হিলারির সফর : বাংলাদেশ ও পাকিস্তান by শহিদুল ইসলাম

এক. 'বাংলাদেশ বিশ্বের মডেল'- বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। আর 'পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্র'- বলেছেন মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ডানা বোরাবাকার। মাত্র ৪০ বছর পর মার্কিন মূল্যায়নের কী পরিবর্তন? ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই অংশ ছিল। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর।


৩০ লাখ মানুষের জীবন আর চার লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে পাকিস্তানি শৃঙ্খল ছিঁড়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র সেদিন পাকিস্তানি গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত একটি রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপে পাকিস্তান পাশে থেকেছে। বিভিন্ন সামরিক প্যাক্টের শক্ত শৃঙ্খলে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাঁধা ছিল। আমেরিকার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল পাকিস্তান। মাত্র ৪০ বছর পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কে আমেরিকার বিচার পাল্টে গেল। আজও যদি বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ভাগ্যে হিলারির সুখ্যাতি জুটত না। জুটত মার্কিন সিনেটর ডানা বোরাবাকারের 'ব্যর্থ রাষ্ট্রে'র তকমা। তাই প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ মার্কিনদের কাছে বাংলাদেশ 'পৃথিবীর মডেল' ও পাকিস্তান 'ব্যর্থ রাষ্ট্রের' খেতাবে ভূষিত হলো কেন?
দুই. সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে পাকিস্তানের সৃষ্টি। মনে হয় পাকিস্তানের প্রয়োজন নয়া সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের ফুরিয়েছে। নতুন বন্ধু খুঁজে পেয়েছে তারা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে লেখা চিঠিতে বোরাবাকার লিখেছেন, 'পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।' বেলুচিস্তানের জনগণের জন্য পাঠানো মার্কিন সাহায্য পাকিস্তান সরকার অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন বোরাবাকার। ওই চিঠিতে তিনি সম্প্রতি বেলুচ জনগণের ওপর পুলিশি অভিযানেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। ওই অভিযানে চারজন বেলুচ নিহত হন। চিঠিতে তিনি আরো লিখেছেন, 'পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী যত দিন সেখানকার আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানাবে তত দিন সেখানে রাজনৈতিক সহিংসতা চলবে। পাকিস্তানের জন্য আমেরিকার সাহায্যের পরিমাণও কমবে।' বেলুচিস্তান ও সেখানকার আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি আমেরিকার এই হঠাৎ দরদ উথলে উঠল কেন? সম্প্রতি পুলিশি আক্রমণে চার বেলুচের মৃত্যুতে তারা গভীরভাবে ব্যথিত। প্রশ্ন জাগে, একাত্তরের পরাজয়ের পর, প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো যখন বোমা মেরে হাজার হাজার বেলুচকে হত্যা করেছিলেন, কোথায় ছিল সেদিন আমেরিকার এই মায়াকান্না? পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, যেদিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তান কেবল ইসলামী রাষ্ট্র নয়, একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। আর পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রকে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে। আজ মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করে এতদঞ্চলের অন্য দেশের মিত্রতা আশা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় ৫ মে স্পষ্ট ভাষায় তা উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ও ভারত- দুই দেশ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশ দুটিকে আমরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেতা হিসেবে দেখি।' (কালের কণ্ঠ ৬.৫.২০১২)। একসময় পাকিস্তানকে তারা এই চোখে দেখত এবং অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত করেছিল। আজ বেলুচিস্তানে চারজন বেলুচের মৃত্যু তাদের কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে; কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু তাদের মানবতাবোধ উজ্জীবিত করতে পারেনি। তাই আমেরিকার আজকের বেলুচপ্রীতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পথ তৈরির উদ্যোগ ছাড়া আর কিছু নয়। বোরাবাকার বলেছেন, 'যত দিন পাকিস্তান বেলুচিস্তানের আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকার দিতে অস্বীকার করবে, তত দিন সেখানে রাজনৈতিক সহিংসতা চলবে।' কে চালাবে? মার্কিনদের মদদপ্রাপ্ত নির্যাতিত বেলুচিরা। সরকারকে দেওয়া সাহায্য কমানো হবে, সেই অর্থ দেওয়া হবে বেলুচদের ওই গোষ্ঠীর হাতে। অস্ত্র দেওয়া হবে, যা পেন্টাগন সচরাচর করে থাকে। কাজেই সবার আশঙ্কা, ভবিষ্যতে পাকিস্তানে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তেই থাকবে। এর শতভাগ মদদ জোগাবে যুক্তরাষ্ট্র।
তিন. 'পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার'- এ জন্য মূলত সে দেশের শাসকশ্রেণী দায়ী। সাম্রাজ্যবাদের কোলে বসে আরামে দোল খাওয়ার পরিণতি আজ টের পাচ্ছেন সে দেশের শাসক, রাজনীতিবিদ, আমলা ও সামন্তবাদী প্রভুরা। গণতন্ত্রহীন পাকিস্তানে সে দেশের সাধারণ মানুষ কোনো দিনই তাদের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। ফলে শাসকশ্রেণী ও মার্কিন অর্থে গঠিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সে দেশের মানুষের বৈরী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দেশটির জন্মের পর থেকেই। ২৪ জন পাকিস্তানি সেনা হত্যার পর সেনাবাহিনীর আঁতে ঘা লাগে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিম্নতম পর্যায়ে চলে যায়। তা ছাড়া পাকিস্তান সরকারের বিনা অনুমতিতে প্রায় প্রতিদিনই ড্রোন আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী হত্যার নামে সেখানে সাধারণ মানুষ হত্যা করে চলেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি বলেছেন, প্রতিবাদ ও নিষেধ করার পরও ড্রোন-হত্যা বন্ধ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। এটা জাতিসংঘের নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন। কিন্তু কে শোনে পাকিস্তানের প্রতিবাদ। সেদিনও ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন আক্রমণে সাধারণ মানুষ খুন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পাক-মার্কিন সম্পর্ক এমন খারাপ জায়গায় চলে গেছে যে পাকিস্তানের ওপর আর ভরসা রাখতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। তাই বেলুচিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে তারা। আজ এটাকে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করছে না। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যকে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করত এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব করেছিল। তাই পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের শরীরে তকমা আঁটা এবং হিলারির সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের প্রশংসা করার তাৎপর্য গভীর। এ দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বিষয়টি বিশ্লেষণ করা উচিত।
চার. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর নারীর প্রশংসা বাক্যে যেন দুই দেশের সরকার আনন্দে দিশেহারা না হয়ে যায়; এ সম্পর্কেও সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৬০ বছরের পুরনো ও পরীক্ষিত বন্ধুকে যদি আজ তারা সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করতে পারে, তাহলে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলে তারা ভারত-বাংলাদেশকেও ওই পর্যায়ে ঠেলে দিতে মুহূর্ত বিলম্ব করবে না। এ দেশে সক্রিয় মার্কিন দালালরা তখন কিছুই করতে পারবে না। ভারত যদি ইরান থেকে তেল আমদানি কমাতে রাজি না হয় তাহলে হিলারির মনে চিড় ধরবে। বর্তমান ভারত সরকারকেও মনে রাখতে হবে, এই সেদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সুনজরে দেখত না। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে তারা সব সময় পাকিস্তানকেই সমর্থন দিয়ে এসেছে। ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির শক্তিতে তা সার্থকভাবে মোকাবিলা করেছে। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণই ভারতকে বহু সমস্যা সমাধানে সাহায্য করেছে। জোটনিরপেক্ষতার কথা আজ আর না-ই বা বললাম। মাঝেমধ্যে ভারতে পাকিস্তানি জঙ্গিদের সন্ত্রাসী হামলাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ফায়দা লুটতে চায়। আমার মনে হয়, ভারতের ঝানু রাজনীতিবিদরা তা ভালোভাবেই বোঝেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এক বিষয় নয়। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন সেটাই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশ সরকারেরও এ বিষয়ে ভাবতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এ দেশের মানুষ। কিন্তু সে বিচারে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মার্কিনদের কাছে বিকিয়ে দিতে পারি না। স্বাধীনতার বিনিময়ে এ দেশের মানুষ পদ্মা সেতুও চায় না। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে মনে রাখতে হবে, মাত্র ৬০ বছরের মধ্যে পাকিস্তান নামক একটি বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হলো। তাই আমি যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি উক্তি বারবার উল্লেখ করি। আমার জীবদ্দশায়ই আমি সেই উক্তিটির সত্যতা যাচাই করে নিতে পেরেছি। তা হলো- 'যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার আর শত্রুর দরকার হয় না।' কথাটি ভারত-বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মনে রাখা দরকার। সেই সঙ্গে ২০০৮ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিদ্ধান্তটিও মনে রাখা দরকার। তা হলো- 'যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে কিন্তু সে পৃথিবীর সব স্বৈরতান্ত্রিক, সামরিকতান্ত্রিক ও মোল্লাতান্ত্রিক সরকারগুলো সমর্থন করে।'
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.