স্মরণ-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক কমরেড তাজুল by শরাফত হোসেন

বাংলাদেশের মানুষ অনেক রক্তের বিনিময়ে নিজের পছন্দমতো রাজনৈতিক সরকার নির্বাচনের অধিকার অর্জন করেছে। আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে এ গণতান্ত্রিক স্থিতাবস্থায় পেঁৗছানোর পেছনে রয়েছে অনেক বিপ্লবীর আত্মত্যাগ। এদেরই একজন কমরেড তাজুল ইসলাম।


আজ ১ মার্চ স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবমুক্তির সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ তাজুল ইসলামের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৪ সালের এই দিনে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে ১১টি শ্রমিক সংগঠন (পরবর্তী সময়ে স্কপ), ১৫ দল ও ৭ দল আহূত ধর্মঘট সফল করতে গিয়ে স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তাজুল ইসলাম। তাঁর মৃত্যু সারা দেশে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে গতিবেগ সঞ্চার করে। তাজুল ছিলেন 'আদমজী মজদুর ট্রেড ইউনিয়ন'-এর নেতা ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির আদমজী শাখার সম্পাদক। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, সমাজ জীবনে সন্ত্রাস, মানবতার অবমাননার যে বিষায়ন প্রক্রিয়া চলছে, তার বিপরীতে তাজুলের সততা, দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আলোকিত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
চাঁদপুরের মতলব থানার ইছাখালী গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তাজুল। শৈশবে মাতৃহারা হয়ে প্রবল আর্থিক সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে ঢাকা শহরে গৃহভৃত্য, এমনকি আইসক্রিম বিক্রির কাজও করেছেন তিনি। প্রবল প্রতিকূলতা তাঁর শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহকে দমাতে পারেনি। প্রচেষ্টা ও উদ্যমের সঙ্গে মামার অভিভাবকত্বে তিনি শিক্ষা চালিয়ে যান। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন ও বিভিন্ন গণসংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তাজুল ইসলাম। দেশ স্বাধীনের পর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অধ্যয়ন শেষে তিনি সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৪ সালে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন এবং কর্মক্ষেত্র হিসেবে আদমজী জুট মিলকে বেছে নেন। একপর্যায়ে বেসিক ইউনিয়নের কমিটিতে ২৫ শতাংশ বহিরাগত ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের থাকার আইন বাতিল হলে তাজুল আদমজীতে সাধারণ শ্রমিকের কাজ নেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তাজুল যে আদর্শ-প্রেরণার পথ আমাদের দেখিয়ে গেছেন_আমরা কি সে আদর্শের পথ ধরে এগোচ্ছি? আজও শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক ও মেহনতি মানুষের কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। শ্রমিক শ্রেণী আজও উপেক্ষিত, অবহেলিত।
সর্বস্তরের মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন কমরেড তাজুল। এ সংগ্রামে প্রতিকূল পরিস্থিতি, ভয়ভীতির পাশাপাশি সচ্ছল জীবনের সুযোগ-সুবিধার হাতছানিও আদর্শবোধ থেকে টলাতে পারেনি তাজুলকে। আদর্শ বাস্তবায়নে নিত্যদিন জীবনের সঙ্গে পারিপাশ্বর্িক পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়, তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তাই আজও তাজুল ইসলাম আমাদের কাছে আদর্শ ও প্রেরণার মূর্ত প্রতীক হয়ে আছেন।
শরাফত হোসেন

No comments

Powered by Blogger.