অভিমত ভিন্নমত
কোনো সরকারই শেষ সরকার নয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠানে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তনের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরে বলেন, যারা নাম পরিবর্তন করেছিল তাদের শিক্ষা দিতেই এই নাম পরিবর্তন।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় যেসব স্থাপনা তৈরি ও নামকরণ করেছিল, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেগুলোসহ কয়েক শ স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছিল। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘চারদলীয় জোট কি এ কথা ভাবেনি যে তাদের সরকারই শেষ সরকার নয়?’
প্রধানমন্ত্রী যেদিন এসব কথা বলেন, ঠিক তার আগের দিন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের সমালোচনা করে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তারা কখনো অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি।’
আমরা নিরীহ জনগণ, কী আর বলব! এই দুই দলের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ আর আক্রমণ দেখে মনে হয়, দেশের জনগণের কোনো সমস্যা নেই, কখনো ছিল না। স্থাপনার নাম পাল্টানো, পরস্পরকে ‘শিক্ষা দেওয়া’ই ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের প্রধান কাজ। গত ১৯ বছরের সংসদীয় গণতন্ত্র এভাবেই চলছে। তারা কেউ জনগণের কথা ভাবছে না। পাল্টাপাল্টি উদ্যোগ হিসেবে স্থাপনার নাম বদলানোয় জনমনে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তা যদি তারা একটু ভাবত, তাহলে এই অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর পদক্ষেপগুলো নিতে পারত না।
জনজীবনের নানামুখী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা প্রয়োজন। লাখ লাখ শিক্ষিত ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান নেই। জিনিসপত্রের দাম যতটা সহনীয় মাত্রায় কমে আসবে বলে এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ততটা কমেনি। বরং কিছু দ্রব্যের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তার মধ্যে কোনো কোনো পণ্যের দাম হঠাত্ করে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কারসাজিতে এমনটি ঘটে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও এর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। কৃষক অনেক অর্থ ব্যয় করে, কঠোর পরিশ্রম করে যে কৃষিপণ্য ফলায়, তার ভালো দাম পায় না। অথচ সেই কৃষিপণ্য কয়েক ধাপ পেরিয়ে শহর-বন্দরের বাজারে পৌঁছে এমন চড়া দামে বিক্রি হয় যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। বাজারব্যবস্থার এই অসংগতি বা কারসাজির স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই করা হয় না। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তা কম, অন্যায়-অবিচারের শিকার হলে তারা বিচার পায় না। সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসী, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির উপদ্রবও চলছে সারা দেশে।
নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের দৃষ্টি থাকবে জনগণের ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধার দিকে। সাধারণ মানুষের আয়-উন্নতির পথগুলো সুগম করার মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, দেশের সর্বত্র শান্তিরক্ষার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমরা দেখে আসছি, ক্ষমতাসীন সরকারগুলো সব সময় ব্যস্ত থাকে নিজেদের আখের গোছানো আর বিরোধী দল বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামলাতে। প্রতিপক্ষ দলকে মোকাবিলা করাই যেন সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। সেই মোকাবিলার রূপ হয় কখনো ‘শিক্ষা দেওয়া’র মতো নানা পদক্ষেপ, কখনো অপ্রীতিকর ভাষায় সমালোচনা, কখনো পুলিশি দমন-পীড়ন, কখনো বা দলীয় লোকজনদের দিয়ে প্রতিপক্ষদের ওপর হামলা চালানো। এগুলো জনগণ পছন্দ করে না। সরকারের এসব আচরণে জনমনে এমন ধারণা হয় যে জনগণের সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশাগুলো সরকারের বিবেচনার মধ্যেই নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সম্পর্কে বললেন, ‘তারা কখনো ভাবেনি যে তাদের সরকারই শেষ সরকার নয়।’ আসলে এই কথাটা সব সরকারের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমান সরকারের জন্যও বটে। কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়।
ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে বিএনপি আবার ক্ষমতায় যাবে। তখন তারা সব স্থাপনার নাম আবার বদলে দেবে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলবে? একসময় তো থামা দরকার। উভয় পক্ষকেই।
আহমেদ মহিউদ্দিন
চট্টগ্রাম।
আদিবাসীদের ভাষার কী হবে
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা রক্ত দিয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদার দাবিতে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এ বিষয়টি পৃথিবীর সব জাতির মাতৃভাষার জন্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অর্জন ঠিক তখনই মূল্যায়িত হবে, যদি বাংলাদেশেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাদেশ সরকার ও ইউনেসকো মিলে আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও চর্চার জন্য আদিবাসীদের মাতৃভাষার অধিকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। এটা হতে পারে পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি মডেল। সে লক্ষ্যে প্রথমে আদিবাসী ভাষাগুলোর ওপর ভাষাতাত্ত্বিক মাঠ গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষাভাষীর সংখ্যা, স্থান ও অঞ্চল সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। যেসব আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি বা বর্ণমালা আছে সেগুলো সংরক্ষণ ও প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ে তার ব্যবহার ও অনুশীলনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যেসব আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি নেই তাদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য বাংলায় ও অন্যত্র রোমান হরফে লিখন প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন দেশের যেকোনো প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ধর্মান্তরকরণ আদিবাসী জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্য প্রধান দায়ী। আদিবাসীদের জীবনমান উন্নত করতে হবে।
মং এ খেন মংমং, সভাপতি
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র ফোরাম।
উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা
সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলো ইংরেজিতে দেওয়া হয়। ব্যতিক্রম ছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি গত কয়েক বছর বাংলায় রায় দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে রায় তিনি বাংলায় দিয়েছেন। ঢাকার আশপাশের নদীগুলো রক্ষায় একাধিক রায় ও নির্দেশনা তিনি বাংলায় দিয়েছেন। বাংলায় উচ্চ আদালতের রায় দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন যাঁরা, তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, যেকোনো মামলার রায়ই বাংলায় দেওয়া সম্ভব। তার আগে বিচারপতি কাজী এবাদুল হকও বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দুজনের কেউই এখন আর হাইকোর্টে নেই, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক অনেক আগেই অবসরে গেছেন। আর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এখন আপিল বিভাগের বিচারপতি। আপিল বিভাগের রায়গুলো সাধারণত বেঞ্চের রায় হিসেবেই ঘোষণা করা হয়ে থাকে। বিচারপতির সংখ্যা যে কজনই হোক, তাঁরা একটি রায়ই দেন। বিচারপতিদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে ভিন্নমত বা নির্দেশনা থাকে তা তাঁরা আলাদাভাবে দিয়ে থাকেন। কিন্তু তা একই রায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।
বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে চলে যাওয়ায় হাইকোর্টে বাংলায় আর কেউ রায় লিখছেন না, আর আপিল বিভাগের রায়গুলো যেহেতু ইংরেজিতেই হচ্ছে, ধরেই নেওয়া যায় যে সুপ্রিম কোর্টে এখন আর কেউ বাংলায় রায় দিচ্ছেন না।
নানা সীমাবদ্ধতা এবং চর্চা না থাকার ফলে হুট করেই সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম বাংলায় পরিচালনার দাবি তোলা ঠিক হবে না। কিন্তু বাংলা ব্যবহারে কারও কারও মধ্যে যে নাক সিটকানো ভাব দেখি তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত। একশ্রেণীর আইনজীবীর মধ্যে এই প্রবণতাও রয়েছে, প্রয়োজনে তারা ভুল উচ্চারণে ইংরেজি বলবেন, কিন্তু বাংলা নয়, বাংলাই যদি বললাম তাহলে আর হাইকোর্টের উকিল হলাম কেন!
আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা যা-ই বলি, তা নেই। তারা এখন বাংলায় রায় দিতে শুরু করবেন এমনটা প্রত্যাশা না করাই উত্তম। তবে যাঁরা চাইলেই বাংলায় রায় লেখার অভ্যাসটা রপ্ত করতে পারেন, তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা করার অধিকার রয়েছে।
বাংলায় রায় লেখা কঠিন হতে পারে, কিন্তু তা অসম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত। বাংলা কঠিন বা বাংলায় অসম্ভব বলে যাঁরা বাংলার প্রয়োগ ও চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছেন, তাঁদের পথ কেন অনুসরণ করতে হবে সবাইকে? কিছুটা দৈন্য যদি থেকেও থাকে আমাদের ভাষায়, তা দূর করার কোনো চেষ্টাই কি আমরা করতে পারি না? ভাষা তো সীমিত সময়ের তৈরি কিছু নয়। বাংলায় রায় দিয়ে, বাংলায় প্রতিশব্দ তৈরি করে এমনকি নতুন শব্দ তৈরি করে বাংলার গাঁথুনিকে আরও মজবুত করতে পারেন বিচারকেরা। নাক সিটকানো যাঁদের অভ্যাস আর কঠিন বলে সত্যকে ভালোবাসতে ও গ্রহণ করতে যাঁদের ভয়, সেই শ্রেণীর উকিলরা বাদে অন্যরাও পারেন এ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে। বিচারপতি খায়রুল হক না দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে বাংলা রায়ের অধ্যায় শেষ হয়েছে এমনটা ভাবতে চাই না আমরা।
আবদুর রহমান
সায়েদাবাদ, ঢাকা।
দুনিয়া কাঁপানো সেই ৩০ মিনিট!
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য গৌরবময় এক দিন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে উচ্চকিত সেই দিনে বিকেল তিনটা ২০ থেকে ৫০ মিনিট বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার সেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে আমগাছের নিচে হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়ে সেই ভাষাশহীদদের স্মরণ করলেন, শ্রদ্ধা জানালেন ভাষাসৈনিকদের। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল এই ‘দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট’-এ সেখানে অংশ নিয়ে জানান দেওয়ার যে আমি বাঙালি, বাংলা আমার মায়ের ভাষা, বাংলা আমার দেশ। আমার ৪৭ বছরের ব্যর্থ, নগণ্য এই জীবনে এ যেন এক শ্রেষ্ঠ পাওয়া, অনেক বড় এক সার্থকতা।
সেদিন অনেক ভাষাসৈনিককে কাছে পেয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। মনে মনে বলি, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের ভাষাসৈনিকেরা আজ আমার কতই না কাছে। যাঁদের কথা পড়েছি বইয়ের পাতায়, যাঁদের ছবি দেখেছি তথ্যচিত্রে, তাঁদের স্বচক্ষে দেখছি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি, ছবি তুলছি। কী যে সেই অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে মূর্ত করে তোলার আয়োজনের উদ্যোক্তা দৈনিক প্রথম আলো ও গ্রামীণফোনকে আমরা দল-মতনির্বিশেষে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে আজ অনুভব করি, ভাষা আন্দোলনের ৫৮ বছর এবং স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি, বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে। কেন পারিনি, কোথায় বাধা তা নিয়ে আজ গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। বাধাগুলো দূর করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ আজ নিতে হবে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে। এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
আলী নিয়ামত, ঢাকা।
বৈরিতা-প্রতিহিংসার রাজনীতি ছাড়ুন
প্রায় দুই দশক ধরে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। কিন্তু এর তেমন কোনো সুফল জনগণ পায়নি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশ ঘটেনি। পরমতসহিষ্ণুতার পরিবর্তে অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতার ধারাই বিস্তৃত হয়েছে। সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে উভয় পক্ষের প্রাণবন্ত আলোচনা হয় না। সরকারি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একচেটিয়াভাবে আইন পাস করে; বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে। সংসদে যোগ দিলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারে না; বা অপ্রাসঙ্গিক তুচ্ছ বিষয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করা হয় এবং এর ফলে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। দুই বছর একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কিছু বক্তব্যে তাঁদের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতায় যে দৈন্য ও সংকীর্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা জাতির জন্য হতাশাব্যঞ্জক।
মৃত্যুর প্রায় ৩০ বছর পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে তাঁর লাশ আছে কি না, তা উদ্ঘাটন করার প্রস্তাবটি কি অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক নয়? এ নিয়ে অর্থহীন কথা চালাচালির জন্যই কি জাতীয় সংসদ? ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম থেকে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টিও কি দেশের জন্য এ মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার কয়েক শ সরকারি স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছিল। তাদের শিক্ষা দিতেই বর্তমান সরকারের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী অসত্য বলেননি: বিএনপিও নাম পরিবর্তনের রাজনীতিই করেছিল। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের খেসারত তাদের দিতে হয়েছে। তাদের প্রতিহিংসার রাজনীতিকে জনগণ ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে বিগত নির্বাচনে।
জনগণ নাম পরিবর্তনের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। চারদলীয় জোট কয়েক শ স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেও জনগণের মনে স্থায়ী আসন পায়নি। এর পরও আমাদের নেতানেত্রীরা কেন ভুলে যাচ্ছেন, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে এই সব কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে সহপাঠীদের মৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের স্কুলশিশুর দেহ পিষ্ট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে জাপান গার্ডেন সিটিতে অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত ঝলসে যাওয়া সাতটি তাজা প্রাণ; পুলিশ বাহিনীর সামনে ঘটে যাওয়া খুন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ নানা অপরাধ—এগুলো হচ্ছে দেশ ও জাতির জন্য গুরুতর সমস্যা।
যানজটের কারণে ছাত্রছাত্রী ও কর্মজীবী মানুষেরা হারাচ্ছে মূল্যবান সময় ও কর্মস্পৃহা। বিদ্যুিবভ্রাটের বিড়ম্বনা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। অপ্রতুল গ্যাস সরবরাহের কারণে পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য শিল্পকারখানায় উত্পাদন বাধাগ্রস্ত, গৃহস্থালিতে গ্যাস, পানির সংকটে জীবন অতিষ্ঠ। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে জনগণের করের টাকায় চলে যে সংসদ, সেখানে জিয়ার কবরে তাঁর লাশ আছে কি না আর স্থাপনার নাম পরিবর্তন নিয়ে বাগিবতণ্ডা জনগণের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা আশা করব, সরকার ও বিরোধী দল পারস্পরিক বৈরিতা ও প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থ ও কল্যাণে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করবে।
সারওয়াত জাহান
ধানমন্ডি, ঢাকা।
ব্লগের শক্তি: আমরা অপেক্ষা করছি
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ব্লগের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। ব্লগ দ্রুতই হয়ে উঠছে তথ্যপ্রাপ্তির ও চিন্তাভাবনা বিনিময়ের জনপ্রিয় মাধ্যম। মানুষের কণ্ঠরোধ আর সম্ভব হবে না; কণ্ঠরোধকারীরা অচিরেই হয়ে উঠবে হাস্যকর। সাধারণ মানুষ ব্লগে আসতে পারছে। তথ্যপ্রযুক্তির আরও প্রসার, ইন্টারনেটের গতি ও সংযোগ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্লগ ব্যবহার আরও অনেক বেড়ে যাবে। যে একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর চায়, বাকস্বাধীনতা চায়, তথ্যের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক একচেটিয়ার অবসান চায়, তার কাছে ব্লগ হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ব্লগ তৈরি করবে দ্রুত গতির মানবিক যোগাযোগের ব্যবস্থা। লৌহ যবনিকার অন্তরালে গণমানুষকে আটকে রাখার দিন ইতিহাস হয়ে যাবে। স্বৈরশাসকেরা আর আসবে না, যদি আসে, বুঝেশুনে আসবে। এসে টিকতে পারবে না বেশি দিন।
কারও কারও জন্য ব্লগের কিছু খারাপ দিকও আছে। যারা তথ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতে চায়, যারা জনমতকে এক দিকে ধাবিত করতে চায়, যারা নিজেদের সুবিধামতো তথ্য প্রকাশ করে এবং চেপে রেখে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়, ব্লগ তাদের জন্য বিরাট অসুবিধার ব্যাপার। কারসাজিপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য, জনগণকে বোকা বানানো ব্র্যান্ডিং বরবাদ করে দিতে পারে ব্লগ। ব্লগের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার দিগন্ত উন্মুক্ত হবে। মনোজগতে উপনিবেশের অবসান ঘটাবে ব্লগ। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সাংবাদিকতা কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাবে; তাদেরকে আরও স্বচ্ছ, আরও নিরপেক্ষ, আরও খোলামেলা হতে হবে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, বাণিজ্যিক লেনদেন—সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আমরা অপেক্ষা করছি।
প্রযুক্তির বদৌলতে সূচিত এই বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। গণতন্ত্রকে আরও বিকশিত করার কাজে ইন্টারনেট ব্লগিংয়ের সুবিধা বিশেষত তরুণসমাজকে নিতে হবে। শুধু আনন্দ-বিনোদন নয়, জাতির গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে সরকারকে আরও দায়িত্বশীল করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলা, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ধিক্কার জানানোসহ আরও নানাভাবে ইন্টারনেট ব্লগিংকে ব্যবহার করা যায়। সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দাবি করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে ইন্টারনেট ব্লগ।
ফজলুল হক, চট্টগ্রাম।
শিশু অধিকার: কথা নয়, কাজ চাই
শিশুদের অধিকার নিয়ে নানা গবেষণাকর্ম, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, সচেতনতামূলক সপ্তাহ বা দিবস পালিত হয়। প্রায় চার দশক ধরে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্বের সব দেশ জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালন করে থাকে। আমাদের দেশেও এ বছর ‘শিশু সুরক্ষার অধিকার, দিনবদলের অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করেছে। এত প্রচারণা সত্ত্বেও কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা, উপযুক্ত বাসস্থান আর বস্ত্র পাওয়ার কথা, সেই বয়সে তাকে ভিক্ষার ঝুলি নিতে হয়। কেউ বা হাঁপর টানে, মোট বয় কিংবা ইটপাথরের খোয়া ভাঙে। অনেকে ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়, কারও কারও আশ্রয় জোটে রেলস্টেশন বা এতিমখানায়। জন্মনিবন্ধনের তালিকায় তাদের নাম ওঠে না। কারণ তাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই। নিরাপত্তাহীনতা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং সমাজের প্রতি ক্ষোভে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় অপরাধপ্রবণতা। তারা জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে। আশ্রয় মেলে কারাগারে। তারা হয়ে যায় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। জেল থেকে বেরিয়ে আর কোনো ভালো কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা আবারও ফিরে যায় অন্ধকার রাজ্যে। দোষ তাদের নয়। যে সমাজ তাদের মৌলিক অধিকার মেটাতে অপারগ, সেই সমাজের ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে হয় এই হতভাগ্য শিশুদের।
বাংলাদেশে প্রায় ৭৪ লাখ শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত। বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। গ্রামবাংলায় কৃষিকাজে, ইটভাটায়, পাথর বা খোয়া ভাঙায় মা-বাবাকে সাহায্য করে। আর শহরের শিশুরা কাজ করে গার্মেন্টসশিল্পে, বিড়ি কারখানায়, বিভিন্ন ওয়ার্কশপে। অনেক শিশু কুলি-হকার বা রিকশা-শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, মাদকবাহক, অস্ত্রবাহক, আবর্জনা সংগ্রাহক বা টোকাই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ায় শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশের কন্যাশিশুদের শতকরা ৬৪ ভাগের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। বাল্যবিবাহ রোধের জন্য কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে যে কাজি বিবাহ দেন তাঁর এবং মেয়ে ও ছেলের অভিভাবকের বিরুদ্ধে। এসব কাজির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে যেন ভোটার আইডি কার্ড দেখে মেয়ের সাবালক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে কাজিরা বিয়ে পড়ান সে ব্যাপারে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ইমাম ও পুরোহিতেরা। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রাখাও অপরিহার্য।
কয়েক দিন আগে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়া রোধে শিশুদের বিদ্যালয়ে খাবার দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিত্তশালীদের রাখতে হবে যথাযোগ্য ভূমিকা। বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী নিজে একটি স্কুল খুলেছেন দরিদ্র শিশুদের জন্য। যেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতি ক্লাসে দুটি করে সিট থাকবে সংরক্ষিত। আমাদের দেশেও রয়েছেন এমন ক্রিকেটার, খেলোয়ার, চিত্রতারকা, সাহিত্যিক, শিল্পী, বৃদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শিল্পপতি। তাঁরাও তো করতে পারেন এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য অবৈতনিক স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, শিশুপার্ক। তাতে সরকারের ভার কিছুটা লাঘব হয়। পথশিশুমুক্ত দেশ দেখতে আমাদেরও ভালো লাগবে, বহির্বিশ্বে আমাদের সুনামও বাড়বে। আমরা পাব ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক।
হাবিবুর রহমান, রাজশাহী।
প্রধানমন্ত্রী যেদিন এসব কথা বলেন, ঠিক তার আগের দিন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের সমালোচনা করে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তারা কখনো অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি।’
আমরা নিরীহ জনগণ, কী আর বলব! এই দুই দলের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ আর আক্রমণ দেখে মনে হয়, দেশের জনগণের কোনো সমস্যা নেই, কখনো ছিল না। স্থাপনার নাম পাল্টানো, পরস্পরকে ‘শিক্ষা দেওয়া’ই ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের প্রধান কাজ। গত ১৯ বছরের সংসদীয় গণতন্ত্র এভাবেই চলছে। তারা কেউ জনগণের কথা ভাবছে না। পাল্টাপাল্টি উদ্যোগ হিসেবে স্থাপনার নাম বদলানোয় জনমনে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তা যদি তারা একটু ভাবত, তাহলে এই অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর পদক্ষেপগুলো নিতে পারত না।
জনজীবনের নানামুখী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা প্রয়োজন। লাখ লাখ শিক্ষিত ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান নেই। জিনিসপত্রের দাম যতটা সহনীয় মাত্রায় কমে আসবে বলে এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ততটা কমেনি। বরং কিছু দ্রব্যের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তার মধ্যে কোনো কোনো পণ্যের দাম হঠাত্ করে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কারসাজিতে এমনটি ঘটে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও এর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। কৃষক অনেক অর্থ ব্যয় করে, কঠোর পরিশ্রম করে যে কৃষিপণ্য ফলায়, তার ভালো দাম পায় না। অথচ সেই কৃষিপণ্য কয়েক ধাপ পেরিয়ে শহর-বন্দরের বাজারে পৌঁছে এমন চড়া দামে বিক্রি হয় যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। বাজারব্যবস্থার এই অসংগতি বা কারসাজির স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই করা হয় না। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তা কম, অন্যায়-অবিচারের শিকার হলে তারা বিচার পায় না। সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসী, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির উপদ্রবও চলছে সারা দেশে।
নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের দৃষ্টি থাকবে জনগণের ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধার দিকে। সাধারণ মানুষের আয়-উন্নতির পথগুলো সুগম করার মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, দেশের সর্বত্র শান্তিরক্ষার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমরা দেখে আসছি, ক্ষমতাসীন সরকারগুলো সব সময় ব্যস্ত থাকে নিজেদের আখের গোছানো আর বিরোধী দল বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামলাতে। প্রতিপক্ষ দলকে মোকাবিলা করাই যেন সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। সেই মোকাবিলার রূপ হয় কখনো ‘শিক্ষা দেওয়া’র মতো নানা পদক্ষেপ, কখনো অপ্রীতিকর ভাষায় সমালোচনা, কখনো পুলিশি দমন-পীড়ন, কখনো বা দলীয় লোকজনদের দিয়ে প্রতিপক্ষদের ওপর হামলা চালানো। এগুলো জনগণ পছন্দ করে না। সরকারের এসব আচরণে জনমনে এমন ধারণা হয় যে জনগণের সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশাগুলো সরকারের বিবেচনার মধ্যেই নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সম্পর্কে বললেন, ‘তারা কখনো ভাবেনি যে তাদের সরকারই শেষ সরকার নয়।’ আসলে এই কথাটা সব সরকারের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমান সরকারের জন্যও বটে। কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়।
ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে বিএনপি আবার ক্ষমতায় যাবে। তখন তারা সব স্থাপনার নাম আবার বদলে দেবে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলবে? একসময় তো থামা দরকার। উভয় পক্ষকেই।
আহমেদ মহিউদ্দিন
চট্টগ্রাম।
আদিবাসীদের ভাষার কী হবে
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা রক্ত দিয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদার দাবিতে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এ বিষয়টি পৃথিবীর সব জাতির মাতৃভাষার জন্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অর্জন ঠিক তখনই মূল্যায়িত হবে, যদি বাংলাদেশেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাদেশ সরকার ও ইউনেসকো মিলে আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও চর্চার জন্য আদিবাসীদের মাতৃভাষার অধিকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। এটা হতে পারে পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি মডেল। সে লক্ষ্যে প্রথমে আদিবাসী ভাষাগুলোর ওপর ভাষাতাত্ত্বিক মাঠ গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষাভাষীর সংখ্যা, স্থান ও অঞ্চল সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। যেসব আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি বা বর্ণমালা আছে সেগুলো সংরক্ষণ ও প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ে তার ব্যবহার ও অনুশীলনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যেসব আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি নেই তাদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য বাংলায় ও অন্যত্র রোমান হরফে লিখন প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন দেশের যেকোনো প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ধর্মান্তরকরণ আদিবাসী জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্য প্রধান দায়ী। আদিবাসীদের জীবনমান উন্নত করতে হবে।
মং এ খেন মংমং, সভাপতি
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র ফোরাম।
উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা
সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলো ইংরেজিতে দেওয়া হয়। ব্যতিক্রম ছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি গত কয়েক বছর বাংলায় রায় দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে রায় তিনি বাংলায় দিয়েছেন। ঢাকার আশপাশের নদীগুলো রক্ষায় একাধিক রায় ও নির্দেশনা তিনি বাংলায় দিয়েছেন। বাংলায় উচ্চ আদালতের রায় দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন যাঁরা, তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, যেকোনো মামলার রায়ই বাংলায় দেওয়া সম্ভব। তার আগে বিচারপতি কাজী এবাদুল হকও বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দুজনের কেউই এখন আর হাইকোর্টে নেই, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক অনেক আগেই অবসরে গেছেন। আর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এখন আপিল বিভাগের বিচারপতি। আপিল বিভাগের রায়গুলো সাধারণত বেঞ্চের রায় হিসেবেই ঘোষণা করা হয়ে থাকে। বিচারপতির সংখ্যা যে কজনই হোক, তাঁরা একটি রায়ই দেন। বিচারপতিদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে ভিন্নমত বা নির্দেশনা থাকে তা তাঁরা আলাদাভাবে দিয়ে থাকেন। কিন্তু তা একই রায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।
বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে চলে যাওয়ায় হাইকোর্টে বাংলায় আর কেউ রায় লিখছেন না, আর আপিল বিভাগের রায়গুলো যেহেতু ইংরেজিতেই হচ্ছে, ধরেই নেওয়া যায় যে সুপ্রিম কোর্টে এখন আর কেউ বাংলায় রায় দিচ্ছেন না।
নানা সীমাবদ্ধতা এবং চর্চা না থাকার ফলে হুট করেই সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম বাংলায় পরিচালনার দাবি তোলা ঠিক হবে না। কিন্তু বাংলা ব্যবহারে কারও কারও মধ্যে যে নাক সিটকানো ভাব দেখি তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত। একশ্রেণীর আইনজীবীর মধ্যে এই প্রবণতাও রয়েছে, প্রয়োজনে তারা ভুল উচ্চারণে ইংরেজি বলবেন, কিন্তু বাংলা নয়, বাংলাই যদি বললাম তাহলে আর হাইকোর্টের উকিল হলাম কেন!
আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা যা-ই বলি, তা নেই। তারা এখন বাংলায় রায় দিতে শুরু করবেন এমনটা প্রত্যাশা না করাই উত্তম। তবে যাঁরা চাইলেই বাংলায় রায় লেখার অভ্যাসটা রপ্ত করতে পারেন, তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা করার অধিকার রয়েছে।
বাংলায় রায় লেখা কঠিন হতে পারে, কিন্তু তা অসম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত। বাংলা কঠিন বা বাংলায় অসম্ভব বলে যাঁরা বাংলার প্রয়োগ ও চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছেন, তাঁদের পথ কেন অনুসরণ করতে হবে সবাইকে? কিছুটা দৈন্য যদি থেকেও থাকে আমাদের ভাষায়, তা দূর করার কোনো চেষ্টাই কি আমরা করতে পারি না? ভাষা তো সীমিত সময়ের তৈরি কিছু নয়। বাংলায় রায় দিয়ে, বাংলায় প্রতিশব্দ তৈরি করে এমনকি নতুন শব্দ তৈরি করে বাংলার গাঁথুনিকে আরও মজবুত করতে পারেন বিচারকেরা। নাক সিটকানো যাঁদের অভ্যাস আর কঠিন বলে সত্যকে ভালোবাসতে ও গ্রহণ করতে যাঁদের ভয়, সেই শ্রেণীর উকিলরা বাদে অন্যরাও পারেন এ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে। বিচারপতি খায়রুল হক না দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে বাংলা রায়ের অধ্যায় শেষ হয়েছে এমনটা ভাবতে চাই না আমরা।
আবদুর রহমান
সায়েদাবাদ, ঢাকা।
দুনিয়া কাঁপানো সেই ৩০ মিনিট!
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য গৌরবময় এক দিন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে উচ্চকিত সেই দিনে বিকেল তিনটা ২০ থেকে ৫০ মিনিট বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার সেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে আমগাছের নিচে হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়ে সেই ভাষাশহীদদের স্মরণ করলেন, শ্রদ্ধা জানালেন ভাষাসৈনিকদের। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল এই ‘দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট’-এ সেখানে অংশ নিয়ে জানান দেওয়ার যে আমি বাঙালি, বাংলা আমার মায়ের ভাষা, বাংলা আমার দেশ। আমার ৪৭ বছরের ব্যর্থ, নগণ্য এই জীবনে এ যেন এক শ্রেষ্ঠ পাওয়া, অনেক বড় এক সার্থকতা।
সেদিন অনেক ভাষাসৈনিককে কাছে পেয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। মনে মনে বলি, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের ভাষাসৈনিকেরা আজ আমার কতই না কাছে। যাঁদের কথা পড়েছি বইয়ের পাতায়, যাঁদের ছবি দেখেছি তথ্যচিত্রে, তাঁদের স্বচক্ষে দেখছি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি, ছবি তুলছি। কী যে সেই অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে মূর্ত করে তোলার আয়োজনের উদ্যোক্তা দৈনিক প্রথম আলো ও গ্রামীণফোনকে আমরা দল-মতনির্বিশেষে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে আজ অনুভব করি, ভাষা আন্দোলনের ৫৮ বছর এবং স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি, বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে। কেন পারিনি, কোথায় বাধা তা নিয়ে আজ গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। বাধাগুলো দূর করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ আজ নিতে হবে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে। এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
আলী নিয়ামত, ঢাকা।
বৈরিতা-প্রতিহিংসার রাজনীতি ছাড়ুন
প্রায় দুই দশক ধরে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। কিন্তু এর তেমন কোনো সুফল জনগণ পায়নি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশ ঘটেনি। পরমতসহিষ্ণুতার পরিবর্তে অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতার ধারাই বিস্তৃত হয়েছে। সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে উভয় পক্ষের প্রাণবন্ত আলোচনা হয় না। সরকারি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একচেটিয়াভাবে আইন পাস করে; বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে। সংসদে যোগ দিলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারে না; বা অপ্রাসঙ্গিক তুচ্ছ বিষয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করা হয় এবং এর ফলে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। দুই বছর একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কিছু বক্তব্যে তাঁদের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতায় যে দৈন্য ও সংকীর্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা জাতির জন্য হতাশাব্যঞ্জক।
মৃত্যুর প্রায় ৩০ বছর পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে তাঁর লাশ আছে কি না, তা উদ্ঘাটন করার প্রস্তাবটি কি অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক নয়? এ নিয়ে অর্থহীন কথা চালাচালির জন্যই কি জাতীয় সংসদ? ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম থেকে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টিও কি দেশের জন্য এ মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার কয়েক শ সরকারি স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছিল। তাদের শিক্ষা দিতেই বর্তমান সরকারের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী অসত্য বলেননি: বিএনপিও নাম পরিবর্তনের রাজনীতিই করেছিল। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের খেসারত তাদের দিতে হয়েছে। তাদের প্রতিহিংসার রাজনীতিকে জনগণ ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে বিগত নির্বাচনে।
জনগণ নাম পরিবর্তনের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। চারদলীয় জোট কয়েক শ স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেও জনগণের মনে স্থায়ী আসন পায়নি। এর পরও আমাদের নেতানেত্রীরা কেন ভুলে যাচ্ছেন, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে এই সব কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে সহপাঠীদের মৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের স্কুলশিশুর দেহ পিষ্ট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে জাপান গার্ডেন সিটিতে অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত ঝলসে যাওয়া সাতটি তাজা প্রাণ; পুলিশ বাহিনীর সামনে ঘটে যাওয়া খুন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ নানা অপরাধ—এগুলো হচ্ছে দেশ ও জাতির জন্য গুরুতর সমস্যা।
যানজটের কারণে ছাত্রছাত্রী ও কর্মজীবী মানুষেরা হারাচ্ছে মূল্যবান সময় ও কর্মস্পৃহা। বিদ্যুিবভ্রাটের বিড়ম্বনা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। অপ্রতুল গ্যাস সরবরাহের কারণে পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য শিল্পকারখানায় উত্পাদন বাধাগ্রস্ত, গৃহস্থালিতে গ্যাস, পানির সংকটে জীবন অতিষ্ঠ। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে জনগণের করের টাকায় চলে যে সংসদ, সেখানে জিয়ার কবরে তাঁর লাশ আছে কি না আর স্থাপনার নাম পরিবর্তন নিয়ে বাগিবতণ্ডা জনগণের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা আশা করব, সরকার ও বিরোধী দল পারস্পরিক বৈরিতা ও প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থ ও কল্যাণে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করবে।
সারওয়াত জাহান
ধানমন্ডি, ঢাকা।
ব্লগের শক্তি: আমরা অপেক্ষা করছি
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ব্লগের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। ব্লগ দ্রুতই হয়ে উঠছে তথ্যপ্রাপ্তির ও চিন্তাভাবনা বিনিময়ের জনপ্রিয় মাধ্যম। মানুষের কণ্ঠরোধ আর সম্ভব হবে না; কণ্ঠরোধকারীরা অচিরেই হয়ে উঠবে হাস্যকর। সাধারণ মানুষ ব্লগে আসতে পারছে। তথ্যপ্রযুক্তির আরও প্রসার, ইন্টারনেটের গতি ও সংযোগ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্লগ ব্যবহার আরও অনেক বেড়ে যাবে। যে একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর চায়, বাকস্বাধীনতা চায়, তথ্যের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক একচেটিয়ার অবসান চায়, তার কাছে ব্লগ হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ব্লগ তৈরি করবে দ্রুত গতির মানবিক যোগাযোগের ব্যবস্থা। লৌহ যবনিকার অন্তরালে গণমানুষকে আটকে রাখার দিন ইতিহাস হয়ে যাবে। স্বৈরশাসকেরা আর আসবে না, যদি আসে, বুঝেশুনে আসবে। এসে টিকতে পারবে না বেশি দিন।
কারও কারও জন্য ব্লগের কিছু খারাপ দিকও আছে। যারা তথ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতে চায়, যারা জনমতকে এক দিকে ধাবিত করতে চায়, যারা নিজেদের সুবিধামতো তথ্য প্রকাশ করে এবং চেপে রেখে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়, ব্লগ তাদের জন্য বিরাট অসুবিধার ব্যাপার। কারসাজিপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য, জনগণকে বোকা বানানো ব্র্যান্ডিং বরবাদ করে দিতে পারে ব্লগ। ব্লগের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার দিগন্ত উন্মুক্ত হবে। মনোজগতে উপনিবেশের অবসান ঘটাবে ব্লগ। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সাংবাদিকতা কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাবে; তাদেরকে আরও স্বচ্ছ, আরও নিরপেক্ষ, আরও খোলামেলা হতে হবে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, বাণিজ্যিক লেনদেন—সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আমরা অপেক্ষা করছি।
প্রযুক্তির বদৌলতে সূচিত এই বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। গণতন্ত্রকে আরও বিকশিত করার কাজে ইন্টারনেট ব্লগিংয়ের সুবিধা বিশেষত তরুণসমাজকে নিতে হবে। শুধু আনন্দ-বিনোদন নয়, জাতির গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে সরকারকে আরও দায়িত্বশীল করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলা, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ধিক্কার জানানোসহ আরও নানাভাবে ইন্টারনেট ব্লগিংকে ব্যবহার করা যায়। সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দাবি করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে ইন্টারনেট ব্লগ।
ফজলুল হক, চট্টগ্রাম।
শিশু অধিকার: কথা নয়, কাজ চাই
শিশুদের অধিকার নিয়ে নানা গবেষণাকর্ম, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, সচেতনতামূলক সপ্তাহ বা দিবস পালিত হয়। প্রায় চার দশক ধরে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্বের সব দেশ জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালন করে থাকে। আমাদের দেশেও এ বছর ‘শিশু সুরক্ষার অধিকার, দিনবদলের অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করেছে। এত প্রচারণা সত্ত্বেও কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা, উপযুক্ত বাসস্থান আর বস্ত্র পাওয়ার কথা, সেই বয়সে তাকে ভিক্ষার ঝুলি নিতে হয়। কেউ বা হাঁপর টানে, মোট বয় কিংবা ইটপাথরের খোয়া ভাঙে। অনেকে ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়, কারও কারও আশ্রয় জোটে রেলস্টেশন বা এতিমখানায়। জন্মনিবন্ধনের তালিকায় তাদের নাম ওঠে না। কারণ তাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই। নিরাপত্তাহীনতা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং সমাজের প্রতি ক্ষোভে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় অপরাধপ্রবণতা। তারা জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে। আশ্রয় মেলে কারাগারে। তারা হয়ে যায় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। জেল থেকে বেরিয়ে আর কোনো ভালো কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা আবারও ফিরে যায় অন্ধকার রাজ্যে। দোষ তাদের নয়। যে সমাজ তাদের মৌলিক অধিকার মেটাতে অপারগ, সেই সমাজের ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে হয় এই হতভাগ্য শিশুদের।
বাংলাদেশে প্রায় ৭৪ লাখ শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত। বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। গ্রামবাংলায় কৃষিকাজে, ইটভাটায়, পাথর বা খোয়া ভাঙায় মা-বাবাকে সাহায্য করে। আর শহরের শিশুরা কাজ করে গার্মেন্টসশিল্পে, বিড়ি কারখানায়, বিভিন্ন ওয়ার্কশপে। অনেক শিশু কুলি-হকার বা রিকশা-শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, মাদকবাহক, অস্ত্রবাহক, আবর্জনা সংগ্রাহক বা টোকাই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ায় শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশের কন্যাশিশুদের শতকরা ৬৪ ভাগের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। বাল্যবিবাহ রোধের জন্য কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে যে কাজি বিবাহ দেন তাঁর এবং মেয়ে ও ছেলের অভিভাবকের বিরুদ্ধে। এসব কাজির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে যেন ভোটার আইডি কার্ড দেখে মেয়ের সাবালক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে কাজিরা বিয়ে পড়ান সে ব্যাপারে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ইমাম ও পুরোহিতেরা। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রাখাও অপরিহার্য।
কয়েক দিন আগে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়া রোধে শিশুদের বিদ্যালয়ে খাবার দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিত্তশালীদের রাখতে হবে যথাযোগ্য ভূমিকা। বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী নিজে একটি স্কুল খুলেছেন দরিদ্র শিশুদের জন্য। যেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতি ক্লাসে দুটি করে সিট থাকবে সংরক্ষিত। আমাদের দেশেও রয়েছেন এমন ক্রিকেটার, খেলোয়ার, চিত্রতারকা, সাহিত্যিক, শিল্পী, বৃদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শিল্পপতি। তাঁরাও তো করতে পারেন এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য অবৈতনিক স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, শিশুপার্ক। তাতে সরকারের ভার কিছুটা লাঘব হয়। পথশিশুমুক্ত দেশ দেখতে আমাদেরও ভালো লাগবে, বহির্বিশ্বে আমাদের সুনামও বাড়বে। আমরা পাব ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক।
হাবিবুর রহমান, রাজশাহী।
No comments