ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার টিপাইমুখ প্রকল্প আগের মতোই রাখতে চাইছে by আতাউস সামাদ
টিপাইমুখে বরাক নদীর ওপর ভারত সরকার যে অতিকায় বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে সে সম্পর্কে ভাটির দেশ বাংলাদেশ এবং ভারতেরই মনিপুর ও আসাম রাজ্যে তীব্র প্রতিবাদ হলেও নয়াদিল্লি সেটা তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলেছে।
ভারত সরকার প্রথমে বাংলাদেশের একটা সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে, তারপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে ও সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের পর্যায়ক্রমিক দিল্লি সফরের সময় আশ্বাস দিয়েছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হতে পারে টিপাইমুখে তারা এমন কোনো কাজ করবে না। কিন্তু ভারত থেকে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে সে সবের ভিত্তিতে বলা চলে যে, এসব আশ্বাসবাণী নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সন্দেহজনক তথা প্রদত্ত আশ্বাসের বিপরীতধর্মী উক্তি করা হচ্ছে। এমনই এক মন্তব্য এসেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সমাপ্ত হওয়ার পরপরই, জানুয়ারি ১৮ তারিখে। টিপাইমুখ বাঁধ থেকে তার ভাটিতে দক্ষিণ আসামসহ কারও কোনো ক্ষতি হবে না, ওইদিন ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী এ মন্তব্য করেছেন। তার ওই উক্তি ও পরবর্তী সময়ে তার প্রতিবাদ হওয়া সম্পর্কে আমরা জেনেছি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণ থেকে। এ নিয়ে আর কিছু বলার আগে খানিকটা প্রেক্ষাপট আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন।
শেখ হাসিনা সরকারিভাবে ভারত সফর করেন গত জানুয়ারি মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত। তার সফর সম্পন্ন হলে সে সম্পর্কে গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকার পত্রিকায় যে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয় তার ৩১ নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, ‘The Prime Minister of India reiterated the assurance that India would not take steps on the Tipaimukh project that would adversely impact Bangladesh.’ আমার ভাষায় এই বাক্যের বঙ্গানুবাদ দাঁড়ায়, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ভারত টিপাইমুখ প্রকল্পে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না বাংলাদেশে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া/ফল হবে।’ লক্ষণীয় যে, এই বাক্যটিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার কোনো সম্ভাবনার কথা বলেননি, বরঞ্চ বাক্য গঠন এমনভাবেই করা হয়েছে যাতে একথা স্পষ্ট হয় যে, টিপাইমুখ প্রকল্প নামে একটা প্রকল্প বিদ্যমান। তারপরই যখন বলা হচ্ছে যে, এতে ‘ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না’ (যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়) তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হবে। অতঃপর বাকি থাকল বাংলাদেশের ক্ষতি হওয়া না হওয়ার প্রশ্নটি। এই প্রশ্নটি বিবেচনার সময় দুটো বিষয় মনে রাখতে হবে। যথা— ১. যে কোনো নদীতে যে কোনো ধরনের বাঁধ দিলেই তার উজান ও ভাটি দুই দিকেই কোনো না কোনো প্রভাব পড়ে এবং সেজন্যই আজকাল দুনিয়াজুড়ে আন্দোলন হচ্ছে বাঁধের বিরুদ্ধে এবং ২. টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে বাংলাদেশের যে ভীতি ও আশঙ্কাটি প্রবল তা হলো, এত বিরাট যে, এটি একবার তৈরি হয়ে গেলে এর বিরূপ প্রভাব এদেশে পড়বেই; বিশেষ করে বরাক নদী থেকে যখন বাংলাদেশের দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার উত্পত্তি এবং ওই দুই নদীর সম্মিলিত ধারা দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের একটি প্রধান নদী মেঘনা। এখন ভারত সরকার বলে আসছে যে, টিপাইমুখ বাঁধ থেকে বাংলাদেশের উপকারই হবে, কারণ এটা দিয়ে বরাক নদীকে নিয়ন্ত্রণ করে বর্ষার সময় ভাটিতে এর পানির প্রবাহের পরিমাণ এখনকার চেয়ে কম রাখা যাবে যার ফলে বাংলাদেশে ও আসামে বন্যার প্রকোপ কমবে। আবার, শীত এবং গ্রীষ্মে টিপাইমুখ জলাধার থেকে পানি কিছু বেশি পরিমাণে ছাড়া হবে যাতে ভাটিতে বরাক নদীতে পানি এখনকার চেয়ে বেশি থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে সব সময়ই পানি ছাড়তে হবে, কারণ ওই প্রবহমান পানি দিয়েই টারবাইন ঘুরিয়ে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করবে ভারত। বাংলাদেশে টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি যুক্তি হচ্ছে, বরাক নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করায় সিলেটের হাওর অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং এক সময় এসব হাওর বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আবার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তীরগুলোতে ভাঙন শুরু হবে, নতুন চর পড়বে এবং মেঘনার প্রকৃতি পাল্টে যাবে। তদুপরি গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টিপাইমুখ বাঁধের ভাটিতে ভারত যদি তার প্রস্তাবিত অপর একটি সেচ প্রকল্পে পানি নেয়ার জন্য আরেকটি বাঁধ দেয়, তাহলে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ফারাক্কা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এসবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জনগণের দাবি হচ্ছে ভারত যেন টিপাইমুখে কোনো বাঁধ না করে। যেহেতু এ পর্যন্ত এই বাঁধটির শুধু পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে, নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি, তাই এটি একেবারেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা এখনও সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত দীর্ঘ নিবন্ধে এই যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, অপরিহার্য বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলোতে পাহাড়ি এলাকায় ছোট আকারের অনেক বাঁধ দিতে পারে। এতে ভাটিতে কম ক্ষতি হবে।
কিন্তু ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাতিল করা তো দূরের কথা, তার আদি পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলেছে। ভারতের আসাম প্রদেশের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত সুপরিচিত আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় গত ৩১ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে Centre urged to address impact of dams শিরোনামের প্রতিবেদনে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ওই রাজ্যের কয়েকটি সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠী ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী শ্রী জয়রাম রমেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রস্তাবিত বাঁধসমূহের প্রতিক্রিয়া (impact of dams) বিভিন্ন রাজ্যের ভাটি অঞ্চলে কী হবে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। (পাঠক, লক্ষ্য করবেন পত্রিকাটি এখানে শুধু টিপাইমুখ নয় একাধিক বড় বাঁধের কথা বলছে।) এই সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠীগুলো শ্রী জয়রাম রমেশের একটি সাম্প্রতিক মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। পত্রিকাটিতে ফেব্রুয়ারি ১ তারিখে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতীয় বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী গত ১৮ জানুয়ারি, সম্পাদকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সামাজিক সমস্যাবিষয়ক ১০ম সম্মেলনে (Editor’s Conference on Social Sector Issues, সংক্ষেপে ECSSI) টিপাইমুখ প্রকল্পের ভাটিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলো নাকচ করে দেন। মন্ত্রী বরঞ্চ দাবি করেন যে, আসামের বরাক উপত্যকার অধিবাসীরা টিপাইমুখ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখতে দৃঢ়সংকল্প।
তবে আসাম ট্রিবিউনের ওই প্রতিবেদন বলছে, ‘কিন্তু এও সত্য যে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনার সময় দক্ষিণ আসামে প্রকল্পটির কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে।
আসাম ট্রিবিউন-এর ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে : “The MoEF granted environmental clearance to the Tipaimukh project on October 24, 2008 without a comprehensive downstream impact study and public consultation in southern Assam.
While public hearings were held in upstream Manipur and Mizoram, the MoEF did not ask for public hearings in southern Assam despite it being in the impact zone of the project. Even though public hearings were not held in southern Assam, the Union Environment Minister has come to a conclusion that people of Barak valley were ‘determined’ to have the project.
While there are indeed some supporters of the project in Barak Valley, there are also others concerned about its negative impact. The MoEF would have got a correct picture about this if it had bothered to hold public consultations in southern Assam.
আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার প্রতিবেদনের উপরোক্ত অংশে যা বলা হয়েছে, বাংলায় সংক্ষেপে তা হলো যে, দক্ষিণ আসামে কোনো অনুসন্ধান এবং জনগণের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই টিপাইমুখ প্রকল্পের ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ দিয়েছে দিল্লি সরকার। দ্বিতীয়ত, সরকার মনিপুর ও মিজোরামে এই প্রকল্প সম্পর্কে প্রকাশ্যে জনশুনানি করলেও দক্ষিণ আসামে তা করেনি। তা সত্ত্বেও মন্ত্রী দাবি করছেন যে, বরাক উপত্যকার অধিবাসীরা প্রকল্পটি পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আলোচ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরাক উপত্যকার অধিবাসীদের মধ্যে টিপাইমুখ প্রকল্পের যেমন কিছু সমর্থক আছেন তেমনই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিরাও আছেন। তাই দক্ষিণ আসামে জনশুনানি করলে সরকার প্রকৃত চিত্রটি পেত।
আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার ৩১ জানুয়ারি তারিখের প্রতিবেদনে (যা প্রকাশিত হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি) নয়াদিল্লি সরকারকে এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বরাক উপত্যকার কয়েকটি সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠী বেশ কিছুদিন ধরে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে এই প্রকল্পটির বিরোধিতা করে আসছে। বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা গত বছর জুলাই মাসে লক্ষ্মীপুর নামক স্থানে জনসভা এবং আগস্ট মাসে শিলচর-এর ডেপুটি কমিশনার অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেছে। এই অবস্থান ধর্মঘটে কৃষক, সাংবাদিক, লেখক এবং সংস্কৃতি ও সমাজকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। আসাম ট্রিবিউন আরও বলেছে যে, প্রতিবাদকারীরা ওই মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। টিপাইমুখ বাঁধের বিপদ নিয়ে উদ্বিগ্নরা ভাটিতে ওই প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ডিসেম্বর ২৯, ২০০৯ তারিখে শিলচরে একটি সেমিনার করেন। এতে অংশগ্রহণকারী সংগঠন সোসাইটি অব অ্যাক্টিভিস্টস অ্যান্ড ভলান্টিয়ার্স ফর এনভায়রনমেন্ট (সেভ), কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইউডিও), দলছুট ও আরও অন্যরা প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে সরাসরি নিষেধ করেছে। তবুও ভারত সরকার শুধু টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিষয়েই নয়, অরুণাচল রাজ্যে লোহিত নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি ১৭৫০ মেগাওয়াট পানি বিদ্যুত্ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কোনো রকম জনমত যাচাই বা ওই প্রস্তাবিত বাঁধের ভাটিতে আসামের যে এলাকা আছে সেখানে এটার কী প্রতিক্রিয়া হবে তা পর্যালোচনা ছাড়াই এই বিশাল বাঁধ প্রকল্পের পক্ষে সুপারিশ করেছে।
আমাদের মনে হয়, আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যাবলী বিবেচনা করে বাংলাদেশের জনগণের ও সরকারের দুশ্চিন্তা গভীরতর হওয়া উচিত। কারণ, এক্ষেত্রে তো সরাসরি এই প্রশ্নই উঠছে যে, ভারত সরকার যখন টিপাইমুখ বাঁধের ভাটিতে তার নিজের দেশের নাগরিকদের উদ্বেগ ও আপত্তি কানে তুলছে না, এমন কী তাদের সঙ্গে বা ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপটি পর্যন্ত করছে না, তখন তারা অন্য দেশ বাংলাদেশের আপত্তি শুনবে কেন? বরঞ্চ আমাদের ধরে নিতে হবে যে, নয়াদিল্লি সরকার বাংলাদেশের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে—এ কথাটিই স্বীকার করবে না, যেমন করেনি ফারাক্কা বাঁধের বেলায়। তাই আমাদের ওই বাঁধের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে ভারতের কাছে তো বটেই, জাতিসংঘ ও বিশ্বদরবারে প্রতিবাদ জানাবার জন্য সব ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। সেজন্য সরকারকে অনতিবিলম্বে একটি জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি বা প্যানেল নিয়োগ করে তার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিরীক্ষা, জরিপ, গবেষণা, মডেল স্ট্যাডি এবং মাঠপর্যায়ে জনগণের সঙ্গে বৈঠক (জনশুনানি) করে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনতিবিলম্বে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। তারপর ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমাদের আপত্তি জানিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর শেষ করে দেশে ফিরে যে সংবাদ সম্মেলনে করেন, তাতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে তার মন্তব্যগুলোর মধ্য দু’টি ছিল : ১. টিপাইমুখে যে কী হচ্ছে তা তিনি নিজেও ভালো মতো জানেন না; এবং ২. ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হবে টিপাইমুখ প্রকল্পে এমন কিছু করা হবে না। এই মুহূর্ত পর্যন্ত সেই কথা শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর কী আছে। প্রধানমন্ত্রীর উক্তি এখানে আমি নিজের ভাষায় লিখেছি, কাজেই তার কথার সঙ্গে সামান্য অমিল হতে পারে তা মেনে নিচ্ছি। তবু এক্ষেত্রে এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে : ১. আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এখন আমরা জেনে গেছি যে, ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী জানুয়ারি ১৮ তারিখে, অর্থাত্ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের মাত্র পাঁচদিন পরেই বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কিত আসামের জনগণের আপত্তি মিথ্যা প্রচারণামাত্র এবং ওই প্রকল্প দ্বারা কারও কোনো ক্ষতি হবে না। অতএব, এও জানা হয়ে গেছে যে, ভারত টিপাইমুখে তার বিতর্কিত প্রস্তাব অনুযায়ী বাঁধ বানাবার সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে। ফলে এখন আমাদের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছেন তার ওপর আর নির্ভর করা যাচ্ছে না। সে রকম নির্ভর করার প্রয়োজনীয়তাও নেই। কারণ, ভারত তার বর্তমান পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে। কাজেই আমরা নিজেরা সেটির নিরিখেই প্রয়োজনীয় গবেষণা ও বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেব যে, ওই বাঁধের ফলে আমাদের কত ক্ষতি হবে এবং সেই অনুযায়ী আমাদের সরকার তার কর্তব্য নির্ধারণ করবে।
একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুরোধ করব যে, যারাই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বা ট্রানজিট চুক্তির বিরোধিতা করবে তারাই ভারত-বিরোধী হবে আর সেজন্য তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার সরকারেরও শত্রু বা প্রতিপক্ষ হবে, তিনি যেন একথা না ভাবেন। এ ব্যাপারে তাকে একটু উদার ও সচেতন হতে হবে। কারণ, তার চারপাশে কিছু লোক আছে যারা বলে আসছেন যে, ভারত-বিরোধিতা মানেই বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধিতা করা। এরা তিনটি অপকৌশল নিচ্ছেন—১. ভারতের খারাপ কাজের সমালোচনাকে ভারত-বিরোধিতা বলে চাপিয়ে দিচ্ছেন, ২. বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বিশাল মুনাফা করে শিক্ষা, চিকিত্সা ও সংস্কৃতি খাতগুলোতে ব্যবসা বিস্তার করে, ভূ-রাজনীতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবে পেয়ে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সমর্থন পেয়ে ভারত যে বিশালভাবে উপকৃত হচ্ছে সেই সত্যটি তারা বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছেন এবং এতে করে একদিকে দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের বীজ বপন তো করছেনই, তারা বাংলাদেশের জনগণকে বর্তমান সরকার সম্পর্কেও সন্দিহান করে তুলছেন এবং ৩. ভারতের যেসব কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে মুখ না খোলার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। এসব লোক সম্পর্কে তাকে ও দেশবাসীকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে।
আমরা আগেও বলেছি এবং এই লেখাটা শেষ করার আগে আবার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানির বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা বন্দরে প্রবাহিত করায় বাংলাদেশের যে দারুণ ক্ষতি এবং অসুবিধা হচ্ছে এই বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সংক্রান্ত যৌথ ইশতেহারে একটি শব্দও না থাকা বাংলাদেশের জনগণের জন্য খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. আশরাফ দেওয়ান ঢাকায় দি ডেইলি স্টার পত্রিকায় ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে একটি ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মায় পানি প্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ তার প্রাপ্য হিস্যা পাচ্ছে না। আমরা মনে করি, এ অবস্থায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা উল্লেখ থাকা যৌক্তিক হতো। তাহলে বাংলাদেশ সরকার যৌথ ইশতেহারে এই বিষয়ে নীরব থাকতে রাজি হলো কেন? এখানে বলে রাখি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া একবার ভারত সফর শেষে সাংবাদিকদের কাছে গঙ্গার পানি বিষয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, এ সম্পর্কে আলাপ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। তার মন্তব্য কিন্তু ছিল ঠাট্টা, কারণ তার সেই সফর সম্পর্কে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির সমস্যা সম্পর্কে দুই দেশের বক্তব্য নিয়ে দুই-তিনটি প্যারাগ্রাফ ছিল। এবার যৌথ ইশতেহারে গঙ্গ
শেখ হাসিনা সরকারিভাবে ভারত সফর করেন গত জানুয়ারি মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত। তার সফর সম্পন্ন হলে সে সম্পর্কে গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকার পত্রিকায় যে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয় তার ৩১ নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, ‘The Prime Minister of India reiterated the assurance that India would not take steps on the Tipaimukh project that would adversely impact Bangladesh.’ আমার ভাষায় এই বাক্যের বঙ্গানুবাদ দাঁড়ায়, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ভারত টিপাইমুখ প্রকল্পে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না বাংলাদেশে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া/ফল হবে।’ লক্ষণীয় যে, এই বাক্যটিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার কোনো সম্ভাবনার কথা বলেননি, বরঞ্চ বাক্য গঠন এমনভাবেই করা হয়েছে যাতে একথা স্পষ্ট হয় যে, টিপাইমুখ প্রকল্প নামে একটা প্রকল্প বিদ্যমান। তারপরই যখন বলা হচ্ছে যে, এতে ‘ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না’ (যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়) তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হবে। অতঃপর বাকি থাকল বাংলাদেশের ক্ষতি হওয়া না হওয়ার প্রশ্নটি। এই প্রশ্নটি বিবেচনার সময় দুটো বিষয় মনে রাখতে হবে। যথা— ১. যে কোনো নদীতে যে কোনো ধরনের বাঁধ দিলেই তার উজান ও ভাটি দুই দিকেই কোনো না কোনো প্রভাব পড়ে এবং সেজন্যই আজকাল দুনিয়াজুড়ে আন্দোলন হচ্ছে বাঁধের বিরুদ্ধে এবং ২. টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে বাংলাদেশের যে ভীতি ও আশঙ্কাটি প্রবল তা হলো, এত বিরাট যে, এটি একবার তৈরি হয়ে গেলে এর বিরূপ প্রভাব এদেশে পড়বেই; বিশেষ করে বরাক নদী থেকে যখন বাংলাদেশের দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার উত্পত্তি এবং ওই দুই নদীর সম্মিলিত ধারা দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের একটি প্রধান নদী মেঘনা। এখন ভারত সরকার বলে আসছে যে, টিপাইমুখ বাঁধ থেকে বাংলাদেশের উপকারই হবে, কারণ এটা দিয়ে বরাক নদীকে নিয়ন্ত্রণ করে বর্ষার সময় ভাটিতে এর পানির প্রবাহের পরিমাণ এখনকার চেয়ে কম রাখা যাবে যার ফলে বাংলাদেশে ও আসামে বন্যার প্রকোপ কমবে। আবার, শীত এবং গ্রীষ্মে টিপাইমুখ জলাধার থেকে পানি কিছু বেশি পরিমাণে ছাড়া হবে যাতে ভাটিতে বরাক নদীতে পানি এখনকার চেয়ে বেশি থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে সব সময়ই পানি ছাড়তে হবে, কারণ ওই প্রবহমান পানি দিয়েই টারবাইন ঘুরিয়ে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করবে ভারত। বাংলাদেশে টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি যুক্তি হচ্ছে, বরাক নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করায় সিলেটের হাওর অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং এক সময় এসব হাওর বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আবার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তীরগুলোতে ভাঙন শুরু হবে, নতুন চর পড়বে এবং মেঘনার প্রকৃতি পাল্টে যাবে। তদুপরি গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টিপাইমুখ বাঁধের ভাটিতে ভারত যদি তার প্রস্তাবিত অপর একটি সেচ প্রকল্পে পানি নেয়ার জন্য আরেকটি বাঁধ দেয়, তাহলে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ফারাক্কা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এসবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জনগণের দাবি হচ্ছে ভারত যেন টিপাইমুখে কোনো বাঁধ না করে। যেহেতু এ পর্যন্ত এই বাঁধটির শুধু পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে, নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি, তাই এটি একেবারেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা এখনও সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত দীর্ঘ নিবন্ধে এই যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, অপরিহার্য বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলোতে পাহাড়ি এলাকায় ছোট আকারের অনেক বাঁধ দিতে পারে। এতে ভাটিতে কম ক্ষতি হবে।
কিন্তু ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাতিল করা তো দূরের কথা, তার আদি পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলেছে। ভারতের আসাম প্রদেশের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত সুপরিচিত আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় গত ৩১ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে Centre urged to address impact of dams শিরোনামের প্রতিবেদনে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ওই রাজ্যের কয়েকটি সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠী ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী শ্রী জয়রাম রমেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রস্তাবিত বাঁধসমূহের প্রতিক্রিয়া (impact of dams) বিভিন্ন রাজ্যের ভাটি অঞ্চলে কী হবে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। (পাঠক, লক্ষ্য করবেন পত্রিকাটি এখানে শুধু টিপাইমুখ নয় একাধিক বড় বাঁধের কথা বলছে।) এই সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠীগুলো শ্রী জয়রাম রমেশের একটি সাম্প্রতিক মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। পত্রিকাটিতে ফেব্রুয়ারি ১ তারিখে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতীয় বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী গত ১৮ জানুয়ারি, সম্পাদকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সামাজিক সমস্যাবিষয়ক ১০ম সম্মেলনে (Editor’s Conference on Social Sector Issues, সংক্ষেপে ECSSI) টিপাইমুখ প্রকল্পের ভাটিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলো নাকচ করে দেন। মন্ত্রী বরঞ্চ দাবি করেন যে, আসামের বরাক উপত্যকার অধিবাসীরা টিপাইমুখ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখতে দৃঢ়সংকল্প।
তবে আসাম ট্রিবিউনের ওই প্রতিবেদন বলছে, ‘কিন্তু এও সত্য যে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনার সময় দক্ষিণ আসামে প্রকল্পটির কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে।
আসাম ট্রিবিউন-এর ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে : “The MoEF granted environmental clearance to the Tipaimukh project on October 24, 2008 without a comprehensive downstream impact study and public consultation in southern Assam.
While public hearings were held in upstream Manipur and Mizoram, the MoEF did not ask for public hearings in southern Assam despite it being in the impact zone of the project. Even though public hearings were not held in southern Assam, the Union Environment Minister has come to a conclusion that people of Barak valley were ‘determined’ to have the project.
While there are indeed some supporters of the project in Barak Valley, there are also others concerned about its negative impact. The MoEF would have got a correct picture about this if it had bothered to hold public consultations in southern Assam.
আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার প্রতিবেদনের উপরোক্ত অংশে যা বলা হয়েছে, বাংলায় সংক্ষেপে তা হলো যে, দক্ষিণ আসামে কোনো অনুসন্ধান এবং জনগণের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই টিপাইমুখ প্রকল্পের ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ দিয়েছে দিল্লি সরকার। দ্বিতীয়ত, সরকার মনিপুর ও মিজোরামে এই প্রকল্প সম্পর্কে প্রকাশ্যে জনশুনানি করলেও দক্ষিণ আসামে তা করেনি। তা সত্ত্বেও মন্ত্রী দাবি করছেন যে, বরাক উপত্যকার অধিবাসীরা প্রকল্পটি পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আলোচ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরাক উপত্যকার অধিবাসীদের মধ্যে টিপাইমুখ প্রকল্পের যেমন কিছু সমর্থক আছেন তেমনই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিরাও আছেন। তাই দক্ষিণ আসামে জনশুনানি করলে সরকার প্রকৃত চিত্রটি পেত।
আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার ৩১ জানুয়ারি তারিখের প্রতিবেদনে (যা প্রকাশিত হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি) নয়াদিল্লি সরকারকে এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বরাক উপত্যকার কয়েকটি সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠী বেশ কিছুদিন ধরে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে এই প্রকল্পটির বিরোধিতা করে আসছে। বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা গত বছর জুলাই মাসে লক্ষ্মীপুর নামক স্থানে জনসভা এবং আগস্ট মাসে শিলচর-এর ডেপুটি কমিশনার অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেছে। এই অবস্থান ধর্মঘটে কৃষক, সাংবাদিক, লেখক এবং সংস্কৃতি ও সমাজকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। আসাম ট্রিবিউন আরও বলেছে যে, প্রতিবাদকারীরা ওই মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। টিপাইমুখ বাঁধের বিপদ নিয়ে উদ্বিগ্নরা ভাটিতে ওই প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ডিসেম্বর ২৯, ২০০৯ তারিখে শিলচরে একটি সেমিনার করেন। এতে অংশগ্রহণকারী সংগঠন সোসাইটি অব অ্যাক্টিভিস্টস অ্যান্ড ভলান্টিয়ার্স ফর এনভায়রনমেন্ট (সেভ), কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইউডিও), দলছুট ও আরও অন্যরা প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে সরাসরি নিষেধ করেছে। তবুও ভারত সরকার শুধু টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিষয়েই নয়, অরুণাচল রাজ্যে লোহিত নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি ১৭৫০ মেগাওয়াট পানি বিদ্যুত্ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কোনো রকম জনমত যাচাই বা ওই প্রস্তাবিত বাঁধের ভাটিতে আসামের যে এলাকা আছে সেখানে এটার কী প্রতিক্রিয়া হবে তা পর্যালোচনা ছাড়াই এই বিশাল বাঁধ প্রকল্পের পক্ষে সুপারিশ করেছে।
আমাদের মনে হয়, আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যাবলী বিবেচনা করে বাংলাদেশের জনগণের ও সরকারের দুশ্চিন্তা গভীরতর হওয়া উচিত। কারণ, এক্ষেত্রে তো সরাসরি এই প্রশ্নই উঠছে যে, ভারত সরকার যখন টিপাইমুখ বাঁধের ভাটিতে তার নিজের দেশের নাগরিকদের উদ্বেগ ও আপত্তি কানে তুলছে না, এমন কী তাদের সঙ্গে বা ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপটি পর্যন্ত করছে না, তখন তারা অন্য দেশ বাংলাদেশের আপত্তি শুনবে কেন? বরঞ্চ আমাদের ধরে নিতে হবে যে, নয়াদিল্লি সরকার বাংলাদেশের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে—এ কথাটিই স্বীকার করবে না, যেমন করেনি ফারাক্কা বাঁধের বেলায়। তাই আমাদের ওই বাঁধের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে ভারতের কাছে তো বটেই, জাতিসংঘ ও বিশ্বদরবারে প্রতিবাদ জানাবার জন্য সব ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। সেজন্য সরকারকে অনতিবিলম্বে একটি জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি বা প্যানেল নিয়োগ করে তার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিরীক্ষা, জরিপ, গবেষণা, মডেল স্ট্যাডি এবং মাঠপর্যায়ে জনগণের সঙ্গে বৈঠক (জনশুনানি) করে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনতিবিলম্বে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। তারপর ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমাদের আপত্তি জানিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর শেষ করে দেশে ফিরে যে সংবাদ সম্মেলনে করেন, তাতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে তার মন্তব্যগুলোর মধ্য দু’টি ছিল : ১. টিপাইমুখে যে কী হচ্ছে তা তিনি নিজেও ভালো মতো জানেন না; এবং ২. ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হবে টিপাইমুখ প্রকল্পে এমন কিছু করা হবে না। এই মুহূর্ত পর্যন্ত সেই কথা শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর কী আছে। প্রধানমন্ত্রীর উক্তি এখানে আমি নিজের ভাষায় লিখেছি, কাজেই তার কথার সঙ্গে সামান্য অমিল হতে পারে তা মেনে নিচ্ছি। তবু এক্ষেত্রে এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে : ১. আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এখন আমরা জেনে গেছি যে, ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী জানুয়ারি ১৮ তারিখে, অর্থাত্ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের মাত্র পাঁচদিন পরেই বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কিত আসামের জনগণের আপত্তি মিথ্যা প্রচারণামাত্র এবং ওই প্রকল্প দ্বারা কারও কোনো ক্ষতি হবে না। অতএব, এও জানা হয়ে গেছে যে, ভারত টিপাইমুখে তার বিতর্কিত প্রস্তাব অনুযায়ী বাঁধ বানাবার সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে। ফলে এখন আমাদের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছেন তার ওপর আর নির্ভর করা যাচ্ছে না। সে রকম নির্ভর করার প্রয়োজনীয়তাও নেই। কারণ, ভারত তার বর্তমান পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে। কাজেই আমরা নিজেরা সেটির নিরিখেই প্রয়োজনীয় গবেষণা ও বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেব যে, ওই বাঁধের ফলে আমাদের কত ক্ষতি হবে এবং সেই অনুযায়ী আমাদের সরকার তার কর্তব্য নির্ধারণ করবে।
একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুরোধ করব যে, যারাই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বা ট্রানজিট চুক্তির বিরোধিতা করবে তারাই ভারত-বিরোধী হবে আর সেজন্য তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার সরকারেরও শত্রু বা প্রতিপক্ষ হবে, তিনি যেন একথা না ভাবেন। এ ব্যাপারে তাকে একটু উদার ও সচেতন হতে হবে। কারণ, তার চারপাশে কিছু লোক আছে যারা বলে আসছেন যে, ভারত-বিরোধিতা মানেই বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধিতা করা। এরা তিনটি অপকৌশল নিচ্ছেন—১. ভারতের খারাপ কাজের সমালোচনাকে ভারত-বিরোধিতা বলে চাপিয়ে দিচ্ছেন, ২. বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বিশাল মুনাফা করে শিক্ষা, চিকিত্সা ও সংস্কৃতি খাতগুলোতে ব্যবসা বিস্তার করে, ভূ-রাজনীতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবে পেয়ে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সমর্থন পেয়ে ভারত যে বিশালভাবে উপকৃত হচ্ছে সেই সত্যটি তারা বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছেন এবং এতে করে একদিকে দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের বীজ বপন তো করছেনই, তারা বাংলাদেশের জনগণকে বর্তমান সরকার সম্পর্কেও সন্দিহান করে তুলছেন এবং ৩. ভারতের যেসব কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে মুখ না খোলার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। এসব লোক সম্পর্কে তাকে ও দেশবাসীকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে।
আমরা আগেও বলেছি এবং এই লেখাটা শেষ করার আগে আবার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানির বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা বন্দরে প্রবাহিত করায় বাংলাদেশের যে দারুণ ক্ষতি এবং অসুবিধা হচ্ছে এই বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সংক্রান্ত যৌথ ইশতেহারে একটি শব্দও না থাকা বাংলাদেশের জনগণের জন্য খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. আশরাফ দেওয়ান ঢাকায় দি ডেইলি স্টার পত্রিকায় ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে একটি ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মায় পানি প্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ তার প্রাপ্য হিস্যা পাচ্ছে না। আমরা মনে করি, এ অবস্থায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা উল্লেখ থাকা যৌক্তিক হতো। তাহলে বাংলাদেশ সরকার যৌথ ইশতেহারে এই বিষয়ে নীরব থাকতে রাজি হলো কেন? এখানে বলে রাখি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া একবার ভারত সফর শেষে সাংবাদিকদের কাছে গঙ্গার পানি বিষয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, এ সম্পর্কে আলাপ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। তার মন্তব্য কিন্তু ছিল ঠাট্টা, কারণ তার সেই সফর সম্পর্কে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির সমস্যা সম্পর্কে দুই দেশের বক্তব্য নিয়ে দুই-তিনটি প্যারাগ্রাফ ছিল। এবার যৌথ ইশতেহারে গঙ্গ
No comments