সাদাকালো-একুশের মাস-তামামি by আহমদ রফিক

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শেষ হলো_এবার মাস-তামামি। প্রতিবছরের মতো এবারও আবেগের জোয়ার, বানভাসি আনুষ্ঠানিকতার বিপুল আয়োজন বরং এবার কিছুটা বেশি। কারণ আগামী বছর একুশের ৬০ বছর, তার চালচিত্র রচনা এ বছর অনেক অনেক আয়োজনে।


সম্ভবত এর আরেকটি কারণ রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালনের জাঁকজমকপূর্ণ প্রস্তুতির আবহ।
এবারের একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজন সব কিছু মিলে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। মহানগরী ঢাকা ফেব্রুয়ারি আড়ম্বরে মেতেছে অনেকটা অভাবিতরূপে_একুশে-রবীন্দ্রনাথ একাকার করে, যেন 'অলরোড্স লিড টু রোম'-এর মতো তাৎপর্যে। অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠান, মঞ্চ থেকে মঞ্চে বার্তা বয়ে যায় : 'একুশ আমার গর্ব, একুশ আমার অহংকার।' কোথাও বা নতুন ঘোষণা 'একুশ আমার পরিচয়'।
শ্রোতা-দর্শক আবেগে আপ্লুত, উদ্দীপ্ত, জাতিসত্তার চেতনা যেন নতুন করে প্রাণ পেয়ে যায়, উজ্জীবিত হয়ে উঠে নানা উচ্চারণের গভীরতায়। মনে হতে থাকে, এ দেশ বাংলা-বাঙালির ভাষিক রাষ্ট্র এবং তা সত্যিকার অর্থে। প্রতিবেশী রাজ্যের বাংলাভাষী অনেকের মনে অনুরূপ আবেগের ছোঁয়া লাগে। সেখানেও কিছু অনুষ্ঠান। আবার কেউ কেউ একুশে-দর্শনে ঢাকায় এসে পড়েন_তাঁরাও আপ্লুত, আবেগে উজ্জীবিত। কবির ভাষা যেন সত্য হয়ে ওঠে 'এ দেশ আমার গর্ব, এ মাটি আমার চোখে সোনা' এবং তা ভাষিক চেতনা ঘিরে।
বেশ কয়েক বছর ধরে এক তরুণকে দেখেছি নিয়মিত একুশের টানে ঢাকায় আসতে। এবার অন্য এক তরুণ, নাম তার তমাল_কালীদাস, রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে তার আবেগ নিজেকে খুঁজে পায় একুশের বর্ণাঢ্য আয়োজনে। হঠাৎ মনে হয় 'নিজ রাজ্যে সে বুঝি পরবাসী'_একুশের ছবি তার সঙ্গী হয়, ভবিষ্যৎ স্মৃতির আধার। তার চোখে-মুখে আবেগের উৎসার_যে আবেগের উৎস সে খুঁজে পায় না নিজ বাসভূমিতে। তার ভাষায় সে 'নিজ বাসভূমে পরবাসী'। পুরনো কথা তবু সদর্থক তাৎপর্যে নতুন।
কিন্তু বায়ান্নে সামুদ্রিক বিস্তারে যা ঘটেছিল, তার মর্মবস্তু যে এখন ফাঁপা উচ্ছ্বাসের আয়োজনে পরিণত, তাও আবার এক মাসের জন্য, সে কথা জানে না ওই বিদেশি তরুণ। অবশ্য জানে এবং বোঝে বায়ান্নর জীবিত ভাষা-সংগ্রামীরা, সংগ্রামী বন্ধুরা। তাই তাদের দুঃখ অপরিসীম। ঠিক সেভাবে বুঝতে পারে না বর্তমান প্রজন্মের বাংলাদেশি তরুণ, অবশ্য কিছুসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে। না বোঝার প্রধান কারণ, সমাজ-বাস্তবতা এখন অনেক পাল্টে গেছে। সেটাই তাদের জন্য সত্য। শুধু তরুণ নয়, বয়স্করাও ওই স্রোতে ভাসমান।
তাই দেখি এই বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যেই কোনো কোনো বৈঠকে বা আলোচনা সভায়, এমনকি ভাষা-সংগ্রামীর সংবর্ধনা সভায়ও উচ্চারিত হয় এমন কথা_ইংরেজি এখন জীবনের বাস্তবতা, সামাজিক সত্য, এর সাহায্য না নিলে জীবন-জীবিকার পথ সোনারঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, উচ্চশ্রেণী বা মধ্যশ্রেণী_সব শ্রেণীর তরুণদের জন্যই এই কথা সত্য।
এই বাণী তরুণদের কাছেও বাস্তব হয়ে ওঠে, তাদের বক্তব্যে ও বিশ্বাসে এমন সত্যই ধরা পড়ে। এ পটভূমি বা বাস্তবতা তৈরির দায় তরুণদের নয়, সরকারের_সেই স্বাধীনতার পর্ব থেকে এযাবৎ শাসনকার্য পরিচালক প্রতিটি সরকারের। শুরুতে কিছুটা উদ্যোগ নেওয়া হলেও (যে কারণে সচিবালয়ে ও শিক্ষার দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম চলছে) তা সর্বস্তরে বিশেষ করে শিক্ষার সর্বস্তরে পেঁৗছায়নি।
পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে দেদার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপক আয়োজনে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর চেষ্টাটাও চালানো হয়নি। স্বভাবতই অবস্থা এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে বিদেশি ভাষা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনিবার্য ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারিতেও নানা আলোচনায় এমন বিশ্বাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ সত্ত্বেও জাগতিক প্রয়োজনে বিদেশিনীকে (ইংরেজি ভাষা) জাতীয় জীবনের অন্দরমহলে অভ্যর্থনা জানাতে হবে, ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সড়গড় করে তুলতে হবে। সর্বজনীন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে ভুলে-ভ্রান্তিতে এর ছাপ আমাদের চেতনায় পড়ছে এবং যে ছাপ ক্রমে গভীর ও ব্যাপক হতে চলেছে।
এ বছর ফেব্রুয়ারির মাস-তামামি করতে গিয়ে আমাদের হৃদয়ে-মননে স্ববিরোধিতার যে তরঙ্গাঘাত, তা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই তা ঘটে। তবে এ বছর একুশের আড়ম্বর যেমন বেশি, বিপরীত স্রোতের প্রকাশও তেমনি। ভাষিক আবেগে ভাসমান মহানগরীতে অনেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে ওই বাঙালিয়ানায় স্ববিরোধিতার প্রবল প্রকাশ দেখতে পেয়েছি। যেমন_উচ্চশিক্ষিত এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবিশেষের (সাবেক উপাচার্যও বাদ পড়েননি) বক্তব্যে, তেমনি মধ্যবিত্ত কর্মজীবী নারী-পুরুষের কণ্ঠে। বক্তব্য তাদের একই। জৈবনিক প্রয়োজনে, বিশ্ব কাছে আসার কারণে আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকে মাতৃভাষার চেয়ে গুরুত্ব দিতেই হয়। তা না হলে জাতীয় পর্যায়ে আমরা দুর্গতির শিকার হব। মাতৃভাষা থাকুক না সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গনজুড়ে।
বায়ান্ন থেকে ষাটের দশকের ছবিটা একবার দেখে নেওয়া যাক। পঞ্চাশের দশকে একুশের জোয়ার, রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতার বাঁধ ভেঙে এক বাঁকফেরা পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। সেই ধারায় চুয়ান্ন সালে সংস্কৃতিতে ও রাজনীতিতে অভাবিত পরিবর্তন এবং ষাটের দশকে সেই ধারায় বাঙালি জাতীয়তাবোধের কী আবেগদীপ্ত প্রকাশ। বাঙালিয়ানার সে প্রকাশ ঘরে-বাইরে সর্বত্র। এমনকি পোশাকে-আশাকে, আচরণে-ব্যবহারে এবং নানাবিধ চর্চায়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তার তুমুল প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে সুভাষ-সুকান্ত পর্যন্ত সে জাতীয়তাবোধে দীপ জ্বালিয়েছেন, সাহস ও উদ্দীপনা জুগিয়েছেন।
আবার সেই ষাটের দশকেও দেখেছি বাংলা ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতার প্রকাশ। খবরটা কাগজে ছাপা হয়েছিল_এক বাঙালি কর্মকর্তা তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীকে ইংরেজির বদলে বাংলা ভাষায় ছুটির দরখাস্ত লেখার কারণে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন। তা নিয়ে পানি কত দূর গড়িয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে তখন জোয়ারটা ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে। সেই টানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও ওই জোয়ারের ধারা কাজে লাগাতে পারিনি।
দিন গেছে, বছর গেছে, একুশের আবেগদীপ্ত উদ্যাপন সত্ত্বেও বাংলাকে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা যায়নি। অথচ সে সম্ভাবনা যথেষ্টই অনেক আবেগ, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বদেশে। সে ক্রান্তিক্ষণে আবেগের প্রকাশ ছিল বহুমাত্রিক। কিন্তু বিদেশি শাসন-সংস্কৃতির অতীত-প্রভাব থেকে সম্ভবত পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি আমরা, পারিনি বোধ হয় মুক্ত স্বদেশও। তাই বাংলা, বাঙালিয়ানা ও জাতিসত্তার প্রকাশ নিয়ে জাতীয় জীবনে যা ঘটার তা-ই ঘটছে। আন্তর্জাতিকতার অজুহাতে জাতীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। এ বিপরীত ধারা আরো জোরদার হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে অযৌক্তিক যুক্তি উত্থাপনের মাধ্যমে। সেই টানে মাতৃভাষা বিহনে সর্বজনীন স্তরে জাতীয় উন্নতি যে সম্ভব নয় এ সহজ সত্য আমরা অস্বীকার করে চলেছি। এবং সেটা যে শিক্ষিতজনার শ্রেণীস্বার্থের কারণে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তরুণ প্রজন্ম তাই ফেব্রুয়ারি মাসটাকেই বাংলা-বাঙালিয়ানার মাস হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। এ সময় গভীর উচ্চারণে তার প্রকাশও ঘটায় গর্ব ও অহংকারের কথা বলে। যে গর্ব-অহংকার বৈষয়িক বাস্তবতায় ঠাঁই পায় না। তবু ব্যতিক্রম বলে কথা। ঠিক পূর্বোক্ত ষাটের দশকের ঘটনার বিপরীত চরিত্র বিস্ময় জাগায়। কয়েক দিন আগে একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর_একজন উদীয়মান মডেল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন ইংরেজি ভাষায় লিখে। এবং সে কারণে সাক্ষাৎকার দিতে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হন তিনি। শেষ পর্যন্ত বাংলায় জীবনবৃত্তান্ত লিখে জমা দিতে হয়। চাকরিও জোটে।
বিরল ঘটনা বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায়। তবু সত্য যে বাঙালিয়ানার একদা-জোয়ারের কিছু ঢেউ এখনো অবশিষ্ট আছে। সেখানেই আমাদের ভরসার জায়গাটা দেখতে পাই। এমন ঐতিহ্যিক বিশ্বাস কিছুসংখ্যক তরুণের মধ্যেও এ মাসের অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেখতে পেয়েছি। আবারও বলি, ভরসা সেখানেই। কিন্তু তবু বলব, এ ভরসার ভিত দুর্বল এবং পাল্টা স্রোত এত প্রবল যে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিপরীতটাই সত্য হয়ে উঠেছে, যেখানে বাংলার ঠাঁই নেই। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তা রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে বর্জিত; এর স্থান শুধু সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায়। ফেব্রুয়ারির মাস-তামামিতে এটাই শেষ কথা।

লেখক : ভাষাসৈনিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কবি

No comments

Powered by Blogger.