জিএম খাদ্য- বেগুন নিয়ে হইচই by মুশফিকুর রহমান
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিটি বেগুন’ নামের জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা ‘জিএম’ বেগুনের বাণিজ্যিক চাষাবাদ নিষিদ্ধ করেছে। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ওই ঘোষণা দেন। মন্ত্রী বলেন, নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় খাদ্য হিসেবে নিরাপদ প্রতিপন্ন হওয়া অবধি বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষাবাদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
পরিবেশবাদী গ্রুপগুলো মন্ত্রীর এই ঘোষণাকে ‘জিএম’ ফসলের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের বিজয় হিসেবে বিবেচনা করছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলন গোষ্ঠী ‘গ্রিন পিস’ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফসল নিয়ে গবেষণারত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার দাবি ও দুর্ঘটনাক্রমে যেন ‘জিএম’ ফসল ব্যবহারকারী পর্যায়ে চলে না আসে তার দাবি জানিয়েছে। গ্রিন পিস আরও সতর্কতা উচ্চারণ করেছে, যেন বিটি বেগুনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পেছনের দরজা দিয়ে লঙ্ঘিত না হয় বা ভারতে অনুরূপ ৪১টি গবেষণা পর্যায়ের জিএম ফসল বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপাদান না হয়।
অবশ্য জিএম শস্য, ফসল ও কৃষিজাত পণ্যের গবেষণা-সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ ঘটনায় হতাশ। তাদের বক্তব্য, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষক যখন বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ফলন বাড়ানোর অহর্নিশ চেষ্টা করছে, তখন বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ বা অনুরূপ গবেষণা ও তার ফসলকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্যোগ প্রকারান্তরে অধিক হারে কৃষি ফলনকে বাধাগ্রস্ত করবে।
ভারতে প্রায় চার হাজার বছর ধরে বেগুনের চাষ হচ্ছে এবং এ উপমহাদেশে বেগুন একটি অন্যতম প্রধান সবজি হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত ফসল। কার্যত, চীনের পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বেগুন চাষ হয় ভারতে। বেগুন চাষের অন্যতম প্রতিবন্ধক বেগুন ও তার গাছের নরম অংশ ফুটো করে বাসা বাঁধা একধরনের ক্ষতিকর কীট। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন কৌশলে বেগুনের শত্রু ওই ক্ষুদ্র পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেগুন চাষিরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মনসান্টোর সঙ্গে যৌথভাবে মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিডস কোম্পানি গবেষণার মাধ্যমে ‘বিটি বেগুন’ নামের পরিবর্তিত জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বেগুন আবিষ্কার করে। এই জাতের বেগুনের জেনেটিক কোডে পরিবর্তন ঘটিয়ে একধরনের ভূমিজ ব্যাকটেরিয়ার ‘জিন’ বেগুনের কোষে প্রবেশ করানোর ফলে, বিটি বেগুন নিজেই আক্রমণকারী পোকার প্রতিরোধকারী বিষাক্ত উপাদান তার নিজ কোষ থেকে নিঃসরণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে বেগুন ছিদ্রকারী পোকা বেগুনের সামান্য অংশ গ্রাস করলে নিজেই মারা যায়। এতে পোকা দমনে কোনো কীটনাশক প্রয়োগ বা অন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
বিটি বেগুন উদ্ভাবনকারী কোম্পানির বক্তব্য, বেগুন ছিদ্রকারী পোকা মেরে ফেলার মতো বিষ বেগুনের কোষ থেকে নিঃসৃত হলেও মানুষ বা গবাদিপশু বিটি বেগুন নিরাপদেই খেতে পারে। কোম্পানিটির দাবি, বেগুন রান্না করলে বা গবাদিপশু কাঁচা খেলে তার পাকস্থলীর এসিড বেগুনের কোষের উত্পাদিত সামান্য মাত্রার বিষাক্ত উপাদান ভেঙে দেয়। ফলে বিটি বেগুন ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ প্রতিরোধশক্তি অর্জন করলেও তা মানুষ ও পশুর জন্য নিরাপদ।
গবেষকদের দাবি, বিটি বেগুন উত্পাদন কম ব্যয়বহুল। কেননা এতে কীটনাশকের ব্যবহার ৮০ শতাংশ কম ও এর উত্পাদন প্রচলিত অন্যান্য বেগুনের দ্বিগুণ। ভারতের ‘জিএম’ ফসল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটি বেগুন চাষের জন্য ইতিপূর্বে অনুমোদন দিলেও পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রুপসহ বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। গবেষকদের কেউ কেউ মানুষের শরীরে বিটি বেগুন কতটুকু ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা আরও নিশ্চিত হওয়ার আগে এর বাণিজ্যিক চাষাবাদের অনুমতি ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন।
আবার বিরুদ্ধ মতের বিজ্ঞানীদের কথা হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিএম ফসল নিয়ে কেবল গবেষণা নয়, বাণিজ্যিকভাবে তার চাষাবাদও হচ্ছে। খোদ ভারতেই ২০০২ সাল থেকে ‘বিটি তুলা’ নামের ‘জিএম’ ফসলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। উচ্চ ফলনশীল জিএম ফসল ‘বিটি তুলার’ সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রকে ডিঙিয়ে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা উত্পাদনকারী দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
পরিবেশবাদী গ্রুপসহ জিএম ফসলবিরোধী আন্দোলনকারীদের আশঙ্কা কেবল জনস্বাস্থ্য নিয়ে নয়। তাদের বক্তব্য, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা জিএম ফসল ব্যাপকভাবে প্রচলিত হলে উত্পাদনের জন্য কৃষক পুরোপুরি মনসান্টো বা অনুরূপ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর কৃষি ফসলের বীজের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে উচ্চ ফলনশীল জিএম ফসল প্রচলিত ফসল ও জীববৈচিত্র্য-ভান্ডারকে দ্রুত সংকুচিত করে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
কিন্তু ক্রমসংকুচিত ফসলের মাঠ, বর্ধিত মানুষ ও তার চাহিদা পূরণে বিশ্বজুড়েই জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা জিএম ফুড ও ফসল নিয়ে ব্যাপক গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। কৃষিকাজ শেখার পর থেকেই মানুষ বিভিন্ন জাতের ফসল, খাদ্যশস্য বাছাই করে সেগুলোর মধ্য থেকে উত্তম গুণ ও বৈশিষ্ট্য সংমিশ্রণ করে নতুন প্রজাতির উন্নত শস্য ও ফসল উত্পাদন করে আসছে। বায়োটেকনোলজির বিস্ময়কর সব আবিষ্কার প্রাণী ও উদ্ভিদের কোষসমূহে বিদ্যমান জেনেটিক কোড বদলের সুযোগ করে দিয়েছে। এতে উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষের বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলো পাল্টে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটাকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলছেন। এভাবে তৈরি হচ্ছে নতুন বৈশিষ্ট্যের ফসল, খাদ্যশস্য, প্রাণী ও পশুদের খাদ্য, যুগান্তকারী ওষুধ। আবার ফসল উত্পাদনে রোগবালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের প্রচলিত কৌশলের বদলে—ফসল আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ফসলের জেনেটিক কোডে পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে করে তোলা হচ্ছে রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ-প্রতিরোধক্ষম।
২০০৬ সালে পৃথিবীর ২২টি দেশে অন্তত ২৫২ মিলিয়ন একর জমিতে এ রকম রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধ-সক্ষম সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা ক্যানোলাসহ (তেলবীজ) অন্যান্য ফসল চাষ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিষ্টি আলু, ভিটামিন সমৃদ্ধ ধানও উদ্ভাবিত হয়েছে এই গবেষণার অধীনে। আশা করা হচ্ছে, এমন দিন বেশি দূরে নয় যখন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বদৌলতে ‘জিএম কলা’ খেয়ে মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস-বি-এর মতো মারাত্মক ব্যাধির প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠবে; গবাদিপশুর ‘ম্যাড কাউ ডিজিস’ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হবে, ফলমূল ও বাদাম উত্পাদন সময়কাল তরান্বিত হবে। মাছ বেড়ে উঠবে আরও দ্রুত। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, উড়িষ্যার কটক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ‘আঘন বোরো’ নামের এক নতুন ধান আবিষ্কার করেছেন, যার চাল না ফুটিয়ে ৪৫ মিনিট স্বাভাবিক পানিতে ভিজিয়ে রাখলেই ভাতের মতো খাওয়া যাবে। ঈষত্ উষ্ণ পানিতে ‘আঘন বোরো’ চাল থেকে ভাত পেতে লাগবে ১৫ মিনিট।
অবধারিতভাবে বায়োটেকনোলজি যত এগোচ্ছে, জিএম ফসল ও খাদ্য উত্পাদন নিয়ে গবেষণার ব্যাপকতা তত বাড়ছে। মানুষ একই সঙ্গে এ নিয়ে উদ্বিগ্নও হচ্ছে। কেননা বড় বড় কোম্পানি এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। তারা মুনাফা ও একচেটিয়া ব্যবসা করায়ত্ত করতে যথোপযুক্ত ‘বায়োসেফটি’ আইন-কানুন মানবে কি না তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ লক্ষ্যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণার ওপর নজরদারি এবং উদ্ভাবিত ফসল বিপণনের অনুমোদনের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ও বিধিবিধান প্রণীত হচ্ছে।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল-২০১০’-এর খসড়া উত্থাপিত হয়েছে। প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের পর এ বিল পার্লামেন্টে অনুমোদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিলের অধীনে জিএম ফুড ও ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অরগানিজম’ (জিএমও) উত্পাদনের স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন ও অনুমোদন সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে।
বাংলাদেশে জিএম ফুড হিসেবে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ‘গোল্ডেন রাইস’, বিটি বেগুনের মতো ফসলসহ বিভিন্ন জিএম ফসল নিয়ে গবেষণা চলছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় আমাদের কৃষি গবেষণা খানিক পিছিয়ে থাকলেও থেমে নেই। সুতরাং বিশ্বে জিএম ফসল নিয়ে চলমান গবেষণা, এর নিয়ন্ত্রণকাঠামো এবং একই সঙ্গে এখানে উপযুক্ত সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ। পরিবেশবিষয়ক লেখক।
অবশ্য জিএম শস্য, ফসল ও কৃষিজাত পণ্যের গবেষণা-সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ ঘটনায় হতাশ। তাদের বক্তব্য, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষক যখন বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ফলন বাড়ানোর অহর্নিশ চেষ্টা করছে, তখন বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ বা অনুরূপ গবেষণা ও তার ফসলকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্যোগ প্রকারান্তরে অধিক হারে কৃষি ফলনকে বাধাগ্রস্ত করবে।
ভারতে প্রায় চার হাজার বছর ধরে বেগুনের চাষ হচ্ছে এবং এ উপমহাদেশে বেগুন একটি অন্যতম প্রধান সবজি হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত ফসল। কার্যত, চীনের পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বেগুন চাষ হয় ভারতে। বেগুন চাষের অন্যতম প্রতিবন্ধক বেগুন ও তার গাছের নরম অংশ ফুটো করে বাসা বাঁধা একধরনের ক্ষতিকর কীট। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন কৌশলে বেগুনের শত্রু ওই ক্ষুদ্র পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেগুন চাষিরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মনসান্টোর সঙ্গে যৌথভাবে মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিডস কোম্পানি গবেষণার মাধ্যমে ‘বিটি বেগুন’ নামের পরিবর্তিত জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বেগুন আবিষ্কার করে। এই জাতের বেগুনের জেনেটিক কোডে পরিবর্তন ঘটিয়ে একধরনের ভূমিজ ব্যাকটেরিয়ার ‘জিন’ বেগুনের কোষে প্রবেশ করানোর ফলে, বিটি বেগুন নিজেই আক্রমণকারী পোকার প্রতিরোধকারী বিষাক্ত উপাদান তার নিজ কোষ থেকে নিঃসরণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে বেগুন ছিদ্রকারী পোকা বেগুনের সামান্য অংশ গ্রাস করলে নিজেই মারা যায়। এতে পোকা দমনে কোনো কীটনাশক প্রয়োগ বা অন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
বিটি বেগুন উদ্ভাবনকারী কোম্পানির বক্তব্য, বেগুন ছিদ্রকারী পোকা মেরে ফেলার মতো বিষ বেগুনের কোষ থেকে নিঃসৃত হলেও মানুষ বা গবাদিপশু বিটি বেগুন নিরাপদেই খেতে পারে। কোম্পানিটির দাবি, বেগুন রান্না করলে বা গবাদিপশু কাঁচা খেলে তার পাকস্থলীর এসিড বেগুনের কোষের উত্পাদিত সামান্য মাত্রার বিষাক্ত উপাদান ভেঙে দেয়। ফলে বিটি বেগুন ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ প্রতিরোধশক্তি অর্জন করলেও তা মানুষ ও পশুর জন্য নিরাপদ।
গবেষকদের দাবি, বিটি বেগুন উত্পাদন কম ব্যয়বহুল। কেননা এতে কীটনাশকের ব্যবহার ৮০ শতাংশ কম ও এর উত্পাদন প্রচলিত অন্যান্য বেগুনের দ্বিগুণ। ভারতের ‘জিএম’ ফসল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটি বেগুন চাষের জন্য ইতিপূর্বে অনুমোদন দিলেও পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রুপসহ বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। গবেষকদের কেউ কেউ মানুষের শরীরে বিটি বেগুন কতটুকু ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা আরও নিশ্চিত হওয়ার আগে এর বাণিজ্যিক চাষাবাদের অনুমতি ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন।
আবার বিরুদ্ধ মতের বিজ্ঞানীদের কথা হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিএম ফসল নিয়ে কেবল গবেষণা নয়, বাণিজ্যিকভাবে তার চাষাবাদও হচ্ছে। খোদ ভারতেই ২০০২ সাল থেকে ‘বিটি তুলা’ নামের ‘জিএম’ ফসলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। উচ্চ ফলনশীল জিএম ফসল ‘বিটি তুলার’ সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রকে ডিঙিয়ে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা উত্পাদনকারী দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
পরিবেশবাদী গ্রুপসহ জিএম ফসলবিরোধী আন্দোলনকারীদের আশঙ্কা কেবল জনস্বাস্থ্য নিয়ে নয়। তাদের বক্তব্য, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা জিএম ফসল ব্যাপকভাবে প্রচলিত হলে উত্পাদনের জন্য কৃষক পুরোপুরি মনসান্টো বা অনুরূপ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর কৃষি ফসলের বীজের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে উচ্চ ফলনশীল জিএম ফসল প্রচলিত ফসল ও জীববৈচিত্র্য-ভান্ডারকে দ্রুত সংকুচিত করে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
কিন্তু ক্রমসংকুচিত ফসলের মাঠ, বর্ধিত মানুষ ও তার চাহিদা পূরণে বিশ্বজুড়েই জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা জিএম ফুড ও ফসল নিয়ে ব্যাপক গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। কৃষিকাজ শেখার পর থেকেই মানুষ বিভিন্ন জাতের ফসল, খাদ্যশস্য বাছাই করে সেগুলোর মধ্য থেকে উত্তম গুণ ও বৈশিষ্ট্য সংমিশ্রণ করে নতুন প্রজাতির উন্নত শস্য ও ফসল উত্পাদন করে আসছে। বায়োটেকনোলজির বিস্ময়কর সব আবিষ্কার প্রাণী ও উদ্ভিদের কোষসমূহে বিদ্যমান জেনেটিক কোড বদলের সুযোগ করে দিয়েছে। এতে উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষের বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলো পাল্টে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটাকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলছেন। এভাবে তৈরি হচ্ছে নতুন বৈশিষ্ট্যের ফসল, খাদ্যশস্য, প্রাণী ও পশুদের খাদ্য, যুগান্তকারী ওষুধ। আবার ফসল উত্পাদনে রোগবালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের প্রচলিত কৌশলের বদলে—ফসল আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ফসলের জেনেটিক কোডে পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে করে তোলা হচ্ছে রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ-প্রতিরোধক্ষম।
২০০৬ সালে পৃথিবীর ২২টি দেশে অন্তত ২৫২ মিলিয়ন একর জমিতে এ রকম রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধ-সক্ষম সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা ক্যানোলাসহ (তেলবীজ) অন্যান্য ফসল চাষ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিষ্টি আলু, ভিটামিন সমৃদ্ধ ধানও উদ্ভাবিত হয়েছে এই গবেষণার অধীনে। আশা করা হচ্ছে, এমন দিন বেশি দূরে নয় যখন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বদৌলতে ‘জিএম কলা’ খেয়ে মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস-বি-এর মতো মারাত্মক ব্যাধির প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠবে; গবাদিপশুর ‘ম্যাড কাউ ডিজিস’ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হবে, ফলমূল ও বাদাম উত্পাদন সময়কাল তরান্বিত হবে। মাছ বেড়ে উঠবে আরও দ্রুত। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, উড়িষ্যার কটক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ‘আঘন বোরো’ নামের এক নতুন ধান আবিষ্কার করেছেন, যার চাল না ফুটিয়ে ৪৫ মিনিট স্বাভাবিক পানিতে ভিজিয়ে রাখলেই ভাতের মতো খাওয়া যাবে। ঈষত্ উষ্ণ পানিতে ‘আঘন বোরো’ চাল থেকে ভাত পেতে লাগবে ১৫ মিনিট।
অবধারিতভাবে বায়োটেকনোলজি যত এগোচ্ছে, জিএম ফসল ও খাদ্য উত্পাদন নিয়ে গবেষণার ব্যাপকতা তত বাড়ছে। মানুষ একই সঙ্গে এ নিয়ে উদ্বিগ্নও হচ্ছে। কেননা বড় বড় কোম্পানি এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। তারা মুনাফা ও একচেটিয়া ব্যবসা করায়ত্ত করতে যথোপযুক্ত ‘বায়োসেফটি’ আইন-কানুন মানবে কি না তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ লক্ষ্যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণার ওপর নজরদারি এবং উদ্ভাবিত ফসল বিপণনের অনুমোদনের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ও বিধিবিধান প্রণীত হচ্ছে।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল-২০১০’-এর খসড়া উত্থাপিত হয়েছে। প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের পর এ বিল পার্লামেন্টে অনুমোদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিলের অধীনে জিএম ফুড ও ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অরগানিজম’ (জিএমও) উত্পাদনের স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন ও অনুমোদন সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে।
বাংলাদেশে জিএম ফুড হিসেবে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ‘গোল্ডেন রাইস’, বিটি বেগুনের মতো ফসলসহ বিভিন্ন জিএম ফসল নিয়ে গবেষণা চলছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় আমাদের কৃষি গবেষণা খানিক পিছিয়ে থাকলেও থেমে নেই। সুতরাং বিশ্বে জিএম ফসল নিয়ে চলমান গবেষণা, এর নিয়ন্ত্রণকাঠামো এবং একই সঙ্গে এখানে উপযুক্ত সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ। পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments