আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করতে হবে by ড. এ এফ ইমাম আলী

দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং গণতন্ত্রের বিকাশ, সহিংস হরতাল বন্ধসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ রাজনৈতিক দলগুলোকে বের করার তাগিদ দিয়েছেন।


তিনি এ-ও বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করাই শ্রেয়। আমরা যারা শান্তিপ্রিয় এবং দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা চাই, তারাও মনে করি, গণতন্ত্রমনা কোনো রাজনৈতিক দলই নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থকরণে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে না, যা দেশ ও জাতির অগ্রগতি ব্যাহত করে। কিন্তু অতীত আমাদের মনে রাখতে হবে এবং সংলাপে বসতে হলে আগে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। গণতন্ত্রের মর্মবাণী ধারণ করার শক্তি অর্জন করতে হবে। এই মানলে কিংবা এই না মানলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না- এসব ভাষা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো অবস্থায়ই সমর্থনযোগ্য নয়। যদি কৌশলগত চিন্তাভাবনাই মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে কোনো সৎ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ দেশ স্বাধীন করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা শাণিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তা বিনষ্ট করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে দাবিদার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল মা ও মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছিল একাত্তরে এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শরিক হয়েছিল, তাদের নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বলছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে সংলাপ করার অর্থ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের যে বিচার চলছে, সেই প্রক্রিয়া নস্যাৎ করা। আজ যখন আগামী নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে তারা কথা বলছে, তখন যেন স্পষ্টতই ওই বিরুদ্ধবাদী শক্তির স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি সব কিছু ছাপিয়ে তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে। ১৫ আগস্ট যাঁরা আনন্দ-উৎসব করেন, তাঁদের কথা বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা দরকার। স্বাধীনতার প্রকৃত পক্ষশক্তির সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা ধারণ করে দুর্নীতিমুক্ত, প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সংগ্রাম জোরদার করতে হবে। আদালতের রায়ে নির্বাচনপদ্ধতির বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আমরা যদি লক্ষ করি, এ সরকারের শাসনামলে যত নির্বাচন হয়েছে, সব কয়টা নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত থেকেই নির্বাচন কমিশন সফলভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছে। বিএনপি বলছে, সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে, নির্বাচনগুলোর ফলাফল তা-ই বলে। তাদের এ বক্তব্য থাকতেই পারে। এই বক্তব্য গণতান্ত্রিক রাজনীতিরই ভাষা। ক্ষমতাসীনরা তাদের পক্ষে রায় নেওয়ার কূটকৌশল কিন্তু করেনি। যদি করত, তাহলে তাদের প্রার্থীরা হেরে যেতেন না। খুব সাদামাটা হিসাব এটি। অতীতে এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে কি না হয়েছে। সেই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কী ছিল? সেটি নিশ্চয়ই বিএনপি কিংবা তাদের সমমনারা ভুলে যায়নি। দেশের যেকোনো সমস্যার সমাধান মানে রাজপথ দখল করে বসে থাকা নয় কিংবা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা নয়, যাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। অথচ তা-ও হয়েছে এবং হচ্ছে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দেশের রাজনীতিকে কারা, কিভাবে শ্রীহীন করেছে, নির্বাচনকে কারা কলুষিত করেছে- সেসব তো সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। বিরোধী জোট যেসব শর্ত আরোপ করে সংলাপে বসার ইচ্ছা কখনো কখনো প্রকাশ করে, এর পরিপ্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রে অন্য 'কিন্তু'ও দাঁড়ায়। এই 'কিন্তু'টাও সচেতন মানুষ মাত্রই বোঝেন। সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় সংসদে আলোচনাক্রমে পথ বের করাই শ্রেয়। গণতন্ত্রে বলপ্রয়োগের কিংবা পেশিশক্তি প্রদর্শনের ভাষা পরিত্যাজ্য। আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেক তিক্ত এবং আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা সে পথ আর মাড়াতে চাই না। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠককালে খালেদা জিয়া যেসব কথা বলেছেন, বাস্তবে দেখি আমরা ভিন্ন কিছু। প্রণব মুখার্জিও সংলাপের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি, যাদের পরিচয় একাত্তর ও এর পূর্বাপর অধ্যায়ে অত্যন্ত ঘৃণার, নিন্দার এবং বীভৎস- তাদের সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যক্ত প্রত্যয় কি স্ববিরোধিতা নয়? সর্বাগ্রে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা ধারণ করে লক্ষ্য স্থির করা। অগণতান্ত্রিক কিংবা ফ্যাসিবাদী শক্তি গণতন্ত্রের মিত্র হতে পারে না। কারণ দেশের বর্তমান রাজনীতির সংকট কিন্তু অনেকটাই সে প্রসঙ্গকেন্দ্রিক। কাজেই সংলাপের প্রসঙ্গ এলেই সেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গেই সামনে আসে।
গ্রন্থনা : দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

No comments

Powered by Blogger.