শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-বিনি সুতোর মালায় গাঁথা গ্রামটি by মুক্তার হোসেন

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর। কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর কবিতায় গ্রামের যে ছবি এঁকেছিলেন, সে রকমই একটি গ্রাম হুলহুলিয়া। নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে গ্রামটির অবস্থান।


এই গ্রামে নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। ঝগড়া-বিবাদ প্রায় নেই-ই। দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো আর সুখে আনন্দ ভাগাভাগি করাই তাদের বৈশিষ্ট্য। গ্রামের মানুষকে চমৎকার এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এনেছে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’। এই পরিষদ হুলহুলিয়াকে আধুনিক গ্রাম হিসেবে গড়তে কাজ করে যাচ্ছে।
শুরুর কথা: নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শান্ত এক গ্রাম হুলহুলিয়া। ১২টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলনবিলবেষ্টিত গ্রামটির আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। গ্রামটির শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। একটা সময় ছিল, যখন বর্ষা মৌসুমে এই গ্রামে তেমন কোনো ফসল হতো না। ওই সময়ে মানুষের হাতে কোনো কাজও থাকত না। তাই অভাব লেগেই থাকত।
১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। বন্যার পর গ্রামের অনেক চাষি ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে নিয়ে সভায় বসেন মৃধা সাহেব। সিদ্ধান্ত হয়, যাঁদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তাঁরা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়েই গ্রামের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪০ সালে সেই পরিষদ হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। পরিষদ গঠন করার আদিকথা এভাবেই বর্ণনা করলেন পরিষদের বর্তমান সহসভাপতি ও প্রবীণ সদস্য আবদুল লতিফ।
গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’: এই পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’ পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন সভাপতি, একজন সহসভাপতি ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। দুই বছর পর পর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করে। ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়ে আসছে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে। বড় কোনো অপরাধ সংগঠিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর করে। এই আস্থাই পরিষদের বড় সাফল্য বলে মনে করে গ্রামের বাসিন্দারা।
‘আমাদের গ্রামে ব্রিটিশ আমল থেকে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালু আছে। এই ব্যবস্থা নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। গ্রামের বিচারব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো ঘটনা নেই।’ বললেন গ্রামের বাসিন্দা শমসের আলী।
গ্রামের চৌধুরীপাড়ার আবদুল গফুর জানালেন, চার মাস আগে জমি নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রতিবেশী আরাম আলীর বিরোধ শুরু হয়। তিনি বিষয়টি মীমাংসার জন্য পরিষদের বিচারকদের শরণাপন্ন হন। মাত্র সাত দিনের মধ্যে তাঁরা দুই পক্ষকে নিয়ে বসে শান্তিপূর্ণ সমাধান করে দেন।
উন্নয়ন: ১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। কিন্তু উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর অনেকেই ঝরে পড়ত। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। শুরুতে শিক্ষকদের অনেকেই বিনা বেতনে বা অর্ধেক বেতনে শিক্ষাদান করেছেন। পরে এখানে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালনায় দুটি স্কুল চলছে।
চলনবিলবেষ্টিত হওয়ায় আগে বর্ষা মৌসুমে নৌকাই ছিল গ্রামটির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে পরিষদের চেষ্টায় এখন সারা বছর সড়কপথেও যাওয়া যায় এই গ্রামে। সবার সহযোগিতায় হুলহুলিয়ায় গড়ে উঠেছে মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে ডাকঘর ও দাতব্য চিকিৎসালয়ও। গ্রামের চিকিৎসক সন্তানেরা বিভিন্ন সময়ে বিনা মূল্যে গ্রামবাসীকে চিকিৎসাসেবা দেন।
গ্রামে ১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় অরাজনৈতিক ও সামাজিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে ‘বটবৃক্ষ’। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাঁদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি ও অসহায় মানুষকে সহায়তা করা হয়।
একটা সময় এই গ্রামে কোনো কবরস্থান ছিল না। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কেউ মারা গেলে পুকুরপাড় ও কোনো উঁচু স্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হতো। পরিষদের চেষ্টায় প্রায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি স্থায়ী কবরস্থান করা হয়েছে। কবরস্থানের দেখভালের জন্য আছে ছয় সদস্যের একটি কমিটি।
সামাজিক সচেতনতা: গ্রামে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদক ব্যবসা নেই। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। এর প্রতিফলন দেখা যায় এই গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা মেধাবীদের পরিসংখ্যান দেখে। গ্রামের ২৭ জন সন্তান প্রকৌশলী ও ২১ জন চিকিৎসক হয়েছেন। আছেন কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। পরিষদের উদ্যোগে ২০১১ সালে হুলহুলিয়ার তথ্য বিশ্ববাসীকে জানাতে ওয়েবসাইট (www.hulhulia.com) উদ্বোধন করা হয়।
যাঁদের হাতে গড়া: আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে নিজেদের মেধা, অর্থ ও শ্রম দিয়ে গেছেন অনেকেই। তবে যাঁদের ভোলার নয় তাঁরা হলেন: মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, মরহুম মফিজ উদ্দিন পণ্ডিত, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ, মরহুম হানিফ উদ্দিন মিঞা, মরহুম এ কে তালুকদার, এম এম রহমত উল্লাহ, সফিউদ্দিন সরদার, গাউসুল ইসলাম মৃধা, জামসেদ আলী প্রমুখ।
তাঁদের কথা: হুলহুলিয়া গ্রাম উন্নয়ন পরিষদের বর্তমান সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক বলেন, সবাই মিলেমিশে গ্রামে সুশিক্ষা, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনই আমাদের মূল লক্ষ্য। কোনো কারণে পরিষদের বিচার কারও মনমতো না হলে তাঁদের থানা বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এ ধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটে।
প্রতিক্রিয়া: চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গোলজার হোসেন বলেন, উন্নয়ন পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়ায় বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে। দেশের সব গ্রামে এমন পরিষদ চালু হলে দেশ এগিয়ে যেত। সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ হারুন বলেন, ‘হুলহুলিয়া গ্রাম দেশের আর দশটা গ্রাম থেকে অনেক দিক থেকেই আলাদা। এই গ্রামের মানুষ সামাজিক বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাদের সঙ্গে থেকে ওই এলাকা এগিয়ে নেওয়ার অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত।’
সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়েজুর রহমান বলেন, থানার পরিসংখ্যানই বলে, হুলহুলিয়া গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। জমিজমা নিয়ে বিরোধ হলেও গ্রামের পরিষদই তা সমাধান করে।

No comments

Powered by Blogger.