অর্থনীতিতে হতাশার চিত্র-অব্যবস্থাপনার দায় সরকারেরই

সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগের হার, কর-জিডিপি অনুপাত, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, মূল্যস্ফীতির হার প্রভৃতি সূচক গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত বাংলাদেশে এসব সূচক কখনোই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় থাকে না। কেবল মাঝে মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুখে হাসি ফোটার কারণ ঘটে। যেমন ঘটেছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বছর দুয়েক আগে এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায়। রফতানি বাণিজ্য কখনও কখনও প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেলে বৈদেশিক সূত্র


থেকে আয় বাড়ে। প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিরাও দুই দশকের বেশি সময় ধরে রিজার্ভের প্রাণশক্তি হয়ে আছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা এবং জনশক্তির প্রধান বাজার মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বুধবার দক্ষিণ এশিয়া নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একাদশ বার্ষিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এ বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তার সংশয়_ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হবে কি-না। তিনি অবশ্য স্বল্প মেয়াদে নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে যেসব সমস্যা বিরাজ করছে তা সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, এক দশক ধরেই বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৪ শতাংশের কাছাকাছি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করতে হলে এ চিত্র বদলাতেই হবে অর্থাৎ বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গও টেনেছেন। এর অন্যতম কারণ বিশ্ববাজারে অনেক ধরনের পণ্যমূল্য বৃদ্ধি। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের জন্য চরম দুর্ভোগ ডেকে আনছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ওপেন সিক্রেট এবং তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সময়মতো শুরু করা গেলে ২৩০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তা মিলত এবং তাতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে শুধু নয়, সার্বিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজে অচলাবস্থার প্রধান দায় সরকারেরই। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের প্রচুর ধারও সমস্যা সৃষ্টি করছে। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এর প্রভাবেও বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত থামাতে না পারা যে সরকারের ব্যর্থতার তালিকার শীর্ষে সেটা সরকার কতটা বুঝতে পারছে স্পষ্ট নয়, কিন্তু জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে যথেষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে এবং বহু বছর ধরে তা চললেও পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কোনো সরকারের আমলেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিনবদলের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের আমলেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। সরকারি প্রকল্পের কোনো কোনোটিতে সীমাহীন দুর্নীতি ঘটে এবং এ সুযোগ থাকার কারণেই শাসক দল ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাজ বাগিয়ে নিতে বেপরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরা লক্ষ্য করি। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা আমরা দূর করতে পারব না ঠিকই, কিন্তু আমরা নিজেদের ঘর কিছুটা হলেও গুছিয়ে নিতে পারি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভালো করার অবকাশ রয়েছে। অর্থমন্ত্রী সমস্যার কথা বলেছেন। এখন তা থেকে উত্তরণের জন্য চাই কাজ। তা করতে ব্যর্থ হলে মানুষের কষ্ট বাড়তে থাকবে, মহাজোট সরকারের রাজনৈতিক ভবিষ্যতেও তা ফেলবে বিরূপ প্রভাব।

No comments

Powered by Blogger.