সাক্ষাৎকার-বাংলাদেশকে সোলার নেশন হতে হবে by দীপাল চন্দ্র বড়ূয়া
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দীপাল চন্দ্র বড়ূয়া ২০০৯ সালে ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি এর চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ শক্তির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র থাকাকালে বহুল আলোচিত জোবরা গ্রামে গঠিত নবযুগ তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই উদ্যোগ ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক নামে কাজ শুরু করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৯ সালে আবুধাবিতে তিনি প্রথম জায়েদ ফিউচার পুরস্কারে ভূষিত হন। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ভাসানী স্বর্ণপদক ২০০৮, ইউরোপিয়ান সোলার প্রাইজ ২০০৬। তিনি জার্মানভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ফিউচার কাউন্সিলের কাউন্সিলর। দীপাল চন্দ্র বড়ূয়া ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন
সমকাল : বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় মূলধারায় নানা উদ্যোগ আমরা দেখছি। একই সঙ্গে বিকল্প বিদ্যুৎ, বিশেষ করে সৌরশক্তি নিয়েও বেসরকারি পর্যায়ে তৎপরতা চলছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে এগুলো কতটা সহায়ক হতে পারে?
দীপাল বড়ূয়া : বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প খাতে, গার্হস্থ্য খাতে, কৃষিতে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। চাহিদা যে হারে বাড়ছে, উৎপাদন সে হারে বাড়ছে না। আবার এ ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগও দরকার। সেটা আমরা কত দ্রুত জোগান দেওয়ার ক্ষমতা রাখি, সে প্রশ্নও রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি, জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ পড়ে যাচ্ছে। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মতো কিছু দ্রুততর ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাচ্ছে, বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে কনভেনশনাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি নন-কনভেনশনাল উৎসে মনোযোগ দেওয়া দরকার। গত ১৫-২০ বছর ধরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করে যে সীমিত ধারণা জন্মেছে, তা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের মতো দেশে কনভেনশনাল বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব।
সমকাল :জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা আগামী দিনগুলোতে কতটা টেকসই থাকবে, সে প্রশ্নও তো এখন উঠতে শুরু করেছে?
দীপাল বড়ূয়া : আপনি ঠিকই বলেছেন। শুধু বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো না-মেটানোর জন্য নয়; ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম থেকে পাওয়া তেলের উৎস কিন্তু সীমিত হয়ে আসছে। ভবিষ্যতে এর দাম তো বাড়বেই। এক সময় এই মজুদও শেষ হয়ে যাবে। টাকা থাকবে; কিন্তু তেল পাওয়া যাবে না। ফলে আমাদের এখন থেকেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিকল্প বিদ্যুৎ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
সমকাল :বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু প্রাকৃতিক শর্ত থাকে। যেমন জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাহাড়ি খরস্রোতা নদী দরকার। বাংলাদেশ বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিকভাবে কতটা প্রস্তুত?
দীপাল বড়ূয়া :প্রত্যেক দেশেই কিছু ন্যাচারাল এনডাওমেন্ট থাকে। যেটা থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ হয়। এটা ঠিকই, বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা সীমিত। আমরা কাপ্তাই ছাড়া আর কোথাও এটা করতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশের রয়েছে অন্য একটি অফুরন্ত সম্পদ। সেটা সূর্যের আলো। এখানে আপনি যেভাবে খোলা ও প্রখর সূর্যের তাপ পাবেন, ইউরোপীয়, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কিংবা আমেরিকান কান্ট্রিগুলোতে সেটা পাবেন না। এমনকি সৌর বিদ্যুতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা জার্মানিতেও আমাদের মতো সূর্যকিরণ বিরল। তবে এ জন্য কিছু খরচ আছে_ সরাসরি সূর্যতাপ থেকে তো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অফুরন্ত সূর্যকিরণ রয়েছে, সেটাকে বিদ্যুতে পরিণত করার খরচ কমাতে পারলে বাংলাদেশ বিকল্প বিদ্যুতের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।
সমকাল : আমরা জানি, এ দেশে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে আপনি অন্যতম পথিকৃৎ...
দীপাল বড়ূয়া :আমি ১৯৯৬ সালে একটি ছোট উদ্যোগ নিয়েছিলাম। গ্রামীণ শক্তির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারের জন্য কাজ শুরু করি। তখন আমাদের দেশে ১৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পেত, ৮৫ ভাগ পেত না। আমরা সোলার হোম সিস্টেম চালু করেছিলাম। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মানুষ সৌরশক্তি ব্যবহার করছেন। 'সোলার হোম সিস্টেম' এখন দিন দিন প্রসার লাভ করছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান এর প্রসারে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, যেখানে কোনোদিন বিদ্যুতের আলো পেঁৗছেনি সেখানে আমরা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি।
সমকাল :আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুতের কী মাত্রায় সম্প্রসারণ ঘটছে?
দীপাল বড়ূয়া :মাসে ৪০-৪৫ হাজার সিস্টেম আমরা সরবরাহ করছি এখন। এটা শুধু ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশন থেকে নয়। আমাদের একটি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। এখানে ২৯টি কোম্পানি রয়েছে। সবাই মিলে মাসে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত আমরা ১৫ লাখ সিস্টেম স্থাপন করেছি। আশা করছি, ২০১৪ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ২৫ লাখে পেঁৗছবে।
সমকাল :ওয়াটের হিসাব যদি করি; সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে দেশে এখন কী পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে?
দীপাল বড়ূয়া :এক লাখ সিস্টেমে পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তার মানে, ১৫ লাখ সিস্টেমে কমবেশি ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল হিসাব করতে হবে, কত মানুষ এ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। কারণ এ বিদ্যুৎ তো শিল্প বা কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এসি চালানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। গ্রামীণ জনপদে মূলত বাল্ব জ্বালানো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেলিভিশন ও ফ্যান চালানো হচ্ছে। সেদিক থেকে এটি বিশ্বের বৃহত্তম সোলার সিস্টেম।
সমকাল : দামের বিষয়টি একটি ইস্যু। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্যানেল দামের দিক থেকে সাধারণ গ্রামবাসীর জন্য কতটা নাগালের মধ্যে?
দীপাল বড়ূয়া : আমরা যখন শুরু করি, সোলার সিস্টেমের কত দাম ছিল! প্রতি ওয়াট সিস্টেম কিনতে হতো সাত ডলারে। এখন এক ডলারে নেমে এসেছে। ব্যাটারির দাম এখনও বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ছে। কিন্তু শুরুতে দামের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ গ্রহণে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। আমরা প্রথমে হোম সোলার সিস্টেম সম্পর্কে গ্রামে গ্রামে হেঁটে মানুষকে বোঝানোর কাজ করেছি। কিন্তু সোলার প্যানেল এত ব্যয়বহুল ছিল যে, যদিওবা বুঝত, কেনার আগ্রহ করত না। পরে আমরা প্রতিটি পরিবারের মাসিক কেরোসিন তেল খরচ হিসাব করে কী পরিমাণ আসে তার ভিত্তিতে কিস্তি নির্ধারণ করে সোলার প্যানেল ব্যবহারে কিছুটা উৎসাহ তৈরি করি। এতে দেখা যায়, প্যানেল বাবদ অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হয়। তাই আমরা চিন্তা করলাম সোলার প্যানেল ব্যাটারিসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের দাম কমিয়ে কীভাবে নাগালের মধ্যে আনা যায়। আমরা যাদের কাছ থেকে সোলার প্যানেল আমদানি করতাম তাদের অনুরোধ করে কিছুটা দাম কমাতে সক্ষম হই। তারপর দেশের মধ্যে কীভাবে সোলার প্যানেলের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির দাম কমিয়ে উৎপাদন করা যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এতে আমরা মাসিক কিস্তিতে গ্রামে গ্রামে হোম সোলার প্যানেল দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সফলকাম হই। কেরোসিনের দামে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহারে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে আমরা উদ্বুদ্ধ করেছি। সোলার প্যানেল, চার্জ কন্ট্রোলার, কনভার্টার, ব্যাটারি, বাতি_ এসব জিনিসের দাম কমিয়ে কেরোসিনের দাম অনুযায়ী কিস্তি নির্ধারণ করার কারণে প্যানেল বসানোর কার্যক্রম এখন অনেক অগ্রসর হয়েছে।
সমকাল :দাম কমাতে গিয়ে মানের ক্ষেত্রে কি ছাড় দিতে হয়েছে? অনেকে অভিযোগ করে থাকেন যে, আমাদের দেশের সোলার সিস্টেম খুব বেশি টেকসই নয়।
দীপাল বড়ূয়া :কোয়ালিটি বলতে কী বোঝায়, সেটারও কোনো মানদণ্ড এখনও আমাদের দেশে নেই। এটার জন্য একটা মনিটরিং সিস্টেম লাগবে। রেগুলেটরি অথরিটি লাগবে, যারা এসবের কোয়ালিটি কন্ট্রোল করবে। এখনও এর মা-বাপ নেই। ভারতে রিনিওয়েবল এনার্জি ডিভিশন আছে। আমাদের দেশে কিছু নেই। আশার কথা হচ্ছে, সাসটেইনেবল রিনিওয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সেটা হলে মান নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
অন্যদিকও রয়েছে। সাধারণ মানুষ অনেক সময় ঢালাওভাবে বলে যে, সোলার সিস্টেমটা খারাপ। নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে কি নষ্ট হয়েছে? হয়তো কোনো একটা উপকরণে গড়বড় দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে সচেতনতাও দরকার। তবে অথরিটি প্রতিষ্ঠিত হলে একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হবে আশা করা যায়।
সমকাল : সোলার হোমস সিস্টেমের বাইরে বিদ্যুতের আর কী কী বিকল্প উৎস রয়েছে?
দীপাল বড়ূয়া :সোলার থারমাল করা যেতে পারে। সৌরশক্তিতে পানি গরম হবে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ। উইন্ড এনার্জি হতে পারে। আমাদের সাড়ে সাতশ' কিলোমিটার কোস্টাল বেল্ট রয়েছে। সেখানে অবশ্য সারা বছর উপযুক্ত বায়ু প্রবাহ থাকে না। এ জন্য উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং থাকা দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও করা সম্ভব হয়নি। বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ রয়েছে। অনেক দেশই যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে চায়। কিন্তু আমাদের কাছে সূর্যতাপ ছাড়া বিকল্প অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নেই। বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। সেটা খুবই সীমিত পর্যায়ে দু'এক জায়গায় হচ্ছে। ব্যাপকভাবে ব্যবহার নেই, ব্যাপক পরিকল্পনাও নেই।
সমকাল:সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে কনভেনশনাল বিদ্যুতের ওপর কি চাপ কমছে? কনভেনশনাল বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, সেখানে বিকল্প বিদ্যুৎ কীভাবে জোগান দেওয়া যায়?
দীপাল বড়ূয়া :দেশে অনেক সেচপাম্প রয়েছে। সেগুলো বিদ্যুতে চলে। সেখানে যদি আমরা সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারি, তাহলে কনভেনশনাল বিদ্যুতের অনেক সাশ্রয় হবে। এখন কৃষি মৌসুমে শহরে বিদ্যুতের যে ঘাটতি দেখা যায়, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। মাঠে সারা বছরই ব্যাপক রোদ থাকে। ফসলের জন্য তিন থেকে চার মাস সেচের প্রয়োজন হয়। বাকি সময় ওই সোলার সিস্টেম দিয়ে ড্রিংকিং ওয়াটার সরবরাহ করা যাবে। লোকালয়ে আলোর ব্যবস্থা করা যাবে। ব্যাটারি চার্জ দেওয়া যাবে। এটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়; শুধু ইঞ্জিনের ডিজাইন একটু চেঞ্জ করলেই হবে।
সমকাল :সৌরবিদ্যুৎ কি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব?
দীপাল বড়ূয়া :আমাদের দেশে সম্ভব হয়নি, আমরা এখনও বাড়িতে বাড়িতে দিচ্ছি। বিশ্বে কিন্তু জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। জার্মানি ও ভারতে সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে জাতীয় গ্রিড স্থিতিশীল নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের গ্রিডে নানা জটিলতা রয়েছে। লোডশেডিং থাকে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হলে জাতীয় গ্রিডকে লোডশেডিংমুক্ত হতে হবে। তাহলে কি আমরা সারা জীবনই জাতীয় গ্রিড থেকে বাইরে থাকব? এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। জাতীয় গ্রিডে দিলে আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, ব্যাটারি প্রয়োজন হয় না। তাহলে ব্যাটারির খরচও বেঁচে যায়। জাতীয় গ্রিডে কীভাবে দেওয়া যায়, সে নিয়ে সবাইকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
সমকাল :আমরা দেখছি, বেসরকারি পর্যায়ে বিকল্প বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের উদ্যোগের বাইরে সরকার আর কী করছে?
দীপাল বড়ূয়া :আমি মনে করি, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। ব্যাটারির ট্যাক্স মওকুফ করছে। রিনিওয়েবল এনার্জি পলিসি এডাপ্ট করছে। কিন্তু পাশাপাশি আমরা মনে করি ,এ বিষয়ে আলাদা একটা বিভাগ করা দরকার। যেখানে সবাই যেতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কাজ করা সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, পরিবেশ কর্মী, উদ্যোক্তা, উপকারভোগী_ সবাই গিয়ে নিজেদের মতামত দিতে পারবে। অভিযোগ জানাতে পারবে। সুপারিশ তুলে ধরতে পারবে। এতে করে বিকল্প বিদ্যুৎ সম্প্রসারণের কাজ আরও সহজ হবে।
আর বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলা করতে হলে আমাদের সোলার নেশন গড়ে তুলতেই হবে। যতই আমরা জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে তৎপর হই, আমি মনে করি না স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এখনও মাত্র ৪০-৫০ ভাগ বিদ্যুৎ পেয়েছে। আরও অর্ধেক মানুষ পায়নি। তারা কবে পাবে? যারা পেয়েছে, তারাও কি বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সন্তুষ্ট? আমি মনে করি না। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে হলে আমাদের অবশ্যই নন-কনভেনশনাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। আমি মনে করি, ২০২১ সালের মধ্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঘরে সৌর বিদ্যুৎ পেঁৗছানো সম্ভব।
সমকাল :গার্হস্থ্য ব্যবহারের বাইরে তো সৌরবিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব নয়?
দীপাল বড়ূয়া : ওই যে বললাম, কৃষি সেচ সম্ভব। হ্যাঁ, শিল্প খাতে সম্ভব নয়। কোথাও সম্ভব হয়নি। ঘরের কাজে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার হলেও কনভেনশনাল বিদ্যুতের ওপর চাপ কমে যাবে। উন্নয়নের জন্য এনার্জি মিক্স দরকার। আমরা যদি পঞ্চাশভাগ কনভেনশনাল আর বাকি পঞ্চাশ ভাগ নন-কনভেনশনাল উৎস থেকে সরবরাহ করতে পারি, তাহলে একটি দেশের উন্নয়ন টেকসই, পরিবেশসম্মত হয়।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
দীপাল বড়ূয়া : সমকালের জন্য শুভেচ্ছা।
সমকাল : বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় মূলধারায় নানা উদ্যোগ আমরা দেখছি। একই সঙ্গে বিকল্প বিদ্যুৎ, বিশেষ করে সৌরশক্তি নিয়েও বেসরকারি পর্যায়ে তৎপরতা চলছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে এগুলো কতটা সহায়ক হতে পারে?
দীপাল বড়ূয়া : বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প খাতে, গার্হস্থ্য খাতে, কৃষিতে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। চাহিদা যে হারে বাড়ছে, উৎপাদন সে হারে বাড়ছে না। আবার এ ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগও দরকার। সেটা আমরা কত দ্রুত জোগান দেওয়ার ক্ষমতা রাখি, সে প্রশ্নও রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি, জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ পড়ে যাচ্ছে। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মতো কিছু দ্রুততর ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাচ্ছে, বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে কনভেনশনাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি নন-কনভেনশনাল উৎসে মনোযোগ দেওয়া দরকার। গত ১৫-২০ বছর ধরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করে যে সীমিত ধারণা জন্মেছে, তা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের মতো দেশে কনভেনশনাল বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব।
সমকাল :জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা আগামী দিনগুলোতে কতটা টেকসই থাকবে, সে প্রশ্নও তো এখন উঠতে শুরু করেছে?
দীপাল বড়ূয়া : আপনি ঠিকই বলেছেন। শুধু বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো না-মেটানোর জন্য নয়; ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম থেকে পাওয়া তেলের উৎস কিন্তু সীমিত হয়ে আসছে। ভবিষ্যতে এর দাম তো বাড়বেই। এক সময় এই মজুদও শেষ হয়ে যাবে। টাকা থাকবে; কিন্তু তেল পাওয়া যাবে না। ফলে আমাদের এখন থেকেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিকল্প বিদ্যুৎ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
সমকাল :বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু প্রাকৃতিক শর্ত থাকে। যেমন জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাহাড়ি খরস্রোতা নদী দরকার। বাংলাদেশ বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিকভাবে কতটা প্রস্তুত?
দীপাল বড়ূয়া :প্রত্যেক দেশেই কিছু ন্যাচারাল এনডাওমেন্ট থাকে। যেটা থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ হয়। এটা ঠিকই, বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা সীমিত। আমরা কাপ্তাই ছাড়া আর কোথাও এটা করতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশের রয়েছে অন্য একটি অফুরন্ত সম্পদ। সেটা সূর্যের আলো। এখানে আপনি যেভাবে খোলা ও প্রখর সূর্যের তাপ পাবেন, ইউরোপীয়, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কিংবা আমেরিকান কান্ট্রিগুলোতে সেটা পাবেন না। এমনকি সৌর বিদ্যুতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা জার্মানিতেও আমাদের মতো সূর্যকিরণ বিরল। তবে এ জন্য কিছু খরচ আছে_ সরাসরি সূর্যতাপ থেকে তো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অফুরন্ত সূর্যকিরণ রয়েছে, সেটাকে বিদ্যুতে পরিণত করার খরচ কমাতে পারলে বাংলাদেশ বিকল্প বিদ্যুতের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।
সমকাল : আমরা জানি, এ দেশে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে আপনি অন্যতম পথিকৃৎ...
দীপাল বড়ূয়া :আমি ১৯৯৬ সালে একটি ছোট উদ্যোগ নিয়েছিলাম। গ্রামীণ শক্তির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারের জন্য কাজ শুরু করি। তখন আমাদের দেশে ১৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পেত, ৮৫ ভাগ পেত না। আমরা সোলার হোম সিস্টেম চালু করেছিলাম। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মানুষ সৌরশক্তি ব্যবহার করছেন। 'সোলার হোম সিস্টেম' এখন দিন দিন প্রসার লাভ করছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান এর প্রসারে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, যেখানে কোনোদিন বিদ্যুতের আলো পেঁৗছেনি সেখানে আমরা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি।
সমকাল :আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুতের কী মাত্রায় সম্প্রসারণ ঘটছে?
দীপাল বড়ূয়া :মাসে ৪০-৪৫ হাজার সিস্টেম আমরা সরবরাহ করছি এখন। এটা শুধু ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশন থেকে নয়। আমাদের একটি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। এখানে ২৯টি কোম্পানি রয়েছে। সবাই মিলে মাসে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত আমরা ১৫ লাখ সিস্টেম স্থাপন করেছি। আশা করছি, ২০১৪ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ২৫ লাখে পেঁৗছবে।
সমকাল :ওয়াটের হিসাব যদি করি; সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে দেশে এখন কী পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে?
দীপাল বড়ূয়া :এক লাখ সিস্টেমে পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তার মানে, ১৫ লাখ সিস্টেমে কমবেশি ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল হিসাব করতে হবে, কত মানুষ এ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। কারণ এ বিদ্যুৎ তো শিল্প বা কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এসি চালানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। গ্রামীণ জনপদে মূলত বাল্ব জ্বালানো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেলিভিশন ও ফ্যান চালানো হচ্ছে। সেদিক থেকে এটি বিশ্বের বৃহত্তম সোলার সিস্টেম।
সমকাল : দামের বিষয়টি একটি ইস্যু। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্যানেল দামের দিক থেকে সাধারণ গ্রামবাসীর জন্য কতটা নাগালের মধ্যে?
দীপাল বড়ূয়া : আমরা যখন শুরু করি, সোলার সিস্টেমের কত দাম ছিল! প্রতি ওয়াট সিস্টেম কিনতে হতো সাত ডলারে। এখন এক ডলারে নেমে এসেছে। ব্যাটারির দাম এখনও বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ছে। কিন্তু শুরুতে দামের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ গ্রহণে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। আমরা প্রথমে হোম সোলার সিস্টেম সম্পর্কে গ্রামে গ্রামে হেঁটে মানুষকে বোঝানোর কাজ করেছি। কিন্তু সোলার প্যানেল এত ব্যয়বহুল ছিল যে, যদিওবা বুঝত, কেনার আগ্রহ করত না। পরে আমরা প্রতিটি পরিবারের মাসিক কেরোসিন তেল খরচ হিসাব করে কী পরিমাণ আসে তার ভিত্তিতে কিস্তি নির্ধারণ করে সোলার প্যানেল ব্যবহারে কিছুটা উৎসাহ তৈরি করি। এতে দেখা যায়, প্যানেল বাবদ অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হয়। তাই আমরা চিন্তা করলাম সোলার প্যানেল ব্যাটারিসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের দাম কমিয়ে কীভাবে নাগালের মধ্যে আনা যায়। আমরা যাদের কাছ থেকে সোলার প্যানেল আমদানি করতাম তাদের অনুরোধ করে কিছুটা দাম কমাতে সক্ষম হই। তারপর দেশের মধ্যে কীভাবে সোলার প্যানেলের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির দাম কমিয়ে উৎপাদন করা যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এতে আমরা মাসিক কিস্তিতে গ্রামে গ্রামে হোম সোলার প্যানেল দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সফলকাম হই। কেরোসিনের দামে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহারে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে আমরা উদ্বুদ্ধ করেছি। সোলার প্যানেল, চার্জ কন্ট্রোলার, কনভার্টার, ব্যাটারি, বাতি_ এসব জিনিসের দাম কমিয়ে কেরোসিনের দাম অনুযায়ী কিস্তি নির্ধারণ করার কারণে প্যানেল বসানোর কার্যক্রম এখন অনেক অগ্রসর হয়েছে।
সমকাল :দাম কমাতে গিয়ে মানের ক্ষেত্রে কি ছাড় দিতে হয়েছে? অনেকে অভিযোগ করে থাকেন যে, আমাদের দেশের সোলার সিস্টেম খুব বেশি টেকসই নয়।
দীপাল বড়ূয়া :কোয়ালিটি বলতে কী বোঝায়, সেটারও কোনো মানদণ্ড এখনও আমাদের দেশে নেই। এটার জন্য একটা মনিটরিং সিস্টেম লাগবে। রেগুলেটরি অথরিটি লাগবে, যারা এসবের কোয়ালিটি কন্ট্রোল করবে। এখনও এর মা-বাপ নেই। ভারতে রিনিওয়েবল এনার্জি ডিভিশন আছে। আমাদের দেশে কিছু নেই। আশার কথা হচ্ছে, সাসটেইনেবল রিনিওয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সেটা হলে মান নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
অন্যদিকও রয়েছে। সাধারণ মানুষ অনেক সময় ঢালাওভাবে বলে যে, সোলার সিস্টেমটা খারাপ। নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে কি নষ্ট হয়েছে? হয়তো কোনো একটা উপকরণে গড়বড় দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে সচেতনতাও দরকার। তবে অথরিটি প্রতিষ্ঠিত হলে একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হবে আশা করা যায়।
সমকাল : সোলার হোমস সিস্টেমের বাইরে বিদ্যুতের আর কী কী বিকল্প উৎস রয়েছে?
দীপাল বড়ূয়া :সোলার থারমাল করা যেতে পারে। সৌরশক্তিতে পানি গরম হবে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ। উইন্ড এনার্জি হতে পারে। আমাদের সাড়ে সাতশ' কিলোমিটার কোস্টাল বেল্ট রয়েছে। সেখানে অবশ্য সারা বছর উপযুক্ত বায়ু প্রবাহ থাকে না। এ জন্য উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং থাকা দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও করা সম্ভব হয়নি। বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ রয়েছে। অনেক দেশই যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে চায়। কিন্তু আমাদের কাছে সূর্যতাপ ছাড়া বিকল্প অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নেই। বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। সেটা খুবই সীমিত পর্যায়ে দু'এক জায়গায় হচ্ছে। ব্যাপকভাবে ব্যবহার নেই, ব্যাপক পরিকল্পনাও নেই।
সমকাল:সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে কনভেনশনাল বিদ্যুতের ওপর কি চাপ কমছে? কনভেনশনাল বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, সেখানে বিকল্প বিদ্যুৎ কীভাবে জোগান দেওয়া যায়?
দীপাল বড়ূয়া :দেশে অনেক সেচপাম্প রয়েছে। সেগুলো বিদ্যুতে চলে। সেখানে যদি আমরা সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারি, তাহলে কনভেনশনাল বিদ্যুতের অনেক সাশ্রয় হবে। এখন কৃষি মৌসুমে শহরে বিদ্যুতের যে ঘাটতি দেখা যায়, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। মাঠে সারা বছরই ব্যাপক রোদ থাকে। ফসলের জন্য তিন থেকে চার মাস সেচের প্রয়োজন হয়। বাকি সময় ওই সোলার সিস্টেম দিয়ে ড্রিংকিং ওয়াটার সরবরাহ করা যাবে। লোকালয়ে আলোর ব্যবস্থা করা যাবে। ব্যাটারি চার্জ দেওয়া যাবে। এটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়; শুধু ইঞ্জিনের ডিজাইন একটু চেঞ্জ করলেই হবে।
সমকাল :সৌরবিদ্যুৎ কি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব?
দীপাল বড়ূয়া :আমাদের দেশে সম্ভব হয়নি, আমরা এখনও বাড়িতে বাড়িতে দিচ্ছি। বিশ্বে কিন্তু জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। জার্মানি ও ভারতে সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে জাতীয় গ্রিড স্থিতিশীল নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের গ্রিডে নানা জটিলতা রয়েছে। লোডশেডিং থাকে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হলে জাতীয় গ্রিডকে লোডশেডিংমুক্ত হতে হবে। তাহলে কি আমরা সারা জীবনই জাতীয় গ্রিড থেকে বাইরে থাকব? এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। জাতীয় গ্রিডে দিলে আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, ব্যাটারি প্রয়োজন হয় না। তাহলে ব্যাটারির খরচও বেঁচে যায়। জাতীয় গ্রিডে কীভাবে দেওয়া যায়, সে নিয়ে সবাইকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
সমকাল :আমরা দেখছি, বেসরকারি পর্যায়ে বিকল্প বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের উদ্যোগের বাইরে সরকার আর কী করছে?
দীপাল বড়ূয়া :আমি মনে করি, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। ব্যাটারির ট্যাক্স মওকুফ করছে। রিনিওয়েবল এনার্জি পলিসি এডাপ্ট করছে। কিন্তু পাশাপাশি আমরা মনে করি ,এ বিষয়ে আলাদা একটা বিভাগ করা দরকার। যেখানে সবাই যেতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কাজ করা সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, পরিবেশ কর্মী, উদ্যোক্তা, উপকারভোগী_ সবাই গিয়ে নিজেদের মতামত দিতে পারবে। অভিযোগ জানাতে পারবে। সুপারিশ তুলে ধরতে পারবে। এতে করে বিকল্প বিদ্যুৎ সম্প্রসারণের কাজ আরও সহজ হবে।
আর বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলা করতে হলে আমাদের সোলার নেশন গড়ে তুলতেই হবে। যতই আমরা জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে তৎপর হই, আমি মনে করি না স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এখনও মাত্র ৪০-৫০ ভাগ বিদ্যুৎ পেয়েছে। আরও অর্ধেক মানুষ পায়নি। তারা কবে পাবে? যারা পেয়েছে, তারাও কি বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সন্তুষ্ট? আমি মনে করি না। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে হলে আমাদের অবশ্যই নন-কনভেনশনাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। আমি মনে করি, ২০২১ সালের মধ্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঘরে সৌর বিদ্যুৎ পেঁৗছানো সম্ভব।
সমকাল :গার্হস্থ্য ব্যবহারের বাইরে তো সৌরবিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব নয়?
দীপাল বড়ূয়া : ওই যে বললাম, কৃষি সেচ সম্ভব। হ্যাঁ, শিল্প খাতে সম্ভব নয়। কোথাও সম্ভব হয়নি। ঘরের কাজে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার হলেও কনভেনশনাল বিদ্যুতের ওপর চাপ কমে যাবে। উন্নয়নের জন্য এনার্জি মিক্স দরকার। আমরা যদি পঞ্চাশভাগ কনভেনশনাল আর বাকি পঞ্চাশ ভাগ নন-কনভেনশনাল উৎস থেকে সরবরাহ করতে পারি, তাহলে একটি দেশের উন্নয়ন টেকসই, পরিবেশসম্মত হয়।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
দীপাল বড়ূয়া : সমকালের জন্য শুভেচ্ছা।
No comments