চারদিক-গন্তব্য ছাতিয়ানতলী by মোকারম হোসেন
ঢাকা থেকে বের হওয়ার আগেই মাহবুব রেজা পইপই করে বলে দিলেন প্রথমে আবদুল্লাহপুর, তারপর ধলেশ্বরী এক-দুই সেতু, নীমতলা, চালতীপাড়া থেকে চৌধুরী রোড হয়ে সোজা ছাতিয়ানতলী। তবুও পথ ভুলে কিছুটা সামনে হাসাড়ার দিকে চলে গেলাম।
গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, নিশ্চিত হয়ে, তারপর আবার ফিরে এসে চৌধুরী রোড হয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। আমরা মানে আমি, নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া, বিপাশা চক্রবর্তী ও লায়লা। সাকল্যে চারজন। রমনাপার্কে গাছ দেখার অনুষ্ঠান শেষে আমরা মধ্যদুপুরে ঢাকা থেকে বেরিয়েছি। রাজধানীর বিরক্তিকর যানজট আর বিচিত্র দূষণ থেকে খুব সহজেই মুক্তি মিলল। এখন আমাদের চোখের সীমানায় বিস্তৃত শস্যের মাঠ। মুন্সিগঞ্জ অনেক কিছুর পাশাপাশি আলুর জন্যও বিখ্যাত। গ্রাম মানেই গ্রাম। এখানকার সবকিছুই দারুণ উপাদেয় ও উপভোগ্য। গ্রামের সতেজ বাতাস মেখে চলেছি আমরা।
ছাতিয়ানতলীর প্রবেশ পথেই ফজলুর রহমান হাত নেড়ে আমাদের থামিয়ে দিলেন। তিনি আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা, পথ হারানোর কোনো সুযোগ নেই! ফজলু ভাইয়ের উচ্ছ্বাস দেখে আমরাও পুলকিত হয়ে উঠি। প্রকৃতিপাগল মানুষ। প্রকৃতির অতি ক্ষুদ্র সৌন্দর্যেও তিনি উদ্বেল হন। রাতে অফিস থেকে বের হয়ে দেখলেন জোছনায় ডুবে আছে চারপাশ। আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! একেবারে গৃহত্যাগ করার মতো জোছনা। তাত্ক্ষণিকভাবে মত বদলালেন তিনি, আজ আর বাড়ি ফিরবেন না। একটি পরিপূর্ণ চান্নিপসর রাত তাঁকে নিবিড় মমতায় ডাকছে। ছুটলেন ছাতিয়ানতলীর দিকে। ওখানে আগেই চলে গেছেন সাহিত্যিক মাহবুব রেজা।
আমরা মূল সড়ক থেকে কাঁচা পথে নেমে এলাম। এবার মাহবুব রেজাকে দেখা গেল। মোড়লদের মতো লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে হেঁটে এলেন। গ্রামের জন্য একেবারে উত্তম পোশাক। শীত এলে আমি যেমন গায়ে উত্তরীয় জড়ানোর সুযোগ খুঁজি। কিন্তু শহরের সাহেবি কেতায় শাল বড্ড বেমানান। মানান আর বেমানান যা-ই হোক, মন চায় যে! তাঁকে তো আর বাধা দিতে পারি না। এসব কথা এখন থাক, আগে দুপুরের গল্পটা বলি। বিপ্রদা তার কথার ঝাঁপি খুললেন। তাঁরা হাঁটছেন, কথা বলছেন, শুনছেন, দেখছেন। আমি কিছুটা পিছিয়ে। কারণ, ততক্ষণে আমার ক্যামেরার চোখ সচল হয়ে উঠেছে। ছবি তুলছি তো তুলছি।
এবার আমাদের একটি ছোট্ট সেতু পেরোতে হলো। খালে জল নেই তেমন। তারপর খেতের আইল ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটার মধ্যেই হঠাত্ আমার বয়সটা এক লাফে কমে গেল। এই গ্রামের সঙ্গে আমাদের লক্ষ্মণপুর গ্রামের কি কোনো মৌলিক তফাত্ আছে! তাই গ্রামের সব স্মৃতি তরতাজা হয়ে ভাসতে থাকে। আমার চারপাশের সবকিছু যেন আগেই দেখেছি বা দেখিনি। ডোলকলমির ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখি, তার পাশেই মটমটিয়ার ঝোপ, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়াচ্ছে। সরষে ফুলের জমাট গন্ধ পাচ্ছি। বিপাশা আর লায়লা ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখল। সংস্কৃত কবির কবিতায় আছে, ‘সুন্দরী রমণীর পদস্পর্শে অশোক ফোটে।’ কিন্তু আমার মনে হলো ওদের কোমল জাদুস্পর্শে সরষে ফুটেছে। কিংবা এই সোনারং ফুলগুলো আজ সারা দিন ওদের অপেক্ষায় ছিল। আর কয়েক পা এগিয়ে আমরা ছবির মতো একটি বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ছিমছাম পুকুর পাড়, তার পাশে লাউয়ের মাচা, একপাশে সতেজ শাকসবজি বোনা। ঘরে বসতে না বসতেই খাবার আয়োজন। উপাদেয় সব রান্না। অতএব ভূরিভোজ। খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্পের আসর বসল পুকুরঘাটে। ঘাটটাও বেশ বনেদি, ওপরে ইটের চৌচালা, তিন দিকে হেলানো আসন, সিঁড়িগুলো নেমে গেছে জলস্পর্শে। কোত্থেকে একটি বেনেবউ উড়ে এসে বসল পাশের আমগাছে। সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম। বিপ্রদা সবাইকে বেনেবউয়ের গল্প শোনালেন। সেই গল্প শেষ হলে আরও কত গল্প! শিল্প-সাহিত্য-সংগীত কোনো কিছুই বাদ যায় না। এ ফাঁকে ফজলু ভাই হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন। আমরা তাঁকে দশ টাকা বকশিশ দিয়ে আগেই গান থামানোর উদ্যোগ নিলাম।
ওদিকে দুপুর পিছলানো রোদ দ্রুত সরে গিয়ে গাছের ছায়াগুলোকে দীর্ঘতর করে তুলছে। আমরা গ্রামের ভেতর ঘুরব বলে আবার বেরিয়ে পড়ি। মাহবুব রেজা পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। পথে পড়ল একটি পুরোনো হিন্দুবাড়ি। সদর আঙিনায় একটি পূজার ঘর। বাড়ির ভেতরে ধবধবে নিকানো উঠান। পলেস্তারা খসে পড়া একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বিপাশা ছবি তুলল। তারপর পুকুরপাড় ধরে আমরা একটি খোলা প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। দূরে, মাঠপারের সবুজ গ্রামগুলো যেন অনেক রহস্যে ঘেরা। এমন মায়াবি দৃশ্য কতবার দেখেছি, মনে পড়ে না। সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটি শুকনো খাল শুয়ে আছে আমাদের কাছে। আমরা খালপাড় ধরে হাঁটতে থাকি। আবার ফিরে এসে খালপাড়ে বসে পড়ি। চারপাশ নির্জন নিরিবিলি। বিপ্রদার গল্প শুরু হলো। জাতক, পুরাণ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, মহাকাশ, নক্ষত্র, ছায়াপথ সবকিছুতেই তাঁর গভীর জ্ঞান। শীতের বিকেল মানেই সন্ধ্যা। কমে আসছে রোদের তেজ। দূরে, খালপাড়ে আমাদের দৃষ্টিসীমায় একটি সাদা বিন্দু চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে বিন্দুটি বড় হয়, ধবধবে ধুতি পরে কেউ একজন এদিকে আসছেন। তিনি চলে যান আরও অনেক দূরের গন্তব্যে। হয়তো এ পথেই ফিরবেন আবার। আমাদের প্রান্তিক মানুষেরা এভাবেই বেঁচে থাকেন। অনেক কষ্টে, অনেক যন্ত্রণায়।
মাঠপারে কুয়াশার মেখলাগুলো আরও ছাইরং হয়ে এলে আমরা বাড়ির পথ ধরি। পেছনে পড়ে থাকে আমাদের ভালোলাগা খালপাড়, শস্যের মাঠ, দূরের গ্রামগুলো। ততক্ষণে ঝোপঝাড়ের ভেতর অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।
ছাতিয়ানতলীর প্রবেশ পথেই ফজলুর রহমান হাত নেড়ে আমাদের থামিয়ে দিলেন। তিনি আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা, পথ হারানোর কোনো সুযোগ নেই! ফজলু ভাইয়ের উচ্ছ্বাস দেখে আমরাও পুলকিত হয়ে উঠি। প্রকৃতিপাগল মানুষ। প্রকৃতির অতি ক্ষুদ্র সৌন্দর্যেও তিনি উদ্বেল হন। রাতে অফিস থেকে বের হয়ে দেখলেন জোছনায় ডুবে আছে চারপাশ। আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! একেবারে গৃহত্যাগ করার মতো জোছনা। তাত্ক্ষণিকভাবে মত বদলালেন তিনি, আজ আর বাড়ি ফিরবেন না। একটি পরিপূর্ণ চান্নিপসর রাত তাঁকে নিবিড় মমতায় ডাকছে। ছুটলেন ছাতিয়ানতলীর দিকে। ওখানে আগেই চলে গেছেন সাহিত্যিক মাহবুব রেজা।
আমরা মূল সড়ক থেকে কাঁচা পথে নেমে এলাম। এবার মাহবুব রেজাকে দেখা গেল। মোড়লদের মতো লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে হেঁটে এলেন। গ্রামের জন্য একেবারে উত্তম পোশাক। শীত এলে আমি যেমন গায়ে উত্তরীয় জড়ানোর সুযোগ খুঁজি। কিন্তু শহরের সাহেবি কেতায় শাল বড্ড বেমানান। মানান আর বেমানান যা-ই হোক, মন চায় যে! তাঁকে তো আর বাধা দিতে পারি না। এসব কথা এখন থাক, আগে দুপুরের গল্পটা বলি। বিপ্রদা তার কথার ঝাঁপি খুললেন। তাঁরা হাঁটছেন, কথা বলছেন, শুনছেন, দেখছেন। আমি কিছুটা পিছিয়ে। কারণ, ততক্ষণে আমার ক্যামেরার চোখ সচল হয়ে উঠেছে। ছবি তুলছি তো তুলছি।
এবার আমাদের একটি ছোট্ট সেতু পেরোতে হলো। খালে জল নেই তেমন। তারপর খেতের আইল ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটার মধ্যেই হঠাত্ আমার বয়সটা এক লাফে কমে গেল। এই গ্রামের সঙ্গে আমাদের লক্ষ্মণপুর গ্রামের কি কোনো মৌলিক তফাত্ আছে! তাই গ্রামের সব স্মৃতি তরতাজা হয়ে ভাসতে থাকে। আমার চারপাশের সবকিছু যেন আগেই দেখেছি বা দেখিনি। ডোলকলমির ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখি, তার পাশেই মটমটিয়ার ঝোপ, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়াচ্ছে। সরষে ফুলের জমাট গন্ধ পাচ্ছি। বিপাশা আর লায়লা ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখল। সংস্কৃত কবির কবিতায় আছে, ‘সুন্দরী রমণীর পদস্পর্শে অশোক ফোটে।’ কিন্তু আমার মনে হলো ওদের কোমল জাদুস্পর্শে সরষে ফুটেছে। কিংবা এই সোনারং ফুলগুলো আজ সারা দিন ওদের অপেক্ষায় ছিল। আর কয়েক পা এগিয়ে আমরা ছবির মতো একটি বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ছিমছাম পুকুর পাড়, তার পাশে লাউয়ের মাচা, একপাশে সতেজ শাকসবজি বোনা। ঘরে বসতে না বসতেই খাবার আয়োজন। উপাদেয় সব রান্না। অতএব ভূরিভোজ। খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্পের আসর বসল পুকুরঘাটে। ঘাটটাও বেশ বনেদি, ওপরে ইটের চৌচালা, তিন দিকে হেলানো আসন, সিঁড়িগুলো নেমে গেছে জলস্পর্শে। কোত্থেকে একটি বেনেবউ উড়ে এসে বসল পাশের আমগাছে। সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম। বিপ্রদা সবাইকে বেনেবউয়ের গল্প শোনালেন। সেই গল্প শেষ হলে আরও কত গল্প! শিল্প-সাহিত্য-সংগীত কোনো কিছুই বাদ যায় না। এ ফাঁকে ফজলু ভাই হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন। আমরা তাঁকে দশ টাকা বকশিশ দিয়ে আগেই গান থামানোর উদ্যোগ নিলাম।
ওদিকে দুপুর পিছলানো রোদ দ্রুত সরে গিয়ে গাছের ছায়াগুলোকে দীর্ঘতর করে তুলছে। আমরা গ্রামের ভেতর ঘুরব বলে আবার বেরিয়ে পড়ি। মাহবুব রেজা পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। পথে পড়ল একটি পুরোনো হিন্দুবাড়ি। সদর আঙিনায় একটি পূজার ঘর। বাড়ির ভেতরে ধবধবে নিকানো উঠান। পলেস্তারা খসে পড়া একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বিপাশা ছবি তুলল। তারপর পুকুরপাড় ধরে আমরা একটি খোলা প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। দূরে, মাঠপারের সবুজ গ্রামগুলো যেন অনেক রহস্যে ঘেরা। এমন মায়াবি দৃশ্য কতবার দেখেছি, মনে পড়ে না। সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটি শুকনো খাল শুয়ে আছে আমাদের কাছে। আমরা খালপাড় ধরে হাঁটতে থাকি। আবার ফিরে এসে খালপাড়ে বসে পড়ি। চারপাশ নির্জন নিরিবিলি। বিপ্রদার গল্প শুরু হলো। জাতক, পুরাণ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, মহাকাশ, নক্ষত্র, ছায়াপথ সবকিছুতেই তাঁর গভীর জ্ঞান। শীতের বিকেল মানেই সন্ধ্যা। কমে আসছে রোদের তেজ। দূরে, খালপাড়ে আমাদের দৃষ্টিসীমায় একটি সাদা বিন্দু চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে বিন্দুটি বড় হয়, ধবধবে ধুতি পরে কেউ একজন এদিকে আসছেন। তিনি চলে যান আরও অনেক দূরের গন্তব্যে। হয়তো এ পথেই ফিরবেন আবার। আমাদের প্রান্তিক মানুষেরা এভাবেই বেঁচে থাকেন। অনেক কষ্টে, অনেক যন্ত্রণায়।
মাঠপারে কুয়াশার মেখলাগুলো আরও ছাইরং হয়ে এলে আমরা বাড়ির পথ ধরি। পেছনে পড়ে থাকে আমাদের ভালোলাগা খালপাড়, শস্যের মাঠ, দূরের গ্রামগুলো। ততক্ষণে ঝোপঝাড়ের ভেতর অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।
No comments