এবং আজও প্রতিবাদ করছেন_তাঁরা কিন্তু হরতাল ডাকেন না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেরও চেষ্টা করেন না।
আমরা মনে করি, বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ ও ফুলের তলে জোড়া বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের নদী, ফসল, মানুষের জীবনযাত্রা ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অববাহিকায় ব্যাপকভিত্তিক জরিপ ও গবেষণা হলেই কেবল আমরা প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে পারব। এই যৌথ সমীক্ষায় তৃতীয় দেশকে বা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অথবা জাতিসংঘের নেতৃত্বে এমন একটি সমীক্ষা পরিচালনার জন্যও আমরা জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানাতে পারি। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকার ও বিরোধী দলের যে ভূমিকা আমরা দেখছি, তার কোনোটিই আমাদের কাছে সুস্থ মনে হয় না। কাম্য তো নয়ই।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও আমরা যত বেশি কথা বলছি, কাজে আমরা তত বেশি উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছি। ডারবান সম্মেলন থেকে ফিরে এসে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী কিছুটা হতাশাই ব্যক্ত করেছেন। কারণ সম্ভবত তিনি বড় বেশি আশাবাদী হয়ে পড়েছিলেন। রিও ডি জেনিরোর ধরিত্রী সম্মেলন, বালি সম্মেলন, কিয়োটো প্রটোকল ইত্যাদি নিয়ে আমাদের মধ্যেও অনেক বেশি প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিল। বাস্তবে যখন দেখছি, পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ না কমে বরং দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, তখন আমরাও হতাশ হয়েছিলাম বৈশ্বিক পরিবেশ নিয়ে উন্নত দেশগুলোর নোংরা রাজনীতি দেখে। কিয়োটো প্রটোকলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ডারবান সম্মেলনের প্রতিনিধিরা অনেক চেষ্টা করেছেন এবং অঙ্েিজন সিলিন্ডার দিয়ে কিছুটা হলেও আয়ু বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু তাতে লাভ কী? যে প্রটোকল কেউ মানে না, তার সময় বৃদ্ধি করেই বা কী লাভ? কানাডা তো প্রটোকল থেকে নিজেকে সরিয়েই নিল। আমেরিকা তো আগেই বাইরে। এদিকে বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো কেবল আন্তর্জাতিক সহায়তার দিবাস্বপ্নই দেখে যাচ্ছে, আর কেবলই হতাশ হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল পরিমাণ আবাদি ভূমি নোনাপানির অব্যাহত অনুপ্রবেশের কারণে ইতিমধ্যেই অনাবাদি হয়ে পড়েছে। আর তার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তায়। ১৯৯২ সালে সরকারের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি উপকূল রক্ষাবাঁধকে আরো উঁচু করার পরামর্শ দিয়েছিল। সে বাঁধ আজ পর্যন্ত উঁচু তো হয়ইনি, বরং সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের অংশগুলো সম্পূর্ণ মেরামতও করা যায়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নতুন করে পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়নি, যাতে জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলের নিরুপায় মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। বরং অতীতে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও ক্রমে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। খোদা না করুন, এ বছর যদি সিডর বা আইলার মতো আরেকটি জলোচ্ছ্বাস হয় কী অবস্থা হবে? নিঃসন্দেহে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। উপকূলের আবাদযোগ্য ভূমি এবং উপকূলবাসীদের জানমাল রক্ষায় আমরা কি কেবলই বিদেশি সাহায্যের জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকব? এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কি কিছুই করার নেই? থাকলে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি কেন? রাষ্ট্রীয় বাজেটে যেখানে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে প্রকল্প নিতে দেখা যায়, সেখানে উপকূল রক্ষাবাঁধ নির্মাণ নয়, মেরামতেও কেন পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা যায় না? বিদেশি সাহায্য যেটুকু আসে, তার সদ্ব্যবহার নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ যে ভয়াবহভাবে বিপজ্জনক এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিংবা অভিন্ন নদীগুলোতে ভারতের একতরফা কর্মকাণ্ড যে আমাদের ক্রমশ শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদরা সম্ভবত তা বিশ্বাস করেন না। সেটি পর্যায়ক্রমে সরকারি দলে থাকা নেতাদের বেলায় যেমন সত্য, বিরোধী দলে থাকা নেতাদের বেলায়ও সত্য। তাঁরা সুবিধাজনক মনে হলে এগুলো নিয়ে রাজনীতি করতেই বেশি অভ্যস্ত। এই মানসিকতা না বদলালে ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি এগোবে না, ধ্বংস বা ক্ষয়ক্ষতিও রোধ করা যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক
No comments