রাজনীতি-ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ হবে আত্মঘাতী by জাহিদ হাসান চৌধুরী

বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তার সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হচ্ছে, কোনো সমস্যার মূল কারণগুলো উত্পাটনের চেষ্টা না করে একটি অস্থায়ী ও প্রায়ই হঠকারী সমাধানে যাওয়া, যার জন্য জনসমর্থন থাকে বিপুল। মাথাব্যথা তো মাথা কেটে ফেল। এমন টোটকা সমাধান কালের কোনো এক ক্রান্তিলগ্নে হয়তো কাজে লেগে যায়,


কিন্তু এমনতর টোটকা কোনোভাবেই কোনো সভ্য সমাজে কাম্য সমাধান হতে পারে না। যেমন ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ। কিন্তু ক্রসফায়ার বন্ধ করতে পারেনি হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিকে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিশাল উন্নয়ন হয়েছে, এমন দাবি বোধহয় কেউ করবেন না।
তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি নিয়ে জাতি এ মুহূর্তে রীতিমতো বেসামাল। এ মুহূর্তে বলা ভুল হবে। দুই দশক ধরেই সরকারি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীদের দাপটে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রীতিমতো অসহায়। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, সিট দখলের রাজনীতি তো আছেই; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের বাণিজ্য—ভর্তি, নির্মাণ, উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি। জনগণ রীতিমতো অতিষ্ঠ এবং এর শেষ দেখতে চায়। গত কয়েক দিনে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক ছাত্রহত্যার ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেলে মেধাবী ও নিরীহ ছাত্র আবু বকরের মৃত্যু ছাত্ররাজনীতির বিষয়টিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া হলো ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এমনটি হতেই পারে’। এক দিন যেতে না যেতেই রাজশাহীতে ইসলামী ছাত্রশিবির নৃশংসভাবে কুপিয়ে একজনকে হত্যা করে এবং বহু ছাত্রকে মারাত্মক আহত করে। তার পরদিনই চট্টগ্রামে আরেকজন ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে জানান যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ও আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের একটি রংবিহীন দল, বহুবার, বিশেষ করে এই দশকের প্রথম দিকে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছি: কীভাবে ছাত্ররাজনীতি একটি পেশা হলো, কেন ও কীভাবে শিক্ষকরাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জ্ঞানচর্চা কমিয়ে ক্ষমতাচর্চায় সবাইকে উত্সাহিত করছে, সন্ত্রাসকে কারা মদদ দিচ্ছে, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আবার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে রূপান্তর করা যাবে ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে প্রথম আলো জনমানুষের প্রতিক্রিয়া ছাপাচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং পাশাপাশি বেশির ভাগ কলামিস্ট নানাভাবে ছাত্ররাজনীতির তদন্ত করছেন। বেশির ভাগের রায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। যেমন কবি সুমন রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সওয়াল করছেন, ‘পিত্তে পাথর হলে পিত্ত কেটে ফেলাই চিকিত্সা। বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতি এখন আর মাথার সমস্যা নয়, পিত্তের সমস্যা।’ অত্যন্ত সুলিখিত সুমনের লেখাটিতে উল্লিখিত প্রতিটি সমস্যার বর্ণনার সঙ্গে আমি একেবারেই একমত। কিন্তু সমস্যা হলো তাঁর বা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধবাদীদের দেওয়া সমাধানে। প্রথমত বলা উচিত, পিত্তে পাথর হলেই পিত্ত কেটে ফেলা হয় না। প্রথমে ওষুধ দিয়ে পাথর গলানোর চেষ্টা হয়। পিত্ত কেটে ফেললেই সমস্যার সমাধান হয়, তাও ঠিক নয়। ৫ থেকে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা হয় এবং ২০ শতাংশ ক্রনিক ডায়রিয়ায় ভোগে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ডায়রিয়া কমার চেয়ে ক্রনিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উত্তরটা দেওয়ার আগে ক্ষমতা প্রত্যয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
ক্ষমতা প্রত্যয়টি নিয়ে সংকট, সংশয় নিরন্তর। ক্ষমতা অন্ত্যজদের পরাধীন করেছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। এই পরাধীনতা নিরন্তর করার লক্ষ্যেই ক্ষমতা নির্যাতন করে যায় লাগাতার। ক্ষমতা আমাদের মধ্যে এমন বোধের সৃষ্টি করে যে এর থেকে বাকিদের রেহাই নেই, এর পুনরুত্পাদন কাঠামো যাই হোক না কেন নির্যাতন অব্যাহত থাকে। তাই ক্ষমতা নির্জীবতাকে উত্পাদন করে এবং এর পুনরুত্পাদন বিপুলভাবে উত্সাহিত হয়—নানা প্রকরণে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, মিডিয়া, ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয়—নানা ফর্মে। বাংলাদেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের চর্চা চলছে ২০ বছর ধরে। রাষ্ট্র কি আমাদের ক্রমাগত মুক্ত করছে, স্বাধীন করছে; নাকি আমাদের স্বাধীনতার স্থানগুলোকে দখল করে নিচ্ছে? গত ২০ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আরও নির্লজ্জ হয়েছে। নির্বাচনে যেন রাষ্ট্রের ইজারা হয় পাঁচ বছরের জন্য, সংবিধান, স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বোধ এগুলো অনেক দূরের বিষয়। গত দুই দশকে ক্ষমতায় যেই এসেছে তার মূল এজেন্ডা ছিল কীভাবে তার শাসনকালকে দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী করা যায়। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি দুই দলই প্রাতিষ্ঠানিকতার রীতিনীতির বাইরে গিয়ে যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছে তাকে বলা উচিত ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার’। বহুত্ববাদের সঙ্গে সম্পর্ক যেন সরাসরি তালাক না দিয়ে লোকলজ্জায় এক ছাদের নিচে বসবাসকারী নর-নারী। দুর্নীতির সঙ্গে ভীষণ সখ্যতা। নিজ দলের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য দুই দলই যেকোনো পদক্ষেপ নিতে লজ্জিত নয়। বলা উচিত, লজ্জা বলতে কোনো শব্দ এদের অভিধানেই নেই। এরা সরাসরি পশ্চিমা কেন্দ্রের চাটুকারিতা করে। তাই বিএনপির সময়কার জ্বালানিসচিব আওয়ামী লীগের জ্বালানিমন্ত্রী হয়ে যান অবলীলায়, তা যতই প্রকাশ্য কাজিয়া থাকুক না কেন। দুই দলই ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনে মৌলবাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। বিএনপি যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক, ভেতরে-বাইরে ইসলামি ঝোঁকটি পরিষ্কার। জামায়াতের সঙ্গে বরাবরের সখ্য ও নির্বাচনী আঁতাত। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগও নির্বাচনের আগে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নির্লজ্জভাবেই লিখিত চুক্তি করে। ধরে নিলাম এগুলো কৌশল। কিন্তু এভাবে কৌশল ও পাল্টা কৌশল মৌলবাদকে যতটা শক্ত করে তাতে শঙ্কিত হওয়াই উচিত। সোমবারই জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর রাখা হয়েছে। ইসলাম ব্যবহার করে কাঁটা তোলা। কৌশলটি অবশ্য বিএনপিই প্রথম ব্যবহার করেছিল। চট্টগ্রামের এমএ হান্নান বিমানবন্দরের নাম বদল করে শাহ আমানত বিমানবন্দর নাম রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাম পরিবর্তনের পক্ষে বলছেন, এর ফলে দেশের সব বিমানবন্দরের নামের মধ্যে সংগতি তৈরি হলো। সংগতি একটি হলো অবশ্যই। কার? মৌলবাদের। এর মধ্য দিয়ে যে প্রতিকী বার্তা আমরা সবাইকে দিচ্ছি তাতে কার লাভ? ধর্মীয় মৌলবাদের। এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে যেমন মৌলবাদের সঙ্গে লড়াই করা যায় না, তেমনি সম্ভব নয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। যারা গণতন্ত্র চায় না তারা কি সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতি চাইবে?
ছাত্ররাজনীতির পচন নিয়ে এত লেখালেখি, এত পরামর্শ, এত আলোচনার ফলাফল কী? ছাত্ররাজনীতির মারাত্মক অসুখ করেছে, আমরা বহুদিনই বলছি। কোনো সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে? কোনো দল চেষ্টা করেছে তার মাস্তানদের ঠেকানোর? একদমই না। তাহলে কেন আমরা ছাত্ররাজনীতিকে দোষারোপ করছি? আমাদের অপারগতার দোষ কেন চাপাচ্ছি এর ওপর? কবি সুমন রহমানের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত, যে ঐতিহ্য বর্তমানের চাহিদার সঙ্গে খাপ খায় না তাকে ধরে রাখার নামই হচ্ছে পশ্চাত্পদতা। কিন্তু ছাত্ররা কোনো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে না, কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। বর্তমানে তেল, গ্যাস রক্ষা আন্দোলনের মূল প্রাণ অল্প কয়েকজন ছাত্র, মূলত বাম। এদের কর্মতত্পরতা ও প্রচারমাধ্যমগুলোতে তার প্রচারের কারণেই আমাদের খনিজ সম্পদ পশ্চিমাদের দেওয়ার চেষ্টা করেও পারছেন না তৌফিক এলাহী চৌধুরীরা।
সোমবারের প্রথম আলোরই প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বে অছাত্ররা’। আমরা কি আইন করে শিক্ষাঙ্গনে অছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারি না? যদি আইন করা হয় যে নবম শ্রেণীতে শিক্ষা বোর্ডে নিবন্ধনের পর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কেউ কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য বা কোনো পদে থাকতে পারবে এবং তাকে নিয়মিত ছাত্র হতে হবে। তাহলে সন্ত্রাস শেষ হবে? না। যতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ শুধু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহূত হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাবে, ততক্ষণ সন্ত্রাস কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। ছাত্ররাজনীতি থাকুক আর নাই থাকুক। সরকার চাইলে তার দলের আশ্রয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হবে না, এটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক সংকট এখনো অত্যন্ত মারাত্মক। রাষ্ট্র এখনো ভীষণ নির্যাতনপ্রিয়। প্রধান দুটি দলের অভ্যন্তরীণ কার্যপরিচালনা পদ্ধতি পুরোপুরি স্বৈরতান্ত্রিক, সভানেত্রীর কথাই শেষ কথা, চাটুকারেরাই পদ পায়। ক্ষমতায় অংশগ্রহণে সাধারণের পথ অত্যন্ত সীমিত। ছাত্ররাজনীতি ক্ষমতার পরিচালন-কাঠামোতে প্রবেশের একটি মাত্র পথ, যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। একে নিষিদ্ধ করলে একমাত্র ধনবান ও ক্ষমতার নিকটজনেরাই শুধু ক্ষমতায় যেতে পারবে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা তাই হবে একটি চূড়ান্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
জাহিদ হাসান চৌধুরী: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zahid@alumni.indiana.edu

No comments

Powered by Blogger.