খুনি রোবট-এখন আর কল্পকাহিনির বিষয় নয় by জোহান হারি

স্বশাসিত খুনি রোবটের যুগ এসে গেছে: আঁধারে, নীরবে, ত্বরিত। এটা এখন আর দূরবর্তী কোনো ব্যাপার নয়। ইতিমধ্যে খুনি রোবট মোতায়েন করা হয়েছে। আর যে হারে ব্যবহার বাড়ছে, তাতে এটা একবিংশ শতাব্দীতে ধনী দেশগুলোর যুদ্ধের প্রধান ধরন হয়ে উঠবে। এসব তথ্য শুরুতে কারও কাছে একেবারে উদ্ভট মনে হতে পারে।


কতগুলো যন্ত্র পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া হবে, যেগুলো নিজের সিদ্ধান্তে খুন করবে, এমন যন্ত্রের ধারণা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলোতে ভরপুর: যন্ত্রমানব আরনল্ড সোয়ার্জনেগার ট্রাক উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ‘হাস্তা লা ভিস্তা, বেবি’—এমন দৃশ্য তো চলচ্চিত্রে অনেকে দেখেছে। কিন্তু ঘরে বসে কেউ টের পেতে না-পেতেই মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এমন ধারণা চলচ্চিত্রের পর্দা থেকে রণক্ষেত্রে চলে এসেছে। প্রযুক্তিগত রূপান্তর এত দ্রুত আমাদের জানা পৃথিবীকে পাল্টে দিচ্ছে।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীতে কোনো রোবট ছিল না। ২০০৫ সালের শেষ নাগাদ তাদের রোবটের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ৪০০। আর বর্তমানে আছে ১২ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ বছরের মধ্যে স্বশাসিত রোবট রণক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে।
ন্যাটো বাহিনী এখন বেশ কয়েক ধরনের খুনি রোবট ব্যবহার করে। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে কোনো ড্রোন হামলার মানে বিমান থেকে মানুষের ওপর বোমা ফেলে কোনো রোবট। বোতাম চাপলে রোবট উড়ে যায়, হত্যা করে, ফিরে আসে। নিচের রণক্ষেত্রে সেই রোবট-ভ্রাতারা সোর্ডস (SWORDS) নামে পরিচিত: মানুষের আকারের এসব রোবট নিজের চারপাশে ৩৬০ ডিগ্রি এলাকায় দেখতে এবং লক্ষ্য ‘বেছে নিয়ে’ নিজের মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে সক্ষম। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে পরের প্রজন্মের ওয়ারবটের ওপর। সেগুলোর তুলনায় বর্তমানের রোবট একেবারে খেলনা মনে হবে।
এখন অধিকাংশ রোবট নিয়ন্ত্রণ করেন কোনো না কোন সেনাসদস্য; অনেক ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মাইল দূরে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের সাহায্যে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে পাঠানো সংকেত আটকে দেওয়ার জন্য বিদ্রোহীরা নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার করছে। সংকেত আটকে গেলে রোবটের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়; রোবটটি ‘মৃত্যুবরণ’ করে। সুতরাং সামরিক বাহিনী রোবটের মধ্যে ডুকিয়ে দিচ্ছে ‘স্বশাসন’; ফলে সংকেত আসা থেমে যাওয়া মাত্রই রোবটগুলো নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। এই সিদ্ধান্তগুলো নেয় পূর্বনির্ধারিত কোড অনুযায়ী।
পেন্টাগন ও সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক পি ডব্লিউ সিংগারের মতে, মানুষের যুদ্ধের ইতিহাসে এই পরিবর্তন অন্যতম মৌলিক পরিবর্তন। যুগ যুগ ধরে মানুষ এমন অস্ত্র তৈরি করে চলেছে, যা প্রতিনিয়ত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক দূরত্বে থেকে অধিক সংখ্যায় মানুষ হত্যা করা সম্ভব করে তুলছে। কিন্তু এসব রোবট নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অধিকতর ‘সূক্ষ্মভাবে’ খুন করার বিষয়ে আগের প্রযুক্তি মানুষকে সক্ষম করে তুলেছে; কিন্তু যখন রোবটকে স্বশাসিত হিসেবে তৈরি করে রণক্ষেত্রে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন আর যুদ্ধটা নিজে লড়া হয় না। যন্ত্র লড়ে। যুদ্ধের কর্তা বদলে যায়।
এভাবে লড়াকে যুদ্ধের অধিকতর নিরাপদ আদল মনে করে সামরিক বাহিনী। পেন্টাগনের জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ডের গর্ডন জনসন ওয়ারবট সম্পর্কে বলেছেন, ওয়ারবটরা ভয় পায় না। যে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাও তারা ভোলে না। পাশেরজন গুলিবিদ্ধ হলেও তারা কোনো ধার ধারে না। তারা তো মানুষের চেয়ে ভালোভাবে যুদ্ধ করবে। কোনো সেনাসদস্য যদি আরলিংটনে বসে কান্দাহারে হত্যা করতে সক্ষম হন, তবে সেই সেনার জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলা কেন?
কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে তা এই প্রযুক্তিগত আশাবাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না। রোবটের প্রোগ্রামে নিয়মিতভাবে ভুল হবে। কারণ সব প্রাযুক্তিক প্রোগ্রামিংয়ে নিয়মিত ভুল হয়। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি রোবট ব্যবহূত হয় কারখানাগুলোতে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় চার শতাংশ কারখানায় ‘বড় ধরনের রোবট-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে’। এসব দুর্ঘটনার ধরন অনেকটা কোনো মানুষের ওপর গলিত অ্যালুমিনিয়াম ঢেলে দেওয়া বা কাউকে তুলে নিয়ে কনভেয়ার বেল্টে স্থাপন করে দেওয়া, যা তাকে টুকরো টুকরো করে কোনো গাড়ির আকৃতি দিয়ে দেয়। কয়েক বছর আগে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি একটি কারখানা পরিদর্শনে গেলে একটি রোবট তাঁকে আক্রমণ করে। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এসব রোবট কিন্তু হত্যার কাজে তৈরি করা হয়নি।
টেলিফোনে ফোন বিল পরিশোধ করতে গিয়ে কোনো রোবটের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটি কতটা বিরক্তিকর, একবার ভাবুন তো। আর এবার ভাবুন, আপনার বুক বরাবর মেশিনগান তাক করে আছে এক রোবট!
রোবটের পক্ষে আপেল আর টমেটোর পার্থক্য করাই প্রায় অসম্ভব: কেমন করে এরা যোদ্ধা ও বেসামরিক ব্যক্তির পার্থক্য করবে? রোবটের কাছে তো আপনি দয়া ভিক্ষা করতে পারেন না, রোবটের সহানুভূতি জাগাতে পারেন না। আর পরে শাস্তি দেবেন কাকে? হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মার্ক গারলাসকো বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করার জন্য প্রয়োজন পড়ে অধিকার লঙ্ঘন ও এর পেছনে কোন উদ্দেশ্য। বেসামরিক ব্যক্তি খুন করতে চাওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই যন্ত্রের...যদি উদ্দেশ্য না-ই থাকে, তাহলে এরা কি যুদ্ধাপরাধ করতে অক্ষম?’
আগ্রাসী শক্তির জন্য যুদ্ধকে সহজ করে দেয় রোবট। রোবটের সাহায্যে নিজের জনগণের অনেক কম শারীরিক ঝুঁকি নিয়ে শত্রুপক্ষের অনেক মানুষ হত্যা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, যুদ্ধকে তারা ‘মূলত সংঘর্ষহীন প্রকৌশলগত চর্চা’র বিষয়ে পরিণত করবে।
ভিয়েতনামে প্রকৃতপক্ষে কোনো মার্কিন সেনা মারা না পড়লে যুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন কি আসলে শেষ হতো অথবা আরও অনেক বছর ধরে ভিয়েতনামি জনগণকে সুশৃঙ্খলভাবে হত্যা কি অব্যাহত থাকত না? যদি আফগানিস্তান বা ইরাকে কোনো পশ্চিমা সেনা না মরত, তবে হত্যা বন্ধের আহ্বান কি এতটা জোরালো হতো? অন্য পক্ষের বেসামরিক ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের প্রধান প্রণোদনা দিয়েছে—এমনটা হলে ভালো লাগত। কিন্তু এ ব্যাপারে সংশয় আছে। ব্যাপারটা এমন: ‘আমাদের’ নিরাপদে এ পরিস্থিতির বাইরে নিয়ে এসো, আমরা ‘তাদের’ খুন করতে আরও ইচ্ছুক হব।
শত্রুকে হত্যা করতে ওয়ারবট আমাদের নিবৃত্ত কম করবে। যখন কোনো মানুষ অন্য কারও সামনে দাঁড়িয়ে, যখন একে অপরের চোখে চোখ রাখে, তখন পরস্পরকে খুন করা কঠিন হয়ে ওঠে। শত্রু অর্ধেক পৃথিবী দূরে হলে তাকে হত্যা সহজ। মুখোমুখি অবস্থায় প্রায় অচিন্তনীয় ব্যাপার রোবটের সাহায্যে সাধন করা সম্ভব হয়।
শুরুতে ‘আমরা’ ওয়ারবট দিয়ে যুদ্ধ করলে কম লোক হারাব, কিন্তু এটা শেষ পর্যন্ত ‘আমাদের’ ওপর আরও বড় মাপের হামলাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্য সার্জেন্ট স্কট স্মিথ দম্ভ করে বলেছেন, ‘ওয়ারবট হামলার শিকার মানুষের মধ্যে প্রায় অসহায়ত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে...প্রচণ্ড আঘাত ও ত্রাস সৃষ্টি করে।’ সন্ত্রাস কিছু মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে পারে বা তাদের দমিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু অনেকে এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার মধ্যে জন্ম নেয় পাল্টা আঘাতের দৃঢ়প্রত্যয়।
ভেবে দেখুন, যদি ডোভার সমুদ্রসৈকত আর ওয়েস্টমিনস্টারের আকাশ তোরাবোরা বা বেইজিং নিয়ন্ত্রিত রোবটে বোঝাই থাকত আর রোবটগুলো যেকোনো সময় গুলি ছুড়তে সক্ষম হতো, তাহলে অবস্থাটা কেমন হতো। কেউ কেউ পালিয়ে যেত আর অনেকে প্রতিশোধ হিসেবে শত্রু হত্যায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতো। লেবানীয় সম্পাদক রামি খৌরি বলেন, ২০০৬ সালে মানবহীন ইসরায়েলি ড্রোনগুলো যখন লেবাননে হামলা চালায়, তখন শুধু প্রতিরোধের চেতনার বৃদ্ধিই ঘটেছে; আরও বেশি করে মানুষ হিজবুল্লাহকে সমর্থন করেছে।
আমাদের বিজ্ঞানের প্রতিভা কাজে লাগানোর বা বিলিয়ন-বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার এটা কি যৌক্তিক পথ? আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ওপেনহেইমার ও আন্দ্রেই শাখারভসহ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে যে বিজ্ঞানীদের ভূমিকা অপরিহার্য, তাঁরা বিভীষিকার কথা ভেবে নিজেদের সৃষ্টির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, এগুলো নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়েছিলেন। ইলাহ নুরবাখশের মতো বিশিষ্ট রোবোটিকস-বিজ্ঞানীরা এখনই এগিয়ে আসছেন; দাবি তুলেছেন, এখনই স্বশাসিত সামরিক রোবটের বিকাশ নিষিদ্ধ করা উচিত।
এমন কিছু ঘৃণ্য প্রযুক্তি আছে, যার বিরুদ্ধে আমরা সরাসরি অবস্থান নিই। আমরা ওয়ার লেজার নিষিদ্ধ করেছি। কারণ এটা বিষাক্ত গ্যাস তৈরির পাশাপাশি মানুষের স্থায়ী অন্ধত্ব সৃষ্টি করে। আমরা যদি চাই, তাহলে যে কনভেয়র বেল্ট আমাদের টেনে নিচ্ছে রোবট-যুদ্ধের খুব কাছাকাছি, তা আমরা থামাতে পারব।
জীবন নেওয়ার উন্মত্ত পথে না গিয়ে জীবন রক্ষার দিকে আমরা সব অর্থ আর কর্মপ্রচেষ্টাকে পরিচালিত করতে পারি। কিন্তু এ জন্য সিদ্ধান্তটা আগে নিতে হবে। আমরা কি ওয়ারবটের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে চিরদিনের মতো বলব, ‘হাস্তা লা ভিস্তা, বেবি’?
দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জোহান হারি: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.