স্মৃতির রহস্য সন্ধানে by অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।মন নিয়ে, স্মৃতিশক্তি নিয়ে ও মনের নানা রোগ নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই। এমন একজন বিজ্ঞানী নোবেল বিজয়ী স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. এরিক আর কেনডেল ৮২ বছর বয়সেও নিরলস গবেষণা করে চলেছেন এসব নিয়ে।
সম্প্রতি তিনি আছেন এমন এক গবেষণা প্রকল্প নিয়ে, যার উদ্দেশ্য হলো ‘সিজোফ্রেনিয়া’ রোগের জন্য নতুন শ্রেণীর ওষুধ আবিষ্কার। ইতিমধ্যে গত বছর তিনি কাজ করছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেনিস বে কেনডেলের সঙ্গে। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ৫৫ বছর ধরে একসঙ্গে ঘর করছেন। সিগারেট ও কোকেনে আসক্তির মধ্যে জৈবিক সম্পর্কের সন্ধানই ছিল এ গবেষণার লক্ষ্য।
গত মার্চে বেরিয়েছে ডেনিস বে কেনডেলের নতুন বই The age of Insight: The Quest to understand the Unconsuous in Ar,t Mind and Brain, from Vienna 1900 to the present। প্রকাশ করছেন রেনডম হাউস। তাঁর নতুন বই, তাঁর গবেষণা ভাবনা ও নিজ জীবন—এসব নিয়ে আলাপচারিতা বেশ চিত্তাকর্ষক। তাঁর জন্মভূমি ভিয়েনার স্মৃতি তাঁকে বেশ দোলা দেয়।
ভিয়েনায় নাজিরা যখন বীরদর্পে ঢুকল, তখন তাঁর বয়স আট বছরের একটু বেশি। জীবন তখন সংকটে। বাসা থেকেও বিতাড়িত হলো তাঁর পরিবার। পরে তাঁরা দুই ভাই আমেরিকা অভিবাসী হলেন অনেক কষ্টে। পরে এলেন তাঁদের মা-বাবাও।
২০০০ সালে যখন ডেনিস বে কেনডেল ফিজিওলজিও মেডিকেলে নোবেল পেলেন আমেরিকা থেকে, অস্ট্রিয়া তখন তাঁকে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু সেই দেশ থেকে একদিন তিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সেই মর্মবেদনা তাঁর ছিলই। ১৯৫০ সালে যখন তিনি হার্ভার্ডের ছাত্র, সাইকোএনালিস্ট হওয়ার প্রবল বাসনা হলো তাঁর। মনের ভাবনা নিয়ে গবেষণা, মনকে জানার প্রবল আগ্রহ তাঁকে মন সম্বন্ধে গবেষণার জন্য খুবই তাড়িত করেছিল। স্মৃতির রহস্য অনুসন্ধান ছিল তাঁর মনের প্রেষণা। এ জন্য তিনি ও তাঁর সহকর্মী এলডেন স্পেনসার প্রথম রহস্যভেদের অনুসন্ধান শুরু করলেন মগজের হিপোকামপাস নামক এলাকা নিয়ে। জটিল স্মৃতির ঘনঘটা এ অংশকে নিয়েই। যোগ দিলেন আরেকজন বিজ্ঞানী ব্রেনডা মিলার। মগজের কোষে আসা নানান স্নায়ুপথকে উদ্দীপিত করে স্নায়ুসন্ধিতে এর প্রতিফলনও দেখলেন। হিপোব্যাম্পাস কোষ কাজ করে কীভাবে, জানা গেল। কিন্তু স্মৃতির রহস্য বয়ে গেল আঁধারে। ১৯৬০ সালে অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গিতে চলল গবেষণা—Reductionist approach—জটিল মাপের গবেষণা না করে সহজ ও লঘু মাপে জিনিসকে দেখা।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর জটিল মগজকোষগুলো নিয়ে গবেষণা না করে তাঁরা গবেষণা শুরু করলেন একটি সহজ-সরল প্রাণী—এপলিশিয়াকে নিয়ে, এর স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে। এপলিশিয়া হলো একটি শামুক, যার রয়েছে অত্যন্ত বৃহৎ কৃষ্ণ স্নায়ুকোষ। প্যাভেলডের পরীক্ষার অনুসরণ করে তাঁরা একে Learning and reflex test-এর মুখোমুখি করালেন। তাঁরা শামুককে উদ্দীপিত করলেন, কী ধরনের প্রতিবর্ত ক্রিয়া তৈরি হয়, তা লক্ষ করলেন, পরীক্ষা করলেন। তাঁরা আবিষ্কার করলেন, শামুককে নানা রকম শিক্ষার মুখোমুখি করলে এর রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তক্রিয়াকে পরিবর্তন করা সম্ভব।
শামুকের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিও লক্ষ করা হলো। স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি যখন দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে পরিণত হয়, তখন কী ঘটে, তা তাঁরা দেখলেন। দেখা গেল, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতির ক্ষেত্রে স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে সংযোগগুলোয় হয় সাময়িক পরিবর্তন। কোনো গাঠনিক পরিবর্তন ঘটে না।
দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতির ক্ষেত্রে ঘটে স্থায়ী পরিবর্তন। নতুন নতুন স্নায়ুসন্ধির সংযোগ জন্ম নেওয়ার জন্য ঘটে এমন অটল একটি পরিবর্তন। ঘটনাটি বিস্ময়কর! অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার মাধ্যমে সহজ স্নায়ুজালের স্নায়ুসন্ধি সংযোগগুলোর সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেখা সম্ভব। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি স্নায়ুকোষে জিনের প্রকাশ বদলে দেয়। সে জন্য নতুন স্নায়ুসন্ধি সংযোগের হয় উদ্ভব।
কোষ পর্যায়ে একে লক্ষ করলে বোঝা যায়, অভিজ্ঞতার প্রভাবে মগজ বদলে যেতে পারে। প্রকৃতি ও লালন-পালন দুটি পরস্পর ক্রিয়া করে এ ভাবনা নতুন অনুভূতির জন্ম দেয় মনে। এ প্রক্রিয়া অভিন্ন নয়, এক সূত্রে গাঁথা।
স্নায়ুবিজ্ঞান এসব নিয়েই চলে। নতুন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে। অপ্রীতিকর স্মৃতিগুলো মোচন করা যায় কি না, এ নিয়েও গবেষণা চলছে, এ নিয়ে বিতর্কও আছে।
স্মৃতিকে আরও উন্নত, আরও উজ্জ্বল, আরও প্রসারিত করার চেষ্টা তো সাধুবাদের বিষয়। স্মৃতিকে সরিয়ে ফেলা কঠিন কাজ। কগনিটিভ বিহেভিয়ার অভিজ্ঞতা, এক্সপোজার থেরাপি ও ওষুধ—কত উপায় অবলম্বন করা হতে পারে। মগজের মধ্যে গিয়ে একটি দুর্ভাগ্যজনক ভালোবাসার অভিজ্ঞতাকে তুলে, সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, কেমন যেন ভালো লাগে না।
আমরা যা, আমরা তা-ই। আমাদের ভালোমন্দ যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সব মিলেই আমরা। একাত্তরের অনেক দুঃখের স্মৃতি, হানাদারদের ঘৃণ্য, নৃশংস অত্যাচার ও ধ্বংসের ছবি স্মৃতি থেকে কি মোচন করা যায়? কেউ চাইতে পারে, তা মুছে যাক। এমন স্মৃতি মোচন হবে ভয়াবহ।
এসব স্মৃতিই তো আমাকে এমন আমি বানিয়েছে। কেন এসব অপ্রীতিকর দুঃখের স্মৃতি মুছে যাবে মন থেকে? নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী এরিক আর কেনডেলও চান না, তাঁর ছোটবেলার ভিয়েনার দারুণ কঠিন দুঃখের স্মৃতি মুছে যাক মন থেকে। এ গবেষণা তাই তিনি সমর্থন করেন না।
গত মার্চে বেরিয়েছে ডেনিস বে কেনডেলের নতুন বই The age of Insight: The Quest to understand the Unconsuous in Ar,t Mind and Brain, from Vienna 1900 to the present। প্রকাশ করছেন রেনডম হাউস। তাঁর নতুন বই, তাঁর গবেষণা ভাবনা ও নিজ জীবন—এসব নিয়ে আলাপচারিতা বেশ চিত্তাকর্ষক। তাঁর জন্মভূমি ভিয়েনার স্মৃতি তাঁকে বেশ দোলা দেয়।
ভিয়েনায় নাজিরা যখন বীরদর্পে ঢুকল, তখন তাঁর বয়স আট বছরের একটু বেশি। জীবন তখন সংকটে। বাসা থেকেও বিতাড়িত হলো তাঁর পরিবার। পরে তাঁরা দুই ভাই আমেরিকা অভিবাসী হলেন অনেক কষ্টে। পরে এলেন তাঁদের মা-বাবাও।
২০০০ সালে যখন ডেনিস বে কেনডেল ফিজিওলজিও মেডিকেলে নোবেল পেলেন আমেরিকা থেকে, অস্ট্রিয়া তখন তাঁকে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু সেই দেশ থেকে একদিন তিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সেই মর্মবেদনা তাঁর ছিলই। ১৯৫০ সালে যখন তিনি হার্ভার্ডের ছাত্র, সাইকোএনালিস্ট হওয়ার প্রবল বাসনা হলো তাঁর। মনের ভাবনা নিয়ে গবেষণা, মনকে জানার প্রবল আগ্রহ তাঁকে মন সম্বন্ধে গবেষণার জন্য খুবই তাড়িত করেছিল। স্মৃতির রহস্য অনুসন্ধান ছিল তাঁর মনের প্রেষণা। এ জন্য তিনি ও তাঁর সহকর্মী এলডেন স্পেনসার প্রথম রহস্যভেদের অনুসন্ধান শুরু করলেন মগজের হিপোকামপাস নামক এলাকা নিয়ে। জটিল স্মৃতির ঘনঘটা এ অংশকে নিয়েই। যোগ দিলেন আরেকজন বিজ্ঞানী ব্রেনডা মিলার। মগজের কোষে আসা নানান স্নায়ুপথকে উদ্দীপিত করে স্নায়ুসন্ধিতে এর প্রতিফলনও দেখলেন। হিপোব্যাম্পাস কোষ কাজ করে কীভাবে, জানা গেল। কিন্তু স্মৃতির রহস্য বয়ে গেল আঁধারে। ১৯৬০ সালে অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গিতে চলল গবেষণা—Reductionist approach—জটিল মাপের গবেষণা না করে সহজ ও লঘু মাপে জিনিসকে দেখা।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর জটিল মগজকোষগুলো নিয়ে গবেষণা না করে তাঁরা গবেষণা শুরু করলেন একটি সহজ-সরল প্রাণী—এপলিশিয়াকে নিয়ে, এর স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে। এপলিশিয়া হলো একটি শামুক, যার রয়েছে অত্যন্ত বৃহৎ কৃষ্ণ স্নায়ুকোষ। প্যাভেলডের পরীক্ষার অনুসরণ করে তাঁরা একে Learning and reflex test-এর মুখোমুখি করালেন। তাঁরা শামুককে উদ্দীপিত করলেন, কী ধরনের প্রতিবর্ত ক্রিয়া তৈরি হয়, তা লক্ষ করলেন, পরীক্ষা করলেন। তাঁরা আবিষ্কার করলেন, শামুককে নানা রকম শিক্ষার মুখোমুখি করলে এর রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তক্রিয়াকে পরিবর্তন করা সম্ভব।
শামুকের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিও লক্ষ করা হলো। স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি যখন দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে পরিণত হয়, তখন কী ঘটে, তা তাঁরা দেখলেন। দেখা গেল, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতির ক্ষেত্রে স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে সংযোগগুলোয় হয় সাময়িক পরিবর্তন। কোনো গাঠনিক পরিবর্তন ঘটে না।
দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতির ক্ষেত্রে ঘটে স্থায়ী পরিবর্তন। নতুন নতুন স্নায়ুসন্ধির সংযোগ জন্ম নেওয়ার জন্য ঘটে এমন অটল একটি পরিবর্তন। ঘটনাটি বিস্ময়কর! অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার মাধ্যমে সহজ স্নায়ুজালের স্নায়ুসন্ধি সংযোগগুলোর সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেখা সম্ভব। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি স্নায়ুকোষে জিনের প্রকাশ বদলে দেয়। সে জন্য নতুন স্নায়ুসন্ধি সংযোগের হয় উদ্ভব।
কোষ পর্যায়ে একে লক্ষ করলে বোঝা যায়, অভিজ্ঞতার প্রভাবে মগজ বদলে যেতে পারে। প্রকৃতি ও লালন-পালন দুটি পরস্পর ক্রিয়া করে এ ভাবনা নতুন অনুভূতির জন্ম দেয় মনে। এ প্রক্রিয়া অভিন্ন নয়, এক সূত্রে গাঁথা।
স্নায়ুবিজ্ঞান এসব নিয়েই চলে। নতুন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে। অপ্রীতিকর স্মৃতিগুলো মোচন করা যায় কি না, এ নিয়েও গবেষণা চলছে, এ নিয়ে বিতর্কও আছে।
স্মৃতিকে আরও উন্নত, আরও উজ্জ্বল, আরও প্রসারিত করার চেষ্টা তো সাধুবাদের বিষয়। স্মৃতিকে সরিয়ে ফেলা কঠিন কাজ। কগনিটিভ বিহেভিয়ার অভিজ্ঞতা, এক্সপোজার থেরাপি ও ওষুধ—কত উপায় অবলম্বন করা হতে পারে। মগজের মধ্যে গিয়ে একটি দুর্ভাগ্যজনক ভালোবাসার অভিজ্ঞতাকে তুলে, সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, কেমন যেন ভালো লাগে না।
আমরা যা, আমরা তা-ই। আমাদের ভালোমন্দ যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সব মিলেই আমরা। একাত্তরের অনেক দুঃখের স্মৃতি, হানাদারদের ঘৃণ্য, নৃশংস অত্যাচার ও ধ্বংসের ছবি স্মৃতি থেকে কি মোচন করা যায়? কেউ চাইতে পারে, তা মুছে যাক। এমন স্মৃতি মোচন হবে ভয়াবহ।
এসব স্মৃতিই তো আমাকে এমন আমি বানিয়েছে। কেন এসব অপ্রীতিকর দুঃখের স্মৃতি মুছে যাবে মন থেকে? নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী এরিক আর কেনডেলও চান না, তাঁর ছোটবেলার ভিয়েনার দারুণ কঠিন দুঃখের স্মৃতি মুছে যাক মন থেকে। এ গবেষণা তাই তিনি সমর্থন করেন না।
No comments