বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৭২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।খন্দকার মতিউর রহমান, বীর বিক্রম বীর যোদ্ধা কুশলী যোদ্ধা সকাল হতেই চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল, শহরের উপকণ্ঠ থেকে রংপুর থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে।


সারা শহরে আনন্দের ঢেউ। এরপর প্রতিরোধযুদ্ধরত ইপিআর সদস্যরা সমবেত হলেন শহরের সার্কিট হাউসে। তাঁদের একটি অংশের নেতৃত্বে খন্দকার মতিউর রহমান। ইপিআর মোট ৩৯ জন। তাঁরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে থাকা সেনাক্যাম্প আক্রমণের। এ ঘটনা বগুড়ায়। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল।
রংপুর সেনানিবাস থেকে এসে একদল পাকিস্তানি সেনা ২৬ মার্চ সকালে বগুড়ায় আক্রমণ করে। স্থানীয় ছাত্র-জনতা তাদের প্রতিরোধ করে। এই প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে পার্শ্ববর্তী নওগাঁ জেলা থেকে খন্দকার মতিউর রহমানসহ একদল ইপিআর সদস্য ২৮ মার্চ রাতে বগুড়ায় এসে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রংপুর থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা ৩১ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে পালিয়ে যায়।
এদিকে, বগুড়া শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে আড়িয়াবাজারে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ডিপো। এর পাশে ছিল সেনাক্যাম্প। সেখানে নিয়োজিত ছিল সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট। সৈনিকদের বেশির ভাগ ছিল বাঙালি। কর্মকর্তা সবাই অবাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেখানকার বাঙালি সেনাসদস্যদের নিরস্ত্র করে বন্দী করা হয়। দু-তিনজন এর প্রতিবাদ করায় তাঁদের পাকিস্তানিরা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। ব্যাপারটা ক্যাম্পের ভেতরে ঘটলেও খবরটা আর চাপা রইল না।
আড়িয়াবাজার ক্যাম্পে অবরুদ্ধ বাঙালি সৈনিকদের কথা জানতে পেয়ে ১ এপ্রিলই খন্দকার মতিউর রহমান সেখানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধা দলের পুলিশের ৫০ জন ও ২০ জন অস্ত্রধারী স্বেচ্ছাসেবক। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তাঁরা তিন দিক থেকে আড়িয়াবাজারের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। তখন দুই পক্ষে শুরু হয় গুলিবৃষ্টি। পাকিস্তানিরা অবিরাম গুলি চালিয়ে যেতে থাকল। ঘণ্টা খানেক পর খবর পেয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর বিমান আকাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা সবকিছু উপেক্ষা করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। স্থানীয় গ্রামবাসীও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেন। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। আড়িয়াবাজারের যুদ্ধে খন্দকার মতিউর রহমান যথেষ্ট বীরত্ব ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সেদিন যুদ্ধে প্রতিরোধযোদ্ধাদের একজন পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন।
খন্দকার মতিউর রহমান চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন নওগাঁ ইপিআর উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। আড়িয়াবাজার যুদ্ধের পর তিনি যুদ্ধ করেন পাবনা জেলার কাশিনাথপুরে, পরে ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ী সাব-সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য খন্দকার মতিউর রহমানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৯২।
খন্দকার মতিউর রহমানের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা: গ্রাম-তেলানগর, সদর উপজেলা, নরসিংদী। তাঁর বাবার নাম খন্দকার সদরউদ্দীন আহমেদ। মা জামিলা খাতুন। তাঁর দুই স্ত্রী—সাহেরা খাতুন ও নাজমা খাতুন। তাঁদের চার ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড, নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.