চারদিক-বাহাদুরশাহ পার্কে by সুচিত্রা সরকার

বাহাদুরশাহ পার্কের পূর্ব দিকের গেট দিয়ে ঢুকলাম। গেটের ডান পাশে একটা সাইনবোর্ডে চোখ গেল: ‘৮ বার ঘুরলে ১ মাইল ১৭৬০ গজ। যদি হাঁটুন দুবেলা, থাকবে না রোগের জ্বালা।’ এর পরই দেখলাম বৃত্তাকার একটি পাকা রাস্তা। এই পথ ধরে হেঁটেই নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই পার্কটি প্রদক্ষিণ করছে। চারবার, পাঁচবার...আটবার।


আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কিছু চেয়ার। ক্লান্ত ভ্রমণকারীদের বসার জন্য এই ব্যবস্থা। সুস্থ থাকার এই সব আয়োজন পেরিয়ে এগিয়ে যাই স্মৃতিসৌধের দিকে। সিঁড়ির গোড়ায় একটা বাচ্চা ছেলে পত্রিকা বিক্রি করছে। বয়স আট বা সাত। স্মৃতিসৌধ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী, জানো?’
ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিল। ‘একটা ঘর বানাইতে চাইছিল। বানাইতে গিয়া আর বানায় নাই।’ ওর কল্পনার গভীরতায় বেশ মজা পেলাম।
সিঁড়ি বেয়ে স্মৃতিসৌধে উঠি। চারটি পিলারের ওপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামো। ওপরে রয়েছে একটি ডোম। অন্য পাশে একটি ওবেলিস্ক। ওপরে তাকিয়ে রোমাঞ্চিত হই। কেমন ছিল দেড় শ বছর আগে এই জায়গাটা? ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড়িয়ে বিপ্লবীরা কী শপথ নিয়েছিলেন? আর আহত সাথিরা? যাদের ফাঁসির দৃশ্য দেখানোর জন্য ধরে আনা হয়েছিল, তাঁদের চোখের জলে কি এই মাটি ভিজেছিল? শহীদদের লাশগুলো এই ময়দানের গাছে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। কটা শকুন তাঁদের খামচে খেয়েছিল?
স্মৃতিসৌধের একটি পিলারের দেয়ালে যোগব্যায়ামের একটি পোস্টার। ওপরে একটা ঘড়ি। শারীরিক সুস্থতার রকমারি আয়োজন এগুলো। প্রতিটি পিলারের গায়ে কলম, পেনসিল আর সাইনপেনে লেখা অশ্লীল মন্তব্য। দেয়ালে সাঁটানো অসংখ্য পোস্টার। অনেকেই আড্ডায় মেতেছেন স্মৃতিসৌধের ওপরে। তাঁদের প্রত্যেকের পায়ে জুতা। এগিয়ে যাই একজনের কাছে। নাম সজিব। পড়ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। জুতা পরে উঠেছেন কেন জিজ্ঞেস করতেই সপ্রতিভ উত্তর, ‘সবাই ওঠেছে, তাই। আর কোনো নির্দেশনা লেখাও তো নেই কোথাও।’ সিঁড়ি বেয়ে নামতেই চোখে পড়ল আবর্জনার স্তূপের দিকে।
পার্কের মাঝখানে রয়েছে একটি ফোয়ারা। সেটিকে ঘিরে ফুটখানেক উচ্চতার দেয়াল বানানো হয়েছে। সেখানেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে অনেকে। সেখানে বসে পত্রিকা পড়ছেন ইলিয়াস আলী।
পার্কটির নাম কী, জানেন?
প্রশ্ন করতেই জবাব দিলেন, ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক।’
পরে আরেকটি নাম হয়েছে, সেটি কী, জানেন? একটু চিন্তা করে বললেন, ‘পেটে আছে, মুখে নাই।’ তারপর আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘এই যে নাম লেখা আছে, দেখে নেন।’
নির্দেশমতো তাকিয়ে দেখি, স্মৃতিসৌধের ওপরে লেখা রয়েছে ‘১৮৫৭ সনের শহীদদের স্মরণে’।
পাশের একজন বললেন, ‘এটার নাম বাহাদুরশাহ পার্ক।’
প্রশ্ন করি, ‘কারা নির্মাণ করেছে?’
‘অত রিসার্চ করি নাই। অনেক আগে ব্রিটিশরা এইটা বানাইছে। আর স্বাধীনতার পর বাহাদুর শাহ নাম হইছে।’
স্বর্ণব্যবসায়ী নতুন কর্মকার বলেন, ‘পার্ক তো পার্কই। এর আবার নামের কী আছে? এইখানে সন্ধ্যার পর গাঁজা খাওয়া হয়। সেইগুলা নিয়া তো কোনো ব্যবস্থা নাই।’
আবদুল হক খানিকটা জিরোনোর জন্য পার্কে ঢুকেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘পার্কের কোনো যত্ন নাই। টিভিটা নষ্ট, ফোয়ারাটা বন্ধ থাকে। কর্তৃপক্ষ এসব কিছু দেখে না।’
অনেকক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত একজন পাশে বসলেন। মিনাক্ষী দত্ত। কারা শহীদ হয়েছিল, জানেন? দ্রুত উত্তর, ‘ওই দিকে একটা সাইনবোর্ড আছে। আমি পড়িনি। আসলে প্রয়োজন হয়নি তো!’ সাইনবোর্ডটিতে দেখলাম পাঁচ লাইনের একটা ইতিহাস রয়েছে।
কবি নজরুল কলেজে পড়ছেন মাহবুব আলম।
কেন এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, জানেন?
ফোয়ারার একটু দূরে রয়েছে একটি গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ। সেটি দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে বিদ্রোহীদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।’ এ জন্যই স্মৃতিসৌধ বানিয়েছে।’
গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভটির দিকে এগোই।
এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটির দু পাশে পরিচিতিমূলক লিপি খোদাই করা আছে। নবাব আহসানউল্লাহর বড় ছেলে খাজা হাফিজুল্লাহ ১৮৮৪ সালে মারা যান। তাঁর ইংরেজ বন্ধুরা ১৮৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাফিজুল্লাহ স্মরণে এটি উদ্বোধন করেন।
প্রকৃতপক্ষে পার্কটির রয়েছে ভারতবর্ষের রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস।
আঠারো শতকের শেষে এটি ছিল ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড খেলার ক্লাব। বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয় লোকেরা নাম দিয়েছিল আন্ডা। আর এই ক্লাবকে বলত আন্টাঘর। উনিশ শতকে ইংরেজরা এটি কিনে নেয়। ভবন ভেঙে জায়গাটা ফাঁকা করে ফেলে। তখন থেকে এর নাম আন্টাঘরের ময়দান। এখানে ১৮৫৭ সালে বিপ্লবী সিপাহিদের এক প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর জনমনে ভীতির জন্ম দিতে লাশগুলো ময়দানের গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ১৮৫৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণের পর এই ময়দানে এ সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পড়ে শোনানো হয়। সেই থেকে এর নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক। ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসানের জন্য মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুরশাহর শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁরই নামানুসারে পার্কের নামকরণ হয়।
এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণা নেই। তাই যাঁরা এখানে আসছেন, তাঁরা জানতে পারছেন না পার্কটির ইতিহাস।
সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.