পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-পরিচালন পদ্ধতিতে স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রায়ন জরুরি by আবু সাঈদ খান

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি আত্মমর্যাদাশীল শিক্ষক, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছাত্র নেতৃত্বের বিষয়টিও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের বিষয়টি ভাবা উচিত। কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে এটি কি কঠিন কিছু? মানলাম, ঝক্কি-ঝামেলা আছে।


কিন্তু সিনেটে উপাচার্যের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচনে সমস্যা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক আবহ তৈরির জন্য যাত্রাটি উপাচার্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে
শুরু হতে পারে

কোনো জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়, বরং নিজস্ব সমস্যায় অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটসহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। কমবেশি সংকটে রয়েছে প্রায় প্রতিটি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। জাবি ও বুয়েটে চলছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলন। আন্দোলনের পেছনের প্রেক্ষাপট খুঁজলে দেখা যাবে, দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশাসনগুলোই প্রকারান্তরে এ জন্য দায়ী। সেখানকার শিক্ষক সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এমন একটি অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি ওঠে। এমন দাবির প্রতি সরকার সাড়া দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-অনশনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কর্মবিরতি পালনরত শিক্ষকদের বৈঠকের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ক্লাস শুরু হয়েছে। এসব ঘটনা স্বস্তিদায়ক। তবে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) শিক্ষকদের কর্মবিরতি অব্যাহত রয়েছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) পরিবেশ উত্তপ্ত। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় আপাত শান্ত থাকলেও সেগুলো ঘিরেও আছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনিয়মের বাইরে নেই। তবে সেখানকার সমস্যা আলাদা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল দাবি_ উপাচার্যের পদত্যাগ, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়ম, ছাত্রলীগের কর্মীদের সন্ত্রাস ও তাদের প্রশ্রয়দান, দুর্নীতি ইত্যাদি। তবে এসব বিষয় নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর। জুবায়ের ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, একই সংগঠনের অন্তর্দলীয় কোন্দলে তিনি নিহত হন এ বছরের ৮ জানুয়ারি। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে তখনই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সন্তোষজনক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বরং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা প্রশাসনিক প্রশ্রয় পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। অন্যদিকে ৭ এপ্রিল বুয়েটে উপাচার্যের ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষক সমাজের কর্মবিরতি শুরু হয়।
বুয়েটের পরিস্থিতির পেছনে কাজ করেছে রেজিস্ট্রার পদে ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতাদানের ঘটনা। ডেপুটি রেজিস্ট্রার কামাল আহম্মদকে (যিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি) রেজিস্ট্রার হিসেবে ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। সহ-উপাচার্য পদ তৈরি করে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যেগুলো আপাতত শান্ত সেগুলোর প্রশাসনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগই শেষ কথা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হওয়ার পেছনে ছাত্র সংগঠনগুলোর সৃষ্ট সন্ত্রাস, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষকদের দলাদলিও দায়ী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত সমস্যাকে শুধু ঘটমান পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করলে চলবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন পদ্ধতি কতটা যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য ও গণতান্ত্রিক সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠ, তা পরিচালিত হতে হবে নিয়ম-পদ্ধতির মধ্যে। আমার জানা মতে_ ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য '৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ/আইন রয়েছে। কিছু সমালোচনা থাকলেও এই অধ্যাদেশ/আইনগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সমৃদ্ধ ও উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়ক বলে বিবেচিত। কিন্তু বাস্তবে এর কতটুকু অনুসরণ করা হচ্ছে? ওই অধ্যাদেশ আইন অনুযায়ী, সিনেটরদের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত তিন ব্যক্তির মধ্য থেকে আচার্য (রাষ্ট্রপতি) একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। আগে এ প্রক্রিয়ায় কয়েকজন উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন এ বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। পরবর্তীকালে '৭৩-এর অধ্যাদেশ/আইন সংশোধন করে উপাচার্যের ছুটি, অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্যান্য কারণে শূন্যতা সৃষ্টি হলে সাময়িক নিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হয়, সেই সাময়িক নিয়োগ প্রক্রিয়ারই আজ অপব্যবহার হচ্ছে। বিগত ও বর্তমান সরকারগুলো সমানে এ অপব্যবহার করে চলছে।
উপাচার্যের মেয়াদকাল ৪ বছর; কিন্তু সাময়িক নিয়োগপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর ৩ বছরের অধিক সময় দায়িত্বে আছেন। সাময়িক নিয়োগপ্রাপ্তদের অযোগ্য ভাবার কারণ নেই। তবে যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় বিবেচনায় তারা নিয়োগ পান, সেহেতু তাদের প্রতি ছাত্র-শিক্ষকদের এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। আমার মনে হয়, সাময়িক প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্তরা যথাসময়ে সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে উপাচার্য নিযুক্ত হলে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। সাময়িক নিয়োগ কখনোই স্থায়ী রূপ নিতে পারে না। আর তা ঘটলে সেটি হবে নিয়মেরই বরখেলাপ।
এ দলীয়করণের থাবা কেবল উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও দলীয় বিবেচনা কাজ করে। যে কারণে মেধা তালিকায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের ব্যক্তিদের স্থলে পেছনের সারি থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়_ এমনকি অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম স্থান পাওয়া একাধিক প্রার্থী থাকার পরও অনার্স-মাস্টার্সে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া প্রার্থীকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটছে দেদার। এখানে যোগ্যতার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় রঙ। কে সাদা আর কে নীল_ সেটিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও এমনটি হচ্ছে। এ অভিযোগ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে। এ ধরনের নিয়োগ ও পদোন্নতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশের চরম অবনতি ঘটিয়েছে। শিক্ষকরা ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হলে ক্লাসরুমের পড়াশোনায় যে ব্যাঘাত ঘটবে তা সহজেই বোধগম্য।
একজন উপাচার্যের কাছ থেকে উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশিত; কিন্তু দলীয় বিবেচনায় দায়িত্ব গ্রহণ করে তার পক্ষে কি তা সম্ভব? শিক্ষকদের বড় একটি অংশ আজ দু'ভাগে বিভক্ত_ আওয়ামী লীগপন্থি ও বিএনপিপন্থি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করছে আর সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা পালাক্রমে সুবিধা লুটছেন। বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিবাদী ও দ্বিদলীয় সংশ্রববঞ্চিত শিক্ষকরা। বলাবাহুল্য, এ প্রক্রিয়ায় দলীয় সমর্থক ছাত্রদের অবৈধ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বা দিতে বাধ্য হচ্ছে প্রশাসনগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি থেকে ক্যান্টিনের খাবার সরবরাহের কাজ তাদের পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। দলবাজি-ক্ষমতাবাজি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন-শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্ত না হলে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের প্রভাবমুক্ত স্বশাসিত ব্যবস্থা, যা '৭৩-এর অধ্যাদেশ/আইনে বর্ণিত রয়েছে। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ভিন্ন পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে, তবে তা সাময়িক। স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা দরকার।
এদিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল একজন শরীফ এনামুল কবীর কিংবা একজন নজরুল ইসলামকে পদত্যাগে বাধ্য করানোর মধ্যে স্থায়ীভাবে পরিবেশের উন্নয়ন হবে না। অতীতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির বিদায়ের ঘটনা দেখেছি। আন্দোলনের মুখে বিদায়ী উপাচার্য আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী বাহরাইনের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেওয়ার পর আলাউদ্দিন আহমদ জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনে অভিযুক্তরা নিজ নিজ দলের কাজে হেয় হন না, বরং সম্মানিত হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অতীতে ছাত্ররা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এখনও পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু মূলধারার ছাত্র সংগঠনগুলো আজ দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে আচ্ছন্ন, আদর্শবিচ্যুত। অর্থের পেছনে তাড়িত। এটি কি ভাবা যায় যে পরীক্ষায় খারাপ করে পাস করিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করবে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা পরীক্ষায় ফেল করার পর ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর করেছে। ভাবখানা এমন, তারা সরকারের বরপুত্র, তাদের পাস করিয়ে দেওয়া হবে না কেন?
সংকীর্ণ রাজনীতিতে বিভক্ত শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকরা রাজনীতি বিমুক্ত থাকবেন, তা আমি বলছি না। শিক্ষকরা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন, সেই মত-পথের জন্য লড়তেও পারেন। কিন্তু এভাবে সাদা-নীল বিভক্ত হয়ে সত্য কথনে নীরব থাকবেন, তা কি সমর্থনযোগ্য?
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি আত্মমর্যাদাশীল শিক্ষক, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছাত্র নেতৃত্বের বিষয়টিও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের বিষয়টি ভাবা উচিত। কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে এটি কি কঠিন কিছু? মানলাম, ঝক্কি-ঝামেলা আছে। কিন্তু সিনেটে উপাচার্যের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচনে সমস্যা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক আবহ তৈরির জন্য যাত্রাটি উপাচার্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.