সপ্তাহের হালচাল-হরতালের পথে যাবেন না by আব্দুল কাইয়ুম
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এটা গত বুধবারের ঘটনা। এর পরদিনই মুক্তাঙ্গনে বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল। বিমানবন্দরের নাম বদল ও ‘হামলা-মামলা’র প্রতিবাদে সমাবেশ শেষে বিএনপির মিছিল থেকে একপর্যায়ে ইটপাটকেল ছোড়া শুরু হয়।
তারপর পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা। এর বিরুদ্ধে বিএনপি দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা এবং হরতালসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেয়।
কয়েক দিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গণমাধ্যম সম্পাদকদের জানিয়েছেন, তাঁরা সংসদেও থাকবেন আবার রাজপথে আন্দোলনও করবেন। বিরোধী দল হিসেবে তারা সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন করবে, এতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আন্দোলন মানে কী? যদি ঘন ঘন সমাবেশের নামে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়, মিছিল থেকে বাস ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, তাহলে মানুষ সেটা মেনে নেবে না। প্রতিবাদ করা মানে ভাঙচুর নয়। সাধারণ মানুষের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। এ ব্যাপারে বিএনপি বা অন্য যেকোনো দলকে সতর্ক থাকতে হবে। আন্দোলনের নামে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মতো অদূরদর্শী রাজনীতি থেকে বিএনপিকে বিরত থাকতে হবে।
হরতালের ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’। এটা তো কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু অধিকার থাকলেই তা নির্বিচারে ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। অধিকার থাকা আর অধিকারের প্রয়োগ এক কথা নয়। এ কথা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বিগত বিএনপি সরকারের সময় যখন আওয়ামী লীগ হরতাল ডাকত, তখন সরকারি দল হিসেবে বিএনপিই বারবার হরতাল না করার কথা বলত। বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশের বেদম লাঠিপেটার দৃশ্যগুলোও এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অধিকার থাকা সত্ত্বেও হরতাল করা যে উচিত নয় সে কথা বিএনপিই ক্ষমতায় থাকার সময় একাধিকবার বলেছে। এখন বিরোধী দলে থাকার কারণে রাজনৈতিক অবস্থান বদলানো উচিত নয়।
এটা সত্য যে, আমাদের রাজনীতিতে হরতাল নতুন ব্যাপার না। বিশেষত আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় দেশে লাগাতার হরতাল হতো। কিন্তু নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তো সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। এখনো কেন এত হরতাল করতে হবে? এ ব্যাপারে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিরোধী দলে থাকলেই তারা নির্বিচার হরতাল দিয়ে আসছে। এতে দেশের ক্ষতি তো হচ্ছেই, বিদেশেও আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবাই ধরে নিয়েছিল যে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে। অন্তত হিংসা-হানাহানি ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বন্ধ হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। নির্বাচনের পর রাজপথের চেয়ে সংসদকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নিজেরাই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করে। বিএনপির ইশতেহারে বলা হয়, সংসদ হবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি তারা এও বলে, ‘ইস্যুভিত্তিক ওয়াকআউট ছাড়া কোনো দল বা জোট সংসদের সেশন বা বৈঠক বর্জন করতে পারবে না। কোনো সংসদ সদস্য সংসদের অনুমোদন ছাড়া ৩০ দিনের অধিক অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে।’ নির্বাচনের আগে ছাপার অক্ষরে লেখা কথাগুলো কি এখন কর্পূরের মতো উবে গেল? মাসের পর মাস তারা সংসদ অধিবেশন বর্জন করল। সম্প্রতি অধিবেশনে যোগ দিতে শুরু করলেও প্রায় প্রতিদিনই ওয়াকআউট চলছে। এখন আবার হরতালের হুমকি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো শুধু কথার কথা? নির্বাচনে বিজয়ী হলেই কেবল সেগুলো কার্যকর হবে, আর পরাজিত হলে প্রতিশ্রুতিগুলো নিজেরাই অমান্য করবে? কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল কি এই মনোভাব নিয়ে চলতে পারে? যারা লিখিত প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে কাজ করে, মানুষ কোন ভরসায় তাদের ওপর আস্থা রাখবে?
বিএনপিতে প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের তো অভাব নেই। তাঁরা কেন বোঝেন না, বা দলীয় প্রধানকে বোঝাতে পারেন না যে সংসদই হলো প্রতিবাদের উপযুক্ত স্থান? সেখানে তাঁরা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করবেন। যত কিছু ঝাল ঝাড়ার, সংসদের ভেতরেই ঝাড়বেন। তাতেও যদি যথেষ্ট মনে না হয়, তাহলে সংসদের বাইরেও প্রতিবাদ করবেন। তবে রাজপথ বন্ধ করা যাবে না।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিবাদের এই সৃশৃঙ্খল ধারাটি খুব ভালো বুঝতেন। সে জন্য তিনি পল্টনের মোড়ে ছোট্ট পার্কটিকে মুক্তাঙ্গন ঘোষণা করেছিলেন। যার যত বিক্ষোভ, সব ওই মাঠে করার ফরমানটি তিনিই জারি করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, আজ সেই ছোট্ট পার্কের চত্বরটি ‘ভাড়ায় চালিত গাড়ি’ (রেন্ট-এ কার) রাখার স্থান হিসেবে বেদখল হয়ে গেছে। ফলে এখন মুক্তাঙ্গনের নামে সামনের রাজপথ দখল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমাবেশ করে। পল্টন মোড়ের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ হয়ে থাকে। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। তারপর যখন মিছিল থেকে গাড়ি ভাঙচুর শুরু হয় এবং ছোটাছুটিতে নিরীহ পথচারীকে বাসের নিচে চাপা পড়ে জীবন দিতে হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের সহিংস রাজনীতি কেন করছে?
প্রয়াত জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত মুক্তাঙ্গনটি সমাবেশের জন্য মুক্ত করার দাবিতে এখন বিএনপির সোচ্চার হওয়া উচিত। সেখানে তারা ‘সংসদের বাইরের’ প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। সেটা যদি নিতান্তই ছোট মনে হয়, তাহলে পল্টন ময়দানে যেতে হবে। সেখানে সম্ভব না হলে অন্য কোনো মাঠে যেতে হবে। রাজপথ বন্ধ করে কোনো সমাবেশ না করার ব্যাপারে বিএনপির কাছ থেকে আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ আশা করি। বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে দায়িত্বশীলতা ও শৃঙ্খলা প্রবর্তনে বিএনপি যদি আজ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে, তাহলে দেশের উপকার হবে। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায়, তাহলে তাদেরকেও সংসদ ও মাঠের সমাবেশে আবদ্ধ থাকতে হবে। দেশের জন্য ও বিএনপির জন্য সেটি হবে বিরাট এক সুসংবাদ।
রাজনীতিতে একতরফা কিছু হয় না। সবই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার। হরতালের পথ থেকে বিএনপিকে বিরত রাখার জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগকেও কিছু দিতে হবে। সংসদে তাদের দায়িত্বশীল আচরণ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আমরা এখন এই মর্মে একটি ব্যতিক্রমী আহ্বান আশা করছি। সেটা হবে দলীয় সাংসদদের প্রতি। সংসদে বিরোধী দলের নেতাদের বক্তব্যের সময় তাদের পিনপতন নীরবতা বজায় রাখতে হবে। দেখা যায়, বিএনপির কেউ আলোচনা শুরু করলেই সরকারি দলের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ানো শুরু করেন। এটা বন্ধ করা দরকার। সংসদে বিরোধী দলের কথা শুনতে হবে। রেডিও-বিটিভিতে তাদের কথা উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে। আর এ ব্যাপারে মাননীয় স্পিকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। সংসদে বিরোধী দল যেন কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে পরিবেশ নিশ্চিত করবেন স্পিকার।
এখন দেখা দরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে হরতালে ঠেলে না দিতে কতটা আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে তো মনে হয় না তিনি বিরোধী দলকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে ধরে রাখতে চান। বিএনপির বিরুদ্ধে হুলফোটানো কথাগুলো তো অন্তত তাঁর কাছে কেউ আশা করে না। ক্ষমতা গ্রহণের পরপর তিনি বিএনপি সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় যতটা যত্নশীল ছিলেন, এখন আর তিনি সে অবস্থানে নেই। এটা দুঃখজনক যে তিনি বিরোধী দল, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে রূঢ় মন্তব্য করেন। আসলে রাজনীতিতে সহনশীলতা প্রতিষ্ঠায় সরকারি দলকেই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কাছে আমরা আরও বেশি উদার মনোভাব কামনা করি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশে-বিদেশে যেমন হতাশা আছে, তেমনি আবার সম্ভাবনার কথাও আছে। গত ২৮ অক্টোবর ২০০৯, দি নিউইয়র্ক টাইমস-এ ‘মোর স্কুলস নট ট্রুপস’ (আরও স্কুল, সৈন্য নয়) নামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। লেখক আমেরিকান সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ। তিনি সাংবাদিকতায় দুইবার পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছেন। আফগানিস্তানে আমেরিকা আরও সৈন্য পাঠানোর উদ্যোগ নিলে তার বিরোধিতা করে লেখা নিবন্ধে ক্রিস্টফ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে আমাদের দেশের শিক্ষায় অগ্রগতির প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন, ‘নয়-এগারোর পর পাকিস্তানে মূলত সামরিক খাতে আমেরিকা দেড় হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে, আর বিনিময়ে আজ পাকিস্তান আগের চেয়ে আরও বেশি অস্থিতিশীল। এর বিপরীতে ’৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ ছিল যে বাংলাদেশ, তারা শিক্ষার ওপর এমনভাবে গুরুত্ব দিয়েছে যে...আজ সেখানে উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি। (অথচ পাকিস্তানের উপজাতি এলাকার নারীদের মাত্র তিন শতাংশ শিক্ষিত)।’ তিনি মন্তব্য করেন, এই শিক্ষার বিস্তার বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের ভিত্তি রচনা করেছে, জন্মহার কমিয়েছে এবং স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে। মেয়েরা গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো এনজিওতে ভূমিকা রাখছে, একে তিনি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি বলছেন, পাকিস্তানে যে আল-কায়েদা ভিত্তি গাড়তে পেরেছে এবং বাংলাদেশে পারেনি, এটি তার একটি কারণ, এবং এটা মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষা সমাজের রূপান্তর সাধন করতে পারে।
নিকোলাস ক্রিস্টফের চোখে বাংলাদেশের যেটুকু সাফল্য ধরা পড়েছে, হরতালের রাজনীতিতে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায় সেটা বিরোধী দল ও সরকারের দেখা দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
কয়েক দিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গণমাধ্যম সম্পাদকদের জানিয়েছেন, তাঁরা সংসদেও থাকবেন আবার রাজপথে আন্দোলনও করবেন। বিরোধী দল হিসেবে তারা সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন করবে, এতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আন্দোলন মানে কী? যদি ঘন ঘন সমাবেশের নামে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়, মিছিল থেকে বাস ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, তাহলে মানুষ সেটা মেনে নেবে না। প্রতিবাদ করা মানে ভাঙচুর নয়। সাধারণ মানুষের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। এ ব্যাপারে বিএনপি বা অন্য যেকোনো দলকে সতর্ক থাকতে হবে। আন্দোলনের নামে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মতো অদূরদর্শী রাজনীতি থেকে বিএনপিকে বিরত থাকতে হবে।
হরতালের ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’। এটা তো কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু অধিকার থাকলেই তা নির্বিচারে ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। অধিকার থাকা আর অধিকারের প্রয়োগ এক কথা নয়। এ কথা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বিগত বিএনপি সরকারের সময় যখন আওয়ামী লীগ হরতাল ডাকত, তখন সরকারি দল হিসেবে বিএনপিই বারবার হরতাল না করার কথা বলত। বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশের বেদম লাঠিপেটার দৃশ্যগুলোও এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অধিকার থাকা সত্ত্বেও হরতাল করা যে উচিত নয় সে কথা বিএনপিই ক্ষমতায় থাকার সময় একাধিকবার বলেছে। এখন বিরোধী দলে থাকার কারণে রাজনৈতিক অবস্থান বদলানো উচিত নয়।
এটা সত্য যে, আমাদের রাজনীতিতে হরতাল নতুন ব্যাপার না। বিশেষত আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় দেশে লাগাতার হরতাল হতো। কিন্তু নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তো সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। এখনো কেন এত হরতাল করতে হবে? এ ব্যাপারে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিরোধী দলে থাকলেই তারা নির্বিচার হরতাল দিয়ে আসছে। এতে দেশের ক্ষতি তো হচ্ছেই, বিদেশেও আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবাই ধরে নিয়েছিল যে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে। অন্তত হিংসা-হানাহানি ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বন্ধ হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। নির্বাচনের পর রাজপথের চেয়ে সংসদকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নিজেরাই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করে। বিএনপির ইশতেহারে বলা হয়, সংসদ হবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি তারা এও বলে, ‘ইস্যুভিত্তিক ওয়াকআউট ছাড়া কোনো দল বা জোট সংসদের সেশন বা বৈঠক বর্জন করতে পারবে না। কোনো সংসদ সদস্য সংসদের অনুমোদন ছাড়া ৩০ দিনের অধিক অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে।’ নির্বাচনের আগে ছাপার অক্ষরে লেখা কথাগুলো কি এখন কর্পূরের মতো উবে গেল? মাসের পর মাস তারা সংসদ অধিবেশন বর্জন করল। সম্প্রতি অধিবেশনে যোগ দিতে শুরু করলেও প্রায় প্রতিদিনই ওয়াকআউট চলছে। এখন আবার হরতালের হুমকি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো শুধু কথার কথা? নির্বাচনে বিজয়ী হলেই কেবল সেগুলো কার্যকর হবে, আর পরাজিত হলে প্রতিশ্রুতিগুলো নিজেরাই অমান্য করবে? কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল কি এই মনোভাব নিয়ে চলতে পারে? যারা লিখিত প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে কাজ করে, মানুষ কোন ভরসায় তাদের ওপর আস্থা রাখবে?
বিএনপিতে প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের তো অভাব নেই। তাঁরা কেন বোঝেন না, বা দলীয় প্রধানকে বোঝাতে পারেন না যে সংসদই হলো প্রতিবাদের উপযুক্ত স্থান? সেখানে তাঁরা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করবেন। যত কিছু ঝাল ঝাড়ার, সংসদের ভেতরেই ঝাড়বেন। তাতেও যদি যথেষ্ট মনে না হয়, তাহলে সংসদের বাইরেও প্রতিবাদ করবেন। তবে রাজপথ বন্ধ করা যাবে না।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিবাদের এই সৃশৃঙ্খল ধারাটি খুব ভালো বুঝতেন। সে জন্য তিনি পল্টনের মোড়ে ছোট্ট পার্কটিকে মুক্তাঙ্গন ঘোষণা করেছিলেন। যার যত বিক্ষোভ, সব ওই মাঠে করার ফরমানটি তিনিই জারি করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, আজ সেই ছোট্ট পার্কের চত্বরটি ‘ভাড়ায় চালিত গাড়ি’ (রেন্ট-এ কার) রাখার স্থান হিসেবে বেদখল হয়ে গেছে। ফলে এখন মুক্তাঙ্গনের নামে সামনের রাজপথ দখল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমাবেশ করে। পল্টন মোড়ের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ হয়ে থাকে। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। তারপর যখন মিছিল থেকে গাড়ি ভাঙচুর শুরু হয় এবং ছোটাছুটিতে নিরীহ পথচারীকে বাসের নিচে চাপা পড়ে জীবন দিতে হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের সহিংস রাজনীতি কেন করছে?
প্রয়াত জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত মুক্তাঙ্গনটি সমাবেশের জন্য মুক্ত করার দাবিতে এখন বিএনপির সোচ্চার হওয়া উচিত। সেখানে তারা ‘সংসদের বাইরের’ প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। সেটা যদি নিতান্তই ছোট মনে হয়, তাহলে পল্টন ময়দানে যেতে হবে। সেখানে সম্ভব না হলে অন্য কোনো মাঠে যেতে হবে। রাজপথ বন্ধ করে কোনো সমাবেশ না করার ব্যাপারে বিএনপির কাছ থেকে আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ আশা করি। বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে দায়িত্বশীলতা ও শৃঙ্খলা প্রবর্তনে বিএনপি যদি আজ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে, তাহলে দেশের উপকার হবে। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায়, তাহলে তাদেরকেও সংসদ ও মাঠের সমাবেশে আবদ্ধ থাকতে হবে। দেশের জন্য ও বিএনপির জন্য সেটি হবে বিরাট এক সুসংবাদ।
রাজনীতিতে একতরফা কিছু হয় না। সবই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার। হরতালের পথ থেকে বিএনপিকে বিরত রাখার জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগকেও কিছু দিতে হবে। সংসদে তাদের দায়িত্বশীল আচরণ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আমরা এখন এই মর্মে একটি ব্যতিক্রমী আহ্বান আশা করছি। সেটা হবে দলীয় সাংসদদের প্রতি। সংসদে বিরোধী দলের নেতাদের বক্তব্যের সময় তাদের পিনপতন নীরবতা বজায় রাখতে হবে। দেখা যায়, বিএনপির কেউ আলোচনা শুরু করলেই সরকারি দলের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ানো শুরু করেন। এটা বন্ধ করা দরকার। সংসদে বিরোধী দলের কথা শুনতে হবে। রেডিও-বিটিভিতে তাদের কথা উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে। আর এ ব্যাপারে মাননীয় স্পিকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। সংসদে বিরোধী দল যেন কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে পরিবেশ নিশ্চিত করবেন স্পিকার।
এখন দেখা দরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে হরতালে ঠেলে না দিতে কতটা আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে তো মনে হয় না তিনি বিরোধী দলকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে ধরে রাখতে চান। বিএনপির বিরুদ্ধে হুলফোটানো কথাগুলো তো অন্তত তাঁর কাছে কেউ আশা করে না। ক্ষমতা গ্রহণের পরপর তিনি বিএনপি সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় যতটা যত্নশীল ছিলেন, এখন আর তিনি সে অবস্থানে নেই। এটা দুঃখজনক যে তিনি বিরোধী দল, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে রূঢ় মন্তব্য করেন। আসলে রাজনীতিতে সহনশীলতা প্রতিষ্ঠায় সরকারি দলকেই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কাছে আমরা আরও বেশি উদার মনোভাব কামনা করি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশে-বিদেশে যেমন হতাশা আছে, তেমনি আবার সম্ভাবনার কথাও আছে। গত ২৮ অক্টোবর ২০০৯, দি নিউইয়র্ক টাইমস-এ ‘মোর স্কুলস নট ট্রুপস’ (আরও স্কুল, সৈন্য নয়) নামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। লেখক আমেরিকান সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ। তিনি সাংবাদিকতায় দুইবার পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছেন। আফগানিস্তানে আমেরিকা আরও সৈন্য পাঠানোর উদ্যোগ নিলে তার বিরোধিতা করে লেখা নিবন্ধে ক্রিস্টফ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে আমাদের দেশের শিক্ষায় অগ্রগতির প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন, ‘নয়-এগারোর পর পাকিস্তানে মূলত সামরিক খাতে আমেরিকা দেড় হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে, আর বিনিময়ে আজ পাকিস্তান আগের চেয়ে আরও বেশি অস্থিতিশীল। এর বিপরীতে ’৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ ছিল যে বাংলাদেশ, তারা শিক্ষার ওপর এমনভাবে গুরুত্ব দিয়েছে যে...আজ সেখানে উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি। (অথচ পাকিস্তানের উপজাতি এলাকার নারীদের মাত্র তিন শতাংশ শিক্ষিত)।’ তিনি মন্তব্য করেন, এই শিক্ষার বিস্তার বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের ভিত্তি রচনা করেছে, জন্মহার কমিয়েছে এবং স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে। মেয়েরা গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো এনজিওতে ভূমিকা রাখছে, একে তিনি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি বলছেন, পাকিস্তানে যে আল-কায়েদা ভিত্তি গাড়তে পেরেছে এবং বাংলাদেশে পারেনি, এটি তার একটি কারণ, এবং এটা মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষা সমাজের রূপান্তর সাধন করতে পারে।
নিকোলাস ক্রিস্টফের চোখে বাংলাদেশের যেটুকু সাফল্য ধরা পড়েছে, হরতালের রাজনীতিতে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায় সেটা বিরোধী দল ও সরকারের দেখা দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments