চারদিক-ফটোগ্রাফার! by ফারুখ আহমেদ
লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর পূজা না দিয়ে শিবের কন্যা সর্পদেবী মনসার রোষানলে পড়েন। সেই রোষানলে একে একে তার ছয় ছেলে সাপের দংশনে মারা গেলে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে লখিন্দরকে রক্ষার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে তাঁর বিয়ের সময় দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্যে লোহার বাসরঘর নির্মাণ করেন।
যে ঘর কোনো সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু নিয়তি আগেই লেখা হয়ে গেছে। তাই এত আয়োজনের পরও লখিন্দরের শেষরক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত মনসার আদেশে তাঁর পাঠানো এক কালনাগের দংশনে লখিন্দরের মৃত্যু হয়।’—কথাগুলো বলে নূরুন নবী একটু দম নিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তাকে ঘিরে থাকা দর্শনার্থীরা তখন প্রবল আগ্রহ নিয়ে সমস্বরে প্রায় চিৎকার করে ওঠে—‘তারপর’!
নূরুন নবী তখন তার হাতের একগাদা চটি বই সবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তারপর এই বইতে। আপনি খালি এই বেহুলার বাসর নয়, পুরো মহাস্থানগড়ের ইতিহাস পাবেন এই বইতে। দাম মাত্র পঁচিশ টাকা। লগে আজকের গাইড হিসাবে আমারে।’ প্রতিদিন এভাবেই মহাস্থানগড়ের ইতিহাসসমৃদ্ধ বই বিক্রি করে চলেছেন মোহাম্মদ নূর ইসলাম এবং মোহাম্মদ নূরুন নবী।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে বেহুলার বাসর দেখতে গিয়ে আমরা এই দুজনের দেখা পাই। পরিচয় পর্বের পর আমাদের দুজনেরই দুই নূরকে মনে ধরল। তা ছাড়া একটু পর মনে হলো, ওরাও আমাদের পছন্দ করে ফেলেছে। যদি তা-ই না হতো, তাহলে বই বিক্রি ফেলে তারা আমাদের সঙ্গে ঘুরত না। এখানকার গোকুল মেধ নামক স্তূপটি বেহুলার বাসর নামে খ্যাত। আমরা চলে এসেছি সেই স্তূপটির একেবারে ওপরে। হাতে ক্যামেরা, সমানে ক্লিক করে চলেছি। এর মধ্যে নূর ইসলাম বলে, ‘স্যার, দেন আমি আপনেগো ছবি তুইলা দেই।’
অফারটা মন্দ নয়। এখানে যে এলাম, আমাদেরও কিছু স্মৃতি থাকা চাই। আমি ক্যামেরা ওর গলায় ঝুলিয়ে যেই ক্যামেরা চালানো বিষয়ে একটু বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে গেছি, দেখি সেই আমাকে শেখানো শুরু করেছে। ‘রোদ বেশি স্যার’। আট অ্যাপারচারে ছবি তুলি, আমি বিষম খেলাম। বলে কী ছোকরা! এভাবেই আমরা তার মডেল হয়ে গেলাম। ‘স্যার, এই দিকটায় দাঁড়ান, এভাবে দাঁড়ান, ম্যাডাম একটু দূরের দিকে তাকান।’ আমরা তার বাধ্য মডেল, সে যা বলছিল, করে যাচ্ছিলাম। কী এক আচ্ছন্নতায় ছিলাম। এদিকে আমার সঙ্গীও তার ক্যামেরায় নূর ইসলামের ছবি তুলে চলেছে। একসময় ঘোর কাটে। ছবি তোলা এবং দর্শন শেষ করে আমরা নিচে নেমে আসি। তারপর কথা বলি নূর ইসলাম এবং মোহাম্মদ নূরুন নবীর সঙ্গে। দুজনের বয়সই ১১-১২ ছুঁই ছুঁই। গোকুলবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। সামনের বছর মেয়ারহাট স্কুলে ভর্তি হবে। প্রশ্ন করলাম, স্কুল পাল্টাবে কেন? ‘কী করমু স্যার! উপবৃত্তি দেওয়ার কথা, দেয় না। ঠিকমতো ক্লাস হয় না। আমরা স্যার ফাঁকিবাজ না। পড়ালেখা করমু, অনেক বড় হমু। মেয়ারহাট স্কুল ভালো, তাই সেখানে ভর্তি হমু।’
‘বই বিক্রি করো ক্যান?’
‘ধরেন স্যার, নতুন স্কুলে ভর্তি হইলে বই কেনা লাগব, স্কুল ড্রেস কত কি! আমার বাবার পক্ষে সেসব করা একটু কষ্টকর। তাই বই বিক্রি করে যা কিছু পাই, বাবা-মাকে সাহায্য করি, লগে আমাগো স্কুল খরচটা হয়ে যায়। তা ছাড়া স্যার সবচেয়ে বড় কথা, ভালো লাগে। কত্ত রকম মানুষ আসে এইখানে, সেসব মানুষের সঙ্গে পরিচয়, তারপর কথা বলা। মজাই পাই স্যার। এই যেমন একবার এক ভিনদেশি আইসা কয়েক দিন ঘুরল, সব কয় দিন আমরা তার লগে ছিলাম। সেই বিদেশি আমারে ফোটো তোলা শেখাইছে। আমারে লগে নিবার চাইছিল, যাই নাই।’ নূরুন নবীরা তিন ভাই। সবার বড় সে। তারপর তুহিন ও নাছির। বই বিক্রি করে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। নির্ভর করে দর্শনার্থীদের ওপর। যত বেশি দর্শনার্থী, লাভ তত বেশি। নূর ইসলাম একলা। ওর কোনো ভাইবোন নেই। আমরা বের হতে হতে ওদের দুজনকেই প্রশ্ন করেছিলাম, বড় হলে কী হবি?
প্রায় চিৎকার করে দুজনই বলে ওঠে—স্যার, ফটোগ্রাফার!
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.comনূরুন নবী তখন তার হাতের একগাদা চটি বই সবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তারপর এই বইতে। আপনি খালি এই বেহুলার বাসর নয়, পুরো মহাস্থানগড়ের ইতিহাস পাবেন এই বইতে। দাম মাত্র পঁচিশ টাকা। লগে আজকের গাইড হিসাবে আমারে।’ প্রতিদিন এভাবেই মহাস্থানগড়ের ইতিহাসসমৃদ্ধ বই বিক্রি করে চলেছেন মোহাম্মদ নূর ইসলাম এবং মোহাম্মদ নূরুন নবী।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে বেহুলার বাসর দেখতে গিয়ে আমরা এই দুজনের দেখা পাই। পরিচয় পর্বের পর আমাদের দুজনেরই দুই নূরকে মনে ধরল। তা ছাড়া একটু পর মনে হলো, ওরাও আমাদের পছন্দ করে ফেলেছে। যদি তা-ই না হতো, তাহলে বই বিক্রি ফেলে তারা আমাদের সঙ্গে ঘুরত না। এখানকার গোকুল মেধ নামক স্তূপটি বেহুলার বাসর নামে খ্যাত। আমরা চলে এসেছি সেই স্তূপটির একেবারে ওপরে। হাতে ক্যামেরা, সমানে ক্লিক করে চলেছি। এর মধ্যে নূর ইসলাম বলে, ‘স্যার, দেন আমি আপনেগো ছবি তুইলা দেই।’
অফারটা মন্দ নয়। এখানে যে এলাম, আমাদেরও কিছু স্মৃতি থাকা চাই। আমি ক্যামেরা ওর গলায় ঝুলিয়ে যেই ক্যামেরা চালানো বিষয়ে একটু বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে গেছি, দেখি সেই আমাকে শেখানো শুরু করেছে। ‘রোদ বেশি স্যার’। আট অ্যাপারচারে ছবি তুলি, আমি বিষম খেলাম। বলে কী ছোকরা! এভাবেই আমরা তার মডেল হয়ে গেলাম। ‘স্যার, এই দিকটায় দাঁড়ান, এভাবে দাঁড়ান, ম্যাডাম একটু দূরের দিকে তাকান।’ আমরা তার বাধ্য মডেল, সে যা বলছিল, করে যাচ্ছিলাম। কী এক আচ্ছন্নতায় ছিলাম। এদিকে আমার সঙ্গীও তার ক্যামেরায় নূর ইসলামের ছবি তুলে চলেছে। একসময় ঘোর কাটে। ছবি তোলা এবং দর্শন শেষ করে আমরা নিচে নেমে আসি। তারপর কথা বলি নূর ইসলাম এবং মোহাম্মদ নূরুন নবীর সঙ্গে। দুজনের বয়সই ১১-১২ ছুঁই ছুঁই। গোকুলবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। সামনের বছর মেয়ারহাট স্কুলে ভর্তি হবে। প্রশ্ন করলাম, স্কুল পাল্টাবে কেন? ‘কী করমু স্যার! উপবৃত্তি দেওয়ার কথা, দেয় না। ঠিকমতো ক্লাস হয় না। আমরা স্যার ফাঁকিবাজ না। পড়ালেখা করমু, অনেক বড় হমু। মেয়ারহাট স্কুল ভালো, তাই সেখানে ভর্তি হমু।’
‘বই বিক্রি করো ক্যান?’
‘ধরেন স্যার, নতুন স্কুলে ভর্তি হইলে বই কেনা লাগব, স্কুল ড্রেস কত কি! আমার বাবার পক্ষে সেসব করা একটু কষ্টকর। তাই বই বিক্রি করে যা কিছু পাই, বাবা-মাকে সাহায্য করি, লগে আমাগো স্কুল খরচটা হয়ে যায়। তা ছাড়া স্যার সবচেয়ে বড় কথা, ভালো লাগে। কত্ত রকম মানুষ আসে এইখানে, সেসব মানুষের সঙ্গে পরিচয়, তারপর কথা বলা। মজাই পাই স্যার। এই যেমন একবার এক ভিনদেশি আইসা কয়েক দিন ঘুরল, সব কয় দিন আমরা তার লগে ছিলাম। সেই বিদেশি আমারে ফোটো তোলা শেখাইছে। আমারে লগে নিবার চাইছিল, যাই নাই।’ নূরুন নবীরা তিন ভাই। সবার বড় সে। তারপর তুহিন ও নাছির। বই বিক্রি করে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। নির্ভর করে দর্শনার্থীদের ওপর। যত বেশি দর্শনার্থী, লাভ তত বেশি। নূর ইসলাম একলা। ওর কোনো ভাইবোন নেই। আমরা বের হতে হতে ওদের দুজনকেই প্রশ্ন করেছিলাম, বড় হলে কী হবি?
প্রায় চিৎকার করে দুজনই বলে ওঠে—স্যার, ফটোগ্রাফার!
ফারুখ আহমেদ
No comments