বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের পর লতিফুর রহমান-ব্যবসায় নৈতিকতা অনুশীলনের আহ্বান

মুনাফার পাশাপাশি ব্যবসায় নৈতিকতা অনুশীলনের জন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি), বাংলাদেশের সহসভাপতি লতিফুর রহমান। গত সোমবার রাতে নরওয়ের অসলোতে বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড, ২০১২ গ্রহণের পর তিনি এ আহ্বান জানান।


পুরস্কার গ্রহণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লতিফুর রহমান আগামী দিনে তাঁর শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আরও মানবিক করার এবং ভবিষ্যতে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে আরও যত্নবান হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, যিনি এই পুরস্কার পেলেন। পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এই পুরস্কারপ্রাপ্তি বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করবে।
অসলোতে বিজনেস ফর পিস ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক জমকালো অনুষ্ঠানে ট্রেড সামিটের মাধ্যমে অসলোর সিটি সেন্টারে পুরস্কার দেওয়া হয়। অসলো সিটি সেন্টারের যে কক্ষে শান্তিতে নোবেলজয়ীদের হাতে পদক তুলে দেওয়া হয়, সেখানেই অনুষ্ঠানটি হওয়ায় এটি অন্য রকম মাত্রা পায়।
বিজনেস ফর পিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পেল এল স্যাকসগার্দ লতিফুর রহমানসহ ছয় বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। সামিটে ‘এসেন্স অব ট্রাস্ট ইন বিজনেস টুডে’ ও ‘লং টার্ম স্টেডি গ্রোথ অ্যান্ড প্রফিটিবিলিটি’ শীর্ষক দুটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে আলেক্সান্দার ক্রিস্টিনা ও রবার্তো সান্দ্রা। অনুষ্ঠানে সবাইকে স্বাগত জানান সিটি অব অসলোর ভাইস মেয়র হ্যালেস্টিয়েন জারকে।
বিজনেস ফর পিস পুরস্কার ব্যবসাক্ষেত্রে নৈতিকতার সঙ্গে অসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে যেকোনো ব্যবসায়ীর জন্য সর্বোচ্চ সম্মান। এ বছর ৬০টি দেশ থেকে ৯০ জন প্রার্থীর মধ্যে বাংলাদেশের লতিফুর রহমানসহ ছয়জন ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্বকে এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়। এ পুরস্কারে আরও ভূষিত হয়েছেন মিসরের ইব্রাহিম আবুলেইশ, আর্জেন্টিনার এদুয়ার্দো ইউরনেকিয়ান, লিথুনিয়ার ভ্লাদাস লাসাস, যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ডব্লিউ ম্যাক লেনান এবং তানজানিয়ার রেজিনাল এ ম্যাঙ্গি। ১৭ এপ্রিল এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
অসলো বিজনেস ফর পিস ফাউন্ডেশন ২০০৯ সাল থেকে এ পুরস্কার দিয়ে আসছে। এর সহযোগী অংশীদার হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি), দ্য ওয়ার্ল্ড বিজনেস অর্গানাইজেশন, ওয়ার্ল্ড চেম্বারস ফেডারেশন (ডব্লিউসিএফ), দ্য সিটি অব অসলো, অসলো চেম্বার অব কমার্স এবং অসলো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (ওডব্লিউটিসি)।
বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড ২০১২-এর নির্বাচক কমিটিতে ছিলেন ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ২০০১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী এ মাইকেল স্পেন্স।
নৈশভোজ: পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্মানে সোমবার রাতে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় লতিফুর রহমান এই পুরস্কারপ্রাপ্তিকে একটি অসাধারণ সুযোগ ও ব্যতিক্রমধর্মী সম্মান বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক দিক থেকে এ পুরস্কার মূল্যবান ও গৌরবজনক।
লতিফুর রহমান তাঁর পরিবারের ১২৫ বছরের ও নিজের ৪০ বছরের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি জানান, তাঁর পরিবার ১৮৮৫ সালে চা-বাগানের ব্যবসা এবং পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে পাটশিল্প দিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিনি জানান, ট্রান্সকম গ্রুপ বর্তমানে বেশ কয়েকটি বিশ্বখ্যাত কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে।
লতিফুর রহমান বলেন, ‘নরওয়েসহ অনেক উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা নেই। সে জন্য আমি বিশ্বাস করি যে কল্যাণের বিষয়টি মনে রেখেই নিয়োগকর্তা বা মালিকদের শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও বিকশিত করা উচিত। মালিকদের এও মনে রাখতে হবে, যেই দেশে বেকারত্বের হার উচ্চ এবং একটি চাকরি পাওয়া মহামূল্যবান বিষয়, সেখানে করপোরেট সুশাসনের অভাব অথবা ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে কোনো শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি গেলে তাতে শুধু সেই লোকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, পাশাপাশি তাঁর গোটা পরিবারের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।’
লতিফুর রহমান বলেন, ‘প্রত্যেক মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সে জন্য আমি বিশ্বাস করি, যতক্ষণ কেউ মূল্যবোধ পালনের বিষয়ে সতর্ক থাকেন ও তা চর্চা করে চলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করে যাওয়াটা তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ হয়ে থাকবে।’ বিশ্বজুড়ে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলার এই যুগে উন্নত ও উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সব দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্যই নৈতিকতার মান আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লতিফুর রহমান আরও বলেন, বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ডের মতো মর্যাদাশীল পুরস্কার পাওয়ার ফলে তাঁর ও ট্রান্সকম গ্রুপের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ের সফলতা ধরে রাখতে ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঠিক অবস্থানে পৌঁছার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে তাঁদের আগামী দিনগুলোতে আরও সতর্ক থাকতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

No comments

Powered by Blogger.