শিক্ষা-নেতৃত্ব বিকাশে প্রশিক্ষণ by কামরুননেসা হাসান

সরকারি অথবা বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত ২৫-৩০ জন ছাত্রছাত্রী একত্রে একটি শ্রেণীকক্ষে পাঠ গ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে জনসংখ্যা এবং শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষার্থীর হার বেড়ে গেছে। তাই প্রায়ই দেখা যায়, অধিক চাপের কারণে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠ গ্রহণ করতে হয়।


একজন শিক্ষকের পক্ষে কোনোভাবেই এতজনকে সঠিকভাবে যত্নসহকারে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়, তা যত ভালো শিক্ষকই হোন না কেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সামনের সারির ১০-১২ জন ছাড়া পেছনের সারির প্রায় সবাই প্রকৃত শ্রেণীপাঠ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে তার প্রভাব পড়ে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায় এবং মফস্বল শহরে একসময় তারা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দেয়। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তারা কোনো গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে পারে না। এত সব সমস্যার কথা চিন্তা করে শিক্ষার্থীর গুণগত মান উন্নয়ন এবং সেই সঙ্গে তাদের সৃজনশীলতা বিকাশের নিমিত্তে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মেন্টরিং কার্যক্রম এ প্রয়াসেরই একটি অংশ। মেন্টরিংয়ের প্রকৃত অর্থ এখানে বোঝানো হয়েছে সাহায্যকারী অথবা এগিয়ে যেতে পরামর্শ দেওয়া।
প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ পাঁচজনকে নির্বাচন করে ট্রেনিং দেওয়া হয়। তারাই মেন্টর। ১০ জনের গ্রুপে একজন করে মেন্টর থাকবে, তারা শিক্ষকের পাশাপাশি অবসর সময়ে ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করবে। পিছিয়ে পড়া অথবা দুর্বল শিক্ষার্থীদের সব রকম সহায়তা দেবে মেন্টররা। সবাই মিলে শ্রেণীকক্ষ পরিষ্কার রাখা, বাগান করা, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার চর্চা করা, কোনো সহপাঠী অসুস্থ হলে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করা ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা করে মেন্টররা। সবাই মিলে সুন্দর হস্তলেখায় দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করা, সর্বোপরি একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করা, গান, নাচ, আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে মিলিত প্রচেষ্টা। এর পাশাপাশি বিতর্ক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করে থাকে। এতে করে বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে মেন্টরদের একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশব্যাপী বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় ৪৩ হাজার মেন্টর ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়েছে। এই মেন্টরদের Local Resource Person এবং স্কুলের শিক্ষকেরা সহযোগিতা করে থাকেন।
গত ২১ এপ্রিল, ২০১২ শনিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মেন্টরিং কার্যক্রমের ওপর একটি চমৎকার গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ২০০৬ সালে নমুনা বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ও পরীক্ষার ফলাফল ৫৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছিল মেন্টরিং কার্যক্রমের আওতায়। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রেণীকক্ষ পরিচ্ছন্নতা ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ, বড়দের সম্মান ৯৬ দশমিক ৭, দেয়াল পত্রিকা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা ৯০ দশমিক ৮, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর এ সফলতা এসেছে মেন্টরিং পদ্ধতির ফলে।
অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখায় বিভিন্ন চিত্রাঙ্কনে সমৃদ্ধ প্রায় শতাধিক দেয়াল পত্রিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিল। সৈয়দ শামসুল হক তা দেখে মুগ্ধ হন এবং শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করে উৎসাহিত করেন। মফস্বল থেকে আসা মেন্টরদের বক্তৃতা, সংগীত পরিবেশনা এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নৃত্য পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে।
ব্র্যাকের অনেক ভালো উদ্যোগের পাশাপাশি এই মেন্টরিং কার্যক্রমের প্রসার ও উৎসর্গ সাধনে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কাজে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। ভবিষ্যতে এই মেন্টররাই বিকশিত হয়ে ঘুণেধরা সমাজকে বদলে দেবে, এই প্রত্যাশা রইল।
কামরুননেসা হাসান: কনসালট্যান্ট, ব্র্যাক শিক্ষা কো-কারিকুলাম।

No comments

Powered by Blogger.