এক মাসে প্রতি কেজিতে লবণের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ-প্যাকেটে পুরলেই লবণের দাম অস্বাভাবিক! by আবুল হাসনাত

এক মাস আগে কনফিডেন্স, এসিআই, মোল্লা সল্ট, ইফাদসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক কেজি আয়োডিনযুক্ত প্যাকেটজাত লবণের দাম ছিল ২৫ থেকে ২৭ টাকা। আর এখন সেই লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকায়। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক মাসে প্রতি কেজিতে লবণের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।


আর এক বছরে দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। গত বছর এই সময় প্যাকেটজাত লবণের কেজি ছিল ২০ টাকা। অবশ্য কিছু প্যাকেটজাত লবণ ১৫ থেকে ২০ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে। এসব লবণ মূলত গ্রাম ও মফস্বল শহরেই বেশি বিক্রি হয়।
লবণের দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে কক্সবাজারের চাষিরা প্রতি কেজি অবিচূর্ণ লবণ ছয় টাকা ২৫ পয়সা থেকে ছয় টাকা ৭৫ পয়সায় বিক্রি করছেন। পরিবহন, চূর্ণ করা, আয়োডিনযুক্ত ও প্যাকেটজাত করতে প্রতি কেজিতে খরচ হচ্ছে পাঁচ টাকা। সব মিলিয়ে এক কেজি প্যাকেটজাত লবণে খরচ পড়ে ১১ টাকা ৭৫ পয়সা। এই লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকায়।
কক্সবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এপ্রিলের শুরু থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত চাষিরা মিলমালিকদের কাছে প্রতি বস্তা (৮০ কেজি) লবণ বিক্রি করেন ৪৬৮ থেকে ৫০৬ টাকায়। তবে গতকাল মঙ্গলবার প্রতি বস্তা লবণ বিক্রি হয় ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। যদিও কয়েকজন মিলমালিক গতকাল দাবি করেছেন, কক্সবাজার থেকে তাঁরা ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় এক বস্তা লবণ কিনছেন।
কক্সবাজার থেকে লবণ এনে আয়োডিনযুক্ত ও প্যাকেটজাত করার ব্যয় জানতে চাইলে লবণ মিলমালিক সমিতির সাবেক সহসভাপতি কোহিনূর ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, কক্সবাজার থেকে প্রতি বস্তা লবণ পরিবহনে ১৩০ টাকা, ট্রাকে ওঠানো-নামানোয় আট থেকে ১০ টাকা, লবণ চূর্ণ করতে ৪০, আয়োডিন মেশাতে ১০ এবং প্রতি কেজি প্যাকেটজাত করতে দুই থেকে আড়াই টাকা খরচ হয়। এই হিসাব অনুযায়ী, এক কেজি লবণ আয়োডিনযুক্ত ও প্যাকেটজাত করতে খরচ হয় পাঁচ টাকা।
কোহিনূর ইসলাম জানান, এর বাইরে প্রতি বস্তা অবিচূর্ণ লবণ প্রক্রিয়াজাত করতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় হয়। সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদ, সারা বছরের শ্রমিকের মজুরি, যন্ত্রপাতি পরিচালনব্যয়, প্রকৌশলীদের বেতন, বিজ্ঞাপনব্যয় যোগ করেই প্যাকেটজাত লবণের দাম নির্ধারণ করা হয়।
বিসিকের পরিচালক (প্রকল্প) আবু সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজেদের সুবিধার জন্য মিলমালিকেরা নানা রকম কথা বলেন। কিন্তু সাত টাকা দিয়ে লবণ কিনে তা ২৭ টাকায় বিক্রি করেন। ব্র্যাক যদি ১৩ টাকায় মানসম্মত লবণ খাওয়াতে পারে, তাঁরা কেন পারবেন না।’ তিনি বলেন, চাষিদের কাছ থেকে কিনে প্রক্রিয়াজাত করতে লবণের দামসহ মিলমালিকদের সাড়ে ১১ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ লবণ মিলমালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মোনাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় মিলগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের লবণ প্যাকেটজাত করা হয়। সে কারণে উৎপাদন খরচও অনেক বেশি। তারা যে লবণের বেশি দাম নিয়ে অনেক টাকা কামাচ্ছে সেটা বলা যাবে না।’
আমদানির উদ্যোগ: বিসিক চলতি বছর ১৪ লাখ ৩৭ হাজার টন লবণের চাহিদা ঠিক করে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে। সে হিসাবে লবণ চাষ হয়। তাদের হিসাবে, ৪ মে পর্যন্ত ১১ লাখ ৩৫ হাজার টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। গত বছরের দুই লাখ টন মজুদসহ সব মিলিয়ে লবণের মজুদ এখন ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। ১৫ মে উৎপাদন মৌসুম শেষ হওয়া পর্যন্ত লবণের মজুদের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ১৩ লাখ টনে। এক লাখ টন লবণের ঘাটতি হতে পারে।
তবে মিলমালিকেরা এই হিসাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দাবি করেছেন, দেশে লবণের চাহিদা (শিল্পে ব্যবহারসহ) ১৮ লাখ টন। তাঁদের দাবি, এখন পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ টন। আর আগের বছরের মজুদ আছে ৫০ হাজার টন। তাঁদের হিসাবে চার লাখ টন লবণের সংকট হবে। সে কারণে ৮ এপ্রিল চার লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে মিলমালিকদের সমিতি।
এ বিষয়ে বিসিকের পরিচালক (প্রকল্প) আবু সাদেক বলেন, ‘লবণ চাহিদা ও উৎপাদনের পরিমাণ সম্পর্কে সরেজমিনে প্রতি সপ্তাহে খোঁজ নিতে কক্সবাজার, টেকনাফ ও কুতুবদিয়ায় আমাদের ১৩টি কার্যালয় রয়েছে। কী পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে তা জানার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আমাদের আছে। তারা (মিলমালিকেরা) কিসের ভিত্তিতে হিসাব দেয়।’
টেকনাফ লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শফিক মিয়া বলেন, ‘ঢাকার একটি প্রভাবশালী চক্র দেশে লবণ-সংকটের দোহাই দিয়ে ভারত থেকে চার লাখ টন লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে। সরকার যদি লবণ আমদানির অনুমতি দেয়, তাহলে কক্সবাজারে লবণ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পথে বসবে।’
তবে বিসিকের একটি সূত্র বলছে, যেহেতু এক লাখ টন লবণের সংকট রয়েছে। তাই আরও দুই লাখ টন মিলিয়ে তিন লাখ টন লবণ আমদানি করা যেতে পারে। কিন্তু তা এখন লবণের মৌসুমে নয়। দেশে চার মাসের লবণ মজুদ থাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত মাস দুয়েক পর আমদানির অনুমতি দেওয়া।
মিলমালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মোনাফ বলেন, বর্তমান শুল্ক কাঠামোয় ভারত থেকে প্রতি বস্তা লবণ আমদানি করলে ৫০০ টাকার বেশি খরচ হবে না। অবিচূর্ণ লবণ আমদানি হলে দেশেও প্যাকেটজাত লবণের দাম কমে আসবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার আব্দুল কুদ্দুস]

No comments

Powered by Blogger.