ভাষা আন্দোলন-তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে-গ্রন্থনা: সিমিন হোসেন রিমি
২১.২.৫২ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশাল জনসমাবেশ। মেডিকেল কলেজ ও অ্যাসেম্বলি হলের কাছে এইমাত্র (বেলা সোয়া দুইটার দিকে) পুলিশের টিয়ার গ্যাস ছোড়ার বিষয়ে লোকজন বলাবলি করছিল। ডা. করিম ও আমি মেডিকেল কলেজে গেলাম।
পুলিশের গুলিতে আহত ও নিহতদের মৃতদেহ দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। ডা. করিম চলে গেলেন। আমি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ইতস্তত ঘোরাফেরা করে রাত ১১টায় যোগীনগরে ফিরে এলাম।
রাত সাড়ে তিনটায় পুলিশ বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করল এবং যুবলীগের অফিসে তল্লাশি চালাল। তারা ক্ষতিকর বা অবৈধ কিছু খুঁজে পেল না। যুবলীগের অফিস-লাগোয়া আমার শোয়ার ঘর। তাই আমি ঘর থেকে সরে পড়ায় তারা আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ভোর চারটায় তারা চলে গেল।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলছে। গতকাল থেকে এক মাসের জন্য সিআর পিসি ১৪৪ ধারা (ক্রিমিনাল পেনাল) জারি করা হয়েছে। আজ বিকেলে অ্যাসেম্বলি বসেছিল। ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেম্বলি হাউসের কাছে জড়ো হয়, যাতে তাদের কণ্ঠ অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএরা শুনতে পান।
প্রথমে শুরু হলো গ্রেপ্তার। এরপর ছোড়া হলো কাঁদানে গ্যাস। এরপর গুলি চালানো হলো মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে। গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরও শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।
২২.২.৫২
সকাল ছয়টার দিকে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে গেলাম। অলি আহাদকে গত রাতের তল্লাশি অভিযান সম্পর্কে অবহিত করলাম।
সাইকেলে করে জনতা ও পুলিশের তত্পরতার বিভিন্ন দৃশ্য ঘুরে দেখলাম। যোগীনগরে ফিরলাম বেলা একটায়। বিকেল সাড়ে তিনটায় আবার বাইরে বের হলাম। মূল সড়ক ধরে এগোলাম। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ছিলাম বিকেল থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।
ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সোয়া আটটা পর্যন্ত ছাত্রদের একটি সভায় সভাপতিত্ব করলাম। অলি আহাদের সাইকেলের পেছনে চড়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে গেলাম।
আজ সকাল ১০টার দিকে জনসন রোডে মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু।
আজ রাতেও পুলিশ আমাদের বাড়িতে অভিযান চালাল। প্রতিটি কক্ষ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তল্লাশি করল। আমি তাদের নজর থেকে (রাত সাড়ে তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত) পালাতে সক্ষম হই।
২৩.২.৫২
সকাল আটটায় বের হলাম। ক্যাম্ব্রিজ ফার্মেসি থেকে ডা. করিমের সাইকেল নিয়ে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের উদ্দেশে রওনা হলাম। লিফলেট নিলাম। লিফলেট বিতরণ করলাম স্টেশনে, নারিন্দা, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি থেকে নবাব গেট পর্যন্ত। তারপর মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে ফিরে এলাম।
নাজিরাবাজার লেভেল ক্রসিংয়ে ঢাকার জনতার ওপর লাঠিচার্জ। তিনজন আহত। বিচ্ছিন্নভাবে গ্রেপ্তারের ঘটনা ছাড়া আর কোনো ঘটনা বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত। ২১.২.৫২ তারিখ থেকে নগরীতে কোনো যানবাহন চোখে পড়ছে না। এমনকি একটি সাইকেল পর্যন্ত না। ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল বেলা একটা পর্যন্ত।
২৪.২.৫২
সকাল সাড়ে সাতটায় স্যানিটারি অফিসের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়ো হওয়া কয়েক শ লোকের সমাবেশে বক্তৃতা করলাম আধঘণ্টা ধরে। আসন্ন অনিবার্য আন্দোলনের ব্যাপারে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে এলাম এবং সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থাকলাম।
সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন এবং সিভিল লিবার্টিস কো-অর্ডিনেটিং কমিটির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হলো। সভা চলল বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমেদ, আবুল হাশিম, এম জি হাফিজ, জহিরুদ্দিন মোশতাক, শামসুল হক, কে জি গোলাম মাহবুব, খয়রাত হোসেন, অলি আহমেদ খান, আনোয়ারা খাতুন, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন, অলি আহাদ, তোয়াহা, গোলাম মওলা এবং আরও অনেকে এতে উপস্থিত ছিলেন।
সভায় ২৫.২.৫২ তারিখে সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এবং তা সমর্থন ও অনুমোদন পেল। রাতে সিরাজের বাড়িতে থাকলাম।
আজ গ্রেপ্তারের কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া আর কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হলো। শুধু অল্পসংখ্যক রিকশা, সাইকেল ও প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করেছে। বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। নবাবপুর ও ইসলামপুরে অবাঙালি মালিকানাধীন দোকানগুলো আংশিক খোলা ছিল।
সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী পুরো মাত্রায় টহল দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। আজ রাত আটটা থেকে আগামীকাল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে।
২৫.২.৫২
সকাল আটটায় বের হলাম। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে গেলাম। বেলা ১১টায় বার লাইব্রেরিতে গেলাম। কামরুদ্দীন আহমেদের কাছ থেকে খবরাখবর নিলাম। আতাউর রহমান খান, জহির, জমির প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন (আতাউর রহমান খান প্রমুখের গ্রেপ্তার হওয়ার গুজবের কথা শোনা গিয়েছিল)। দুপুর ১২টার দিকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ফিরে এলাম।
সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন ও সিভিল লিবার্টিস কো-অর্ডিনেটিং কমিটির যৌথসভা হলো বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আতাউর রহমান খান এতে সভাপতিত্ব করলেন। কামরুদ্দীন আহমেদ, এস হক, মোশতাক, এস এ রহিম, এম এস হক, রেলওয়ের কে এম হাই, এমএলএ শামসুদ্দিন এবং আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
সিদ্ধান্তসমূহ—
(১) ২৬.২.৫২ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার,
(২) নূরুল আমিনের কাছে নয় দফা দাবির আলটিমেটাম,
(৩) ৫ মার্চ শহীদ দিবসে সাধারণ ধর্মঘট,
(৪) ছাত্রদের ধর্মঘট অব্যাহত রাখা।
শ্রীপুর থেকে ১৫ টাকা নিয়ে ইসলাম আহমেদ এলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় লিফলেটসহ আমি তাঁকে স্টেশনে পৌঁছে দিলাম।
সাধারণ ধর্মঘট চলছে। রেল চলাচল ও সচিবালয়ে যোগদান ছাড়া প্রতিটি স্তরেই নজিরবিহীন সফলতা। মিছিল করার কোনো নির্দেশনা না থাকলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা হয়েছে। ঢাকার প্রধান সড়ক প্রায় ১০ হাজার লোকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। বিকেলে জনতা এস এম হলের সামনে সমবেত হয়। বাবুপুরা ওপির কাছে সাতজনের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। ১৪৪ ধারা মানার বিষয়টি কেউ আমলে আনেনি। সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী ১৪৪ ধারা বলবত্ করতে হতাশাপূর্ণভাবে ব্যর্থ হলো। প্রতিটি সড়কে হাজার হাজার মানুষের ঢল দেখা গেল। নগরী চলে এল জনগণের আয়ত্তে। তবে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল না। ছিল শুধু নূরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধের প্রকাশ।
গত রাতে আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মনোরঞ্জন ধর, গোবিন্দলাল ব্যানার্জি এমএলএ গ্রেপ্তার হয়েছেন।
নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আজ বিকাল তিনটায় অ্যাসেম্বলি অধিবেশন বসার কথা থাকলেও, নাটকীয়ভাবে গভর্নর অধিবেশন স্থগিত করলেন।
ভোরে ঠিক সূর্য ওঠার মুহূর্তে সামরিক বাহিনী ফজলুল হক মুসলিম হলে ঢুকে পড়ে এবং বল-প্রয়োগে হল থেকে মাইক কেড়ে নেয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটে জগন্নাথ কলেজ ছাত্রাবাসেও।
সকাল ১০টার দিকে সামরিক বাহিনী এসএম হলে ঢুকে পড়ে এবং চেষ্টা করে তাদের মাইক কেড়ে নিতে। প্রভোস্টের মধ্যস্থতায় তারা দুই ঘণ্টা পর হলের বাইরে বেরিয়ে আসে এই শর্তে যে, মাইকের বিষয়টি প্রভোস্ট দেখবেন এবং মাইক চালানো যাবে না। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত রাত ১০টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ বলবত্ থাকল।
[২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডায়েরির বাকি অংশ ছাপা হবে আগামীকাল]
রাত সাড়ে তিনটায় পুলিশ বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করল এবং যুবলীগের অফিসে তল্লাশি চালাল। তারা ক্ষতিকর বা অবৈধ কিছু খুঁজে পেল না। যুবলীগের অফিস-লাগোয়া আমার শোয়ার ঘর। তাই আমি ঘর থেকে সরে পড়ায় তারা আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ভোর চারটায় তারা চলে গেল।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলছে। গতকাল থেকে এক মাসের জন্য সিআর পিসি ১৪৪ ধারা (ক্রিমিনাল পেনাল) জারি করা হয়েছে। আজ বিকেলে অ্যাসেম্বলি বসেছিল। ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেম্বলি হাউসের কাছে জড়ো হয়, যাতে তাদের কণ্ঠ অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএরা শুনতে পান।
প্রথমে শুরু হলো গ্রেপ্তার। এরপর ছোড়া হলো কাঁদানে গ্যাস। এরপর গুলি চালানো হলো মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে। গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরও শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।
২২.২.৫২
সকাল ছয়টার দিকে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে গেলাম। অলি আহাদকে গত রাতের তল্লাশি অভিযান সম্পর্কে অবহিত করলাম।
সাইকেলে করে জনতা ও পুলিশের তত্পরতার বিভিন্ন দৃশ্য ঘুরে দেখলাম। যোগীনগরে ফিরলাম বেলা একটায়। বিকেল সাড়ে তিনটায় আবার বাইরে বের হলাম। মূল সড়ক ধরে এগোলাম। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ছিলাম বিকেল থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।
ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সোয়া আটটা পর্যন্ত ছাত্রদের একটি সভায় সভাপতিত্ব করলাম। অলি আহাদের সাইকেলের পেছনে চড়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে গেলাম।
আজ সকাল ১০টার দিকে জনসন রোডে মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু।
আজ রাতেও পুলিশ আমাদের বাড়িতে অভিযান চালাল। প্রতিটি কক্ষ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তল্লাশি করল। আমি তাদের নজর থেকে (রাত সাড়ে তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত) পালাতে সক্ষম হই।
২৩.২.৫২
সকাল আটটায় বের হলাম। ক্যাম্ব্রিজ ফার্মেসি থেকে ডা. করিমের সাইকেল নিয়ে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের উদ্দেশে রওনা হলাম। লিফলেট নিলাম। লিফলেট বিতরণ করলাম স্টেশনে, নারিন্দা, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি থেকে নবাব গেট পর্যন্ত। তারপর মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে ফিরে এলাম।
নাজিরাবাজার লেভেল ক্রসিংয়ে ঢাকার জনতার ওপর লাঠিচার্জ। তিনজন আহত। বিচ্ছিন্নভাবে গ্রেপ্তারের ঘটনা ছাড়া আর কোনো ঘটনা বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত। ২১.২.৫২ তারিখ থেকে নগরীতে কোনো যানবাহন চোখে পড়ছে না। এমনকি একটি সাইকেল পর্যন্ত না। ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল বেলা একটা পর্যন্ত।
২৪.২.৫২
সকাল সাড়ে সাতটায় স্যানিটারি অফিসের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়ো হওয়া কয়েক শ লোকের সমাবেশে বক্তৃতা করলাম আধঘণ্টা ধরে। আসন্ন অনিবার্য আন্দোলনের ব্যাপারে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে এলাম এবং সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থাকলাম।
সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন এবং সিভিল লিবার্টিস কো-অর্ডিনেটিং কমিটির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হলো। সভা চলল বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমেদ, আবুল হাশিম, এম জি হাফিজ, জহিরুদ্দিন মোশতাক, শামসুল হক, কে জি গোলাম মাহবুব, খয়রাত হোসেন, অলি আহমেদ খান, আনোয়ারা খাতুন, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন, অলি আহাদ, তোয়াহা, গোলাম মওলা এবং আরও অনেকে এতে উপস্থিত ছিলেন।
সভায় ২৫.২.৫২ তারিখে সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এবং তা সমর্থন ও অনুমোদন পেল। রাতে সিরাজের বাড়িতে থাকলাম।
আজ গ্রেপ্তারের কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া আর কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হলো। শুধু অল্পসংখ্যক রিকশা, সাইকেল ও প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করেছে। বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। নবাবপুর ও ইসলামপুরে অবাঙালি মালিকানাধীন দোকানগুলো আংশিক খোলা ছিল।
সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী পুরো মাত্রায় টহল দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। আজ রাত আটটা থেকে আগামীকাল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে।
২৫.২.৫২
সকাল আটটায় বের হলাম। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে গেলাম। বেলা ১১টায় বার লাইব্রেরিতে গেলাম। কামরুদ্দীন আহমেদের কাছ থেকে খবরাখবর নিলাম। আতাউর রহমান খান, জহির, জমির প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন (আতাউর রহমান খান প্রমুখের গ্রেপ্তার হওয়ার গুজবের কথা শোনা গিয়েছিল)। দুপুর ১২টার দিকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ফিরে এলাম।
সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন ও সিভিল লিবার্টিস কো-অর্ডিনেটিং কমিটির যৌথসভা হলো বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আতাউর রহমান খান এতে সভাপতিত্ব করলেন। কামরুদ্দীন আহমেদ, এস হক, মোশতাক, এস এ রহিম, এম এস হক, রেলওয়ের কে এম হাই, এমএলএ শামসুদ্দিন এবং আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
সিদ্ধান্তসমূহ—
(১) ২৬.২.৫২ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার,
(২) নূরুল আমিনের কাছে নয় দফা দাবির আলটিমেটাম,
(৩) ৫ মার্চ শহীদ দিবসে সাধারণ ধর্মঘট,
(৪) ছাত্রদের ধর্মঘট অব্যাহত রাখা।
শ্রীপুর থেকে ১৫ টাকা নিয়ে ইসলাম আহমেদ এলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় লিফলেটসহ আমি তাঁকে স্টেশনে পৌঁছে দিলাম।
সাধারণ ধর্মঘট চলছে। রেল চলাচল ও সচিবালয়ে যোগদান ছাড়া প্রতিটি স্তরেই নজিরবিহীন সফলতা। মিছিল করার কোনো নির্দেশনা না থাকলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা হয়েছে। ঢাকার প্রধান সড়ক প্রায় ১০ হাজার লোকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। বিকেলে জনতা এস এম হলের সামনে সমবেত হয়। বাবুপুরা ওপির কাছে সাতজনের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। ১৪৪ ধারা মানার বিষয়টি কেউ আমলে আনেনি। সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী ১৪৪ ধারা বলবত্ করতে হতাশাপূর্ণভাবে ব্যর্থ হলো। প্রতিটি সড়কে হাজার হাজার মানুষের ঢল দেখা গেল। নগরী চলে এল জনগণের আয়ত্তে। তবে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল না। ছিল শুধু নূরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধের প্রকাশ।
গত রাতে আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মনোরঞ্জন ধর, গোবিন্দলাল ব্যানার্জি এমএলএ গ্রেপ্তার হয়েছেন।
নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আজ বিকাল তিনটায় অ্যাসেম্বলি অধিবেশন বসার কথা থাকলেও, নাটকীয়ভাবে গভর্নর অধিবেশন স্থগিত করলেন।
ভোরে ঠিক সূর্য ওঠার মুহূর্তে সামরিক বাহিনী ফজলুল হক মুসলিম হলে ঢুকে পড়ে এবং বল-প্রয়োগে হল থেকে মাইক কেড়ে নেয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটে জগন্নাথ কলেজ ছাত্রাবাসেও।
সকাল ১০টার দিকে সামরিক বাহিনী এসএম হলে ঢুকে পড়ে এবং চেষ্টা করে তাদের মাইক কেড়ে নিতে। প্রভোস্টের মধ্যস্থতায় তারা দুই ঘণ্টা পর হলের বাইরে বেরিয়ে আসে এই শর্তে যে, মাইকের বিষয়টি প্রভোস্ট দেখবেন এবং মাইক চালানো যাবে না। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত রাত ১০টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ বলবত্ থাকল।
[২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডায়েরির বাকি অংশ ছাপা হবে আগামীকাল]
No comments