সাদা-কথাঃ একবিংশ শতাব্দীর বইমেলা by মুহম্মদ নূরুল হুদা
আবার এসেছে ফেবুয়ারি। আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো অমর ফেব্রুয়ারি। বাঙালির চেতনাপ্রবাহের নবায়নের সাক্ষী বিবর্তিত ফেব্রুয়ারি। সঙ্গে এনেছে বাঙালির সৃষ্টিশীলতার শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনী ফেব্রুয়ারির বইমেলা। বরাবরের মতো মেলা এবারও শুরু হয়েছে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণজুড়ে।
না, শুধু প্রাঙ্গণ নয়, তার সম্মুখস্থ রাজপথেও। আশা করা হচ্ছিল এবার মেলার অংশবিশেষ প্রবেশ করবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেও, যেমনটি করেছিল বছর দুএক আগে। কেউ কেউ মেলাকে পরিত্যক্ত আণবিক ভবন এলাকায় নেয়ার কথাও বলেছেন। তাতে স্বল্পমেয়াদি সমাধান মিললেও দীর্ঘস্থায়ী ও স্থায়ী সমাধান মিলবে বলে মনে হয় না। প্রথম কথা, ভেতর প্রাঙ্গণে একাডেমী ভবন নির্মিত হওয়ার ফলে মেলার জায়গা অর্ধেক কমে গেছে। আণবিক শক্তি কমিশনের প্রাঙ্গণ নিয়ে তা পোষানো যাবে কিনা সন্দেহ। পোষাতে হলে বর্তমানে সেখানে যে ভবনটি বিদ্যমান, তা ভাঙতে হবে। সেটি কতটা যুক্তিযুক্ত হবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তেমন সিদ্ধান্তের পক্ষে নই। আর ভাঙা গেলে তো পুরো এলাকাটাই বাংলা একাডেমীকে দিয়ে দেয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হবেন কী? একাডেমীর দক্ষিণে যেখানে শিববাড়ি কোয়ার্টার নামে অস্থায়ী একতলা দালান কাঠামো আছে, সেই স্থানটিও তো একাডেমীকে দেয়া যায়। উত্তরে ও দক্ষিণে এই সম্প্র্রসারণ করা গেলে হয়তো এক দশকের জন্য মেলার স্থান ভেতর প্রাঙ্গণে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু তারপর? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার ও এই লেনদেনের ব্যাপারটি বেশ জটিল। গত চারদশকেও এর কোনো সমাধান হয়নি। কাজেই আমরা বিকল্প সমাধানের কথা ভাবাই শ্রেয় মনে করি। ধারণা করি, আগামী দু’দশকের মধ্যে মেলার অকল্পনীয় সম্প্রসারণ ঘটবে। অন্তত মেলার অতীত তার ইশারা দেয়। সত্তুর-দশকের শেষে যেখানে আট-দশটা স্টল ছিল এই মেলায়, সেখানে এবারে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০৫টি। ১৯৯৫-৯৬-তে এই স্টলসংখ্যা বেড়েছিল প্রায় নয়শ’-তে। তখন মেলা টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। মেলার সেই বর্ধিষ্ণু রূপকে আটকে রাখা না হলে এবারের মেলার রূপ হতো অভাবনীয়। যা হোক, মেলা নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে যে পরিকল্পনা কার্যকর রাখা হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে মেলার আয়তন না বাড়িয়ে উপায় থাকবে না। এর কারণ, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের প্রকাশনা শিল্পের অগ্রযাত্রা। প্রকাশক যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে যারা আগে একটি স্টল পেয়ে সন্তুষ্ট ছিল তারা একাধিক স্টলের সঙ্গত দাবিদার হয়ে উঠছে। এখন মেলায় প্যাভিলিয়ন বলতে কেবল বাংলা একাডেমী ও নজরুল ইনস্টিটিউটকেই বোঝায়। বৃহত্ প্রকাশনা সংস্থাগুলো তিন বা দুটি স্টল নিয়েই সন্তুষ্ট। এর অবশ্য কারণও আছে। বৃহত্ সংস্থাগুলো আবার একাধিক নামে তাদের অঙ্গ প্রকাশনা-সংস্থার স্টল বরাদ্দ নিয়ে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তবে খুব দেরি নেই যখন এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্যাভিলিয়ন দাবি করে বসবে। আমাদের ধারণা, এই দাবি অযৌক্তিকও নয়। অদূর ভবিষ্যতে বৃহত্ প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে তাদের প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে পৃথক পৃথক প্যাভিলিয়ন বা বড় স্টল দিতে হবে। এতে বরং মেলার রূপবৈচিত্র্য বাড়বে, মেলার কোনো অঙ্গহানি হবে না। কেবল কলকাতা বা অন্যান্য বিদেশি বইমেলায় নয়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত ঢাকা বইমেলাতেও এই ধরনের প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়ার ঐতিহ্য আছে। ক্রেতা বই দেখবে, বাছাই করবে, তারপর কিনবে। একদিকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ ও অন্যদিকে লেখক-পাঠক-ক্রেতার অবাধ চলাচল ও মেলামেশার জন্য মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত স্থানমুক্ত রাখা আবশ্যক। তাই কোনো অবস্থাতেই মেলাকে আর একাডেমী প্রাঙ্গণ বা তার সামনের রাস্তায় সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। মেলাকে তার বর্তমান বৈচিত্র্য নিয়ে আজ না হয় কাল প্রায় পূর্ণাঙ্গভাবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রবেশ করতেই হবে। তবে সেই প্রবেশ হবে একাডেমীর ভেতর প্রাঙ্গণের সঙ্গে নাড়ি ছিঁড়ে নয়, বরং নাড়ির বন্ধনটা অবিচ্ছিন্ন রেখে। স্পষ্ট করে বলতে চাই, এবারের মেলার যে কাঠামো তাকে ঠিক রেখেই মেলাকে সরাসরি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রবেশ করতে হবে। এখন তো পরিবেশ নষ্ট বা বৃক্ষনিধন হওয়ার আশঙ্কা নেই, যেমনটি দু’দশক আগে করেছিলেন আমাদের পরিবেশ-সচেতন সুশীল সমাজ। আইনশৃঙ্খলার সমস্যাও যে হবে না তা এবারের ঢাকা বইমেলা থেকে প্রমাণ পেয়েছি। বাংলা একাডেমীর সামনের রাস্তার সঙ্গে সংযোগ রেখে কালিমন্দিরের পুকুরের পাড় পর্যন্ত আপাতত মেলার জন্য স্থান বাড়ানোতে কোনো অসুবিধা আছে কী? আসলে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা, সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনাই এর জন্য যথেষ্ট। স্টল মালিকদের অভিযোগ, বাইরে বইয়ের বিক্রি কম হয়। এই আশঙ্কাকে দূর করার জন্য মেলার বর্তমান স্টলবিন্যাস অদলবদল করা যেতে পারে। অধিকাংশ তিন স্টল, প্যাভিলিয়ন ও বড় প্রকাশকদের রাস্তায় ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে নিয়ে ভেতরে প্রাঙ্গণে লিটল ম্যাগ, মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ইত্যাকার শৌখিন ও প্রদর্শনীমূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য স্থান বরাদ্দ করা হলে ভেতর প্রাঙ্গণে দর্শক-ক্রেতা-আড্ডাবাজদের অহেতুক ভিড় কমে যাবে। বাংলা একাডেমী একুশের মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালাও নিরাপদে আয়োজন করতে পারে। মোদ্দাকথা, ক্রেতা-জনতার ভেতরমুখী স্রোতকে বিভক্ত করে বহির্মুখী করতে হলে প্রধান প্রধান প্রকাশককেও বাইরে নিয়ে আসতে হবে। জানি এ নিয়ে বিতর্ক হবে, বড় প্রকাশকদের অনেকেই প্রথমে এতে রাজি হতে চাইবেন না। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের এই পথেই টেনে নিয়ে যাবে। একবিংশ শতাব্দীর বইমেলা হবে প্রাঙ্গণ-রাজপথ-উদ্যানময় জাতি বাঙালির এক বাড়ানো সীমানা।
লেখক : কবি; প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
লেখক : কবি; প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
No comments