মিসর-মোবারকবিরোধীদের রাজনৈতিক উদ্যোগ by রবার্ট ফিস্ক
গত শুক্রবার তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীরা নতুন সামরিক বেষ্টনীর ভেতরে কাটাল। দাঙ্গাবিরোধী সৈন্য আর কাঁটাতার দিয়ে তাদের ঘিরে রাখা হলো। বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওয়াশিংটন এই ব্যবস্থাই চেয়েছিল। এর মধ্যেই হোসনি মোবারকের উচ্ছেদপ্রত্যাশী হাজার হাজার মিসরীয় প্রথমবারের মতো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিল।
৩০ বছরের দুর্নীতিপরায়ণ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী গণবিক্ষোভের প্রথম রাজনৈতিক উদ্যোগ এটি।
কদিনের পথযুদ্ধে ভাঙা পাথরের টুকরো ও আবর্জনার মধ্যে নোংরা ফুটপাতে বসে তারা ২৫ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এক তালিকা তৈরি করেছে, যাঁরা নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নতুন সংবিধান তৈরির আলোচনা করবেন। তালিকায় নাম এসেছে আরব লীগের মহাসচিব আমর মুসা; নোবেলজয়ী আহমেদ জুওয়াইল (এই মিসরীয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা ছিলেন); মোহাম্মদ সেলিম আল-আওয়া (অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে বহু গ্রন্থপ্রণেতা, মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ) ও ওয়াফদ পার্টির সভাপতি সাইদ আল-বাদাবির। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: কায়রোর নামকড়া ব্যবসায়ী নাগিব সুয়েজ (গত সপ্তাহে মোবারকের বন্ধ করে দেওয়া মোবাইল ফোন-ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত); জাতিসংঘে মিসরীয় প্রতিনিধি নাবিল আল-আরাবি ও হার্ট সার্জন মাগদি ইয়াকুব।
এসব ব্যক্তিকে বাছাই আর তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারী ও ফেসবুক-টুইটার ‘নির্বাচকদের’ অস্থায়ী কমিটি গঠনের ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা হয়নি। কিন্তু বর্তমানের ঘৃণিত প্রেসিডেন্টকে উচ্ছেদের পর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সেই দিশার সন্ধানে এটা সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদকে রাজনৈতিক পথে পরিচালিত করার প্রথম আন্তরিক প্রচেষ্টা। প্রস্তাবিত কমিটির প্রথম দায়িত্ব হবে মিসরের নতুন সংবিধান তৈরি ও নির্বাচনের নতুন ব্যবস্থা খাড়া করা, যা জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে মোবারকের আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার জোচ্চুরি থেকে রেহাই দেবে। বর্তমানের নিয়ম বদলে এমন ব্যবস্থা করা হবে, যাতে কোনো প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ পরপর দুই দফা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন আর প্রতি দফার মেয়াদ ছয় থেকে কমিয়ে চার বছর করা হবে।
এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা সন্দেহাতীতভাবে জানে যে সাহসী এই কাজকে সুনির্দিষ্ট রাজনীতিতে নিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যৎ ভীষণ অন্ধকার। তাহরির স্কয়ারে রাতের বেলা আরও কিছু অনিষ্টকর ঘটনা ঘটেছে—মারা গেছেন এক প্রকৌশলী, এক আইনজীবী ও এক তরুণ। আবারও সাদা পোশাকে পুলিশের সন্ধান মিলেছে। দিনের বেলা বিপুল সেনা উপস্থিতি সত্ত্বেও পাথর নিক্ষেপের ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটেছে। আর বেশির ভাগ বিক্ষোভকারী আতঙ্কে রয়েছে যে স্কয়ার ছেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে, তাদের পরিবারও বাদ যাবে না। মোবারকের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাযন্ত্র এর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
যেসব বিক্ষোভকারী বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, তাদের অনেকের আর হদিস না পাওয়ার খবর আসছে। কমিটি-বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেওয়া মিসরীয় লেখক মোহাম্মদ ফাদেল ফাহমির কথায় আতঙ্কের আভাস পাওয়া যায়, ‘যতক্ষণ এই স্কয়ার আমাদের, ততক্ষণ আমরা নিরাপদ।’ এ কথা বলে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তাঁর নাম লিখি—তাঁর কাঙ্ক্ষিত মুক্তির প্রতীক হিসেবে: ‘এই স্কয়ার আমাদের হাতছাড়া হলে মোবারক সব বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করবেন। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়ানক পুলিশি শাসন কায়েম হবে। তাই নিজেদের জীবনের জন্যই এ লড়াই।’
কারা টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিয়েছেন কিংবা সংবাদপত্র, ফেসবুক বা টুইটারে লিখেছেন, তাঁদের এক লম্বা তালিকা এখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পুলিশের হাতে।
বিক্ষোভকারীরা নজর রাখছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পান্ডাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান বিভক্তির ওপর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রক্ষীদের সঙ্গে তিন দিন আগে সেনাসদস্যদের গুলিবিনিময় হয়। ভূগর্ভস্থ নির্যাতনকক্ষগুলো তখনো তাদের দখলে আর রাজপথের লড়াইয়ে অক্ষত রয়ে গেছে। আমেরিকা প্রেরিত বন্দীদের এসব কক্ষেই ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো হতো। মোবারকের অধিকতর ধর্ষকামী নির্যাতকেরা যাতে নির্বিঘ্নে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালাতে পারে। এই সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে মিসরীয় শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশ্বস্ত’ মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
কমিটি নির্বাচনে জড়িত আরেক তরুণ বললেন, সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ওমর সুলেইমানকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও অতীতে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে এই সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেছেন মোবারক। সুলেইমানই সেই ব্যক্তি, যিনি পুরো সংকটের দায় বিদেশি গণমাধ্যমের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর ক্ষমতার প্রথম প্রকাশই কলুষতা ও অসততায় ভরা। তবে তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীদের সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করে বেশ চতুরতার সঙ্গে তিনি বিক্ষোভকারীদের কৌশলে পরাভূত করলেন।
শুক্রবার সকালে আমরা যারা স্কয়ারের পশ্চিমাংশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাদের সবাইকে স্তম্ভিত করে কালো কাচের গাড়িবহর আচমকা পার্শ্ববর্তী মিসরীয় জাদুঘরের বাগানের ভেতর থেকে আবির্ভূত হলো। ধীরগতিতে এসে আমাদের সামনে থামল। তৎক্ষণাৎ লাল টুপি পরা এলিট গার্ড আর বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী তাদের ঘিরে দাঁড়াল। নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা রাইফেল, টেলিস্কোপিক সাইট-সংবলিত। মাঝের গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন ক্ষুদ্রকায়, চশমা পরিহিত মিসরের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ হোসেন তানতাবি। তিনি মোবারকের আজীবন বন্ধু। তাঁর মাথায় হালকা সবুজ সামরিক টুপি আর কাঁধে জেনারেলের আড়াআড়ি তলোয়ারের তকমা।
তাঁর আগমন শ্বাসরুদ্ধকর। এই অসাধারণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যেসব বিক্ষোভকারী সামরিক বেষ্টনীর কাছে জড়ো হয়েছিল, তাদের উদ্দেশে তিনি হাত নাড়লেন। জনতা গর্জে উঠল, ‘মিসরীয় সেনাবাহিনী আমাদের সেনাবাহিনী।’ মিলিত কণ্ঠে তারা বলতে থাকল, ‘কিন্তু মোবারক আমাদের নয়।’ বন্ধু মোবারকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বার্তা তো এটাই। কিন্তু তানতাবির এই সফরও তো শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক। মোবারক যতই চিৎকার করুন যে তাঁর উচ্ছেদের দাবির পেছনে ‘বিদেশি শক্তির হাত’ আছে আর বিদেশি সাংবাদিকদের সম্পর্কে সুলেইমান যত মিথ্যাই প্রচার করুন না কেন, এসব ছাপিয়ে তানতাবি দেখিয়েছিলেন যে বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি সেনাবাহিনী আন্তরিকভাবে নিয়েছে। যারা মোবারকের বিদায় চায়, তাদের ওপর সেনাবাহিনী কোনো গুলি চালাবে না, কেননা তাদের দাবি ‘বৈধ’—সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এই বিবৃতিতে তানতাবির সায় আছে। তাই সেনাবাহিনীর নিষ্ঠার ব্যাপারে বিক্ষোভকারীরা নিঃসংশয়।
প্রস্তাবিত কমিটি থেকে বাদ পড়াদের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ নাম জাতিসংঘের সাবেক অস্ত্র পরিদর্শক ও নোবেলজয়ী মোহাম্মদ এলবারাদি আর মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা। মোবারক ও ইসরায়েলিরা সব সময় যে ইসলামপন্থীদের ভূত দেখিয়ে আমেরিকানদের প্ররোচিত করতে চায় বুড়ো মোবারককে ক্ষমতাসীন রাখতে, সেটি হলো এই মুসলিম ব্রাদারহুড। মোবারকের বিদায়ের আগে কোনো আলোচনা নয়—এই হলো মুসলিম ব্রাদারহুডের অবস্থান। আর এলবারাদির প্রতি তাদের সমর্থন আছে। এসব কারণেই কার্যত এদের বাদ দেওয়া হয়। অবশ্য সুলেইমান চালাকি করে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ব্রাদারহুডকে। তিনি তো ভালো করেই জানেন, মোবারকের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আলোচনায় বসবে না।
কমিটিতে আল-আওয়া ও ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী আহমেদ কামাল আবু মাগদের প্রস্তাবিত উপস্থিতি সুলেইমানের সঙ্গে আলোচনায় ব্রাদারহুডের ভাবনার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। এসব আলোচনায় নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকারের প্রসঙ্গ যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে ‘প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব পালন করতে না পারার’ কারণে সুলেইমানকে সামরিকভাবে শাসনকাজ চালানোর অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিও।
মোবারক যদি প্রকাশ্যে বা আড়ালে কোনোভাবেই দেশের রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা না রাখার ব্যাপারে সম্মত হন, তাহলে তাঁকে দেশের ভেতর একান্ত ব্যক্তিগত জীবন যাপন করতে দেওয়া হবে।
মোবারককে এখনো প্রচণ্ড শক্ত প্রতিপক্ষ মনে করা হয়। ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারলে বিরোধীদের বিনাশ করতে তাঁর কোনো দ্বিধা থাকবে না: ‘মোবারক পুরোনো জমানার লোক। গত দুই দিনে তাঁর আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আমাদের ওপর হামলা ও গুলি করে মারার পেছনে আসলে ওই লোকটাই।’ এ কথা বললেন প্রস্তাবিত কমিটির এক সমর্থক। এ কথার মানে মোহাম্মদ ফাহমি ভালো করেই জানেন। সাত বছর ধরে তাঁর বাবা নির্বাসনে। এককালে তিনি মোবারক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আজকের বিক্ষোভের মতোই প্রতিবাদের কথা বলেছিলেন।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
কদিনের পথযুদ্ধে ভাঙা পাথরের টুকরো ও আবর্জনার মধ্যে নোংরা ফুটপাতে বসে তারা ২৫ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এক তালিকা তৈরি করেছে, যাঁরা নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নতুন সংবিধান তৈরির আলোচনা করবেন। তালিকায় নাম এসেছে আরব লীগের মহাসচিব আমর মুসা; নোবেলজয়ী আহমেদ জুওয়াইল (এই মিসরীয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা ছিলেন); মোহাম্মদ সেলিম আল-আওয়া (অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে বহু গ্রন্থপ্রণেতা, মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ) ও ওয়াফদ পার্টির সভাপতি সাইদ আল-বাদাবির। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: কায়রোর নামকড়া ব্যবসায়ী নাগিব সুয়েজ (গত সপ্তাহে মোবারকের বন্ধ করে দেওয়া মোবাইল ফোন-ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত); জাতিসংঘে মিসরীয় প্রতিনিধি নাবিল আল-আরাবি ও হার্ট সার্জন মাগদি ইয়াকুব।
এসব ব্যক্তিকে বাছাই আর তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারী ও ফেসবুক-টুইটার ‘নির্বাচকদের’ অস্থায়ী কমিটি গঠনের ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা হয়নি। কিন্তু বর্তমানের ঘৃণিত প্রেসিডেন্টকে উচ্ছেদের পর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সেই দিশার সন্ধানে এটা সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদকে রাজনৈতিক পথে পরিচালিত করার প্রথম আন্তরিক প্রচেষ্টা। প্রস্তাবিত কমিটির প্রথম দায়িত্ব হবে মিসরের নতুন সংবিধান তৈরি ও নির্বাচনের নতুন ব্যবস্থা খাড়া করা, যা জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে মোবারকের আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার জোচ্চুরি থেকে রেহাই দেবে। বর্তমানের নিয়ম বদলে এমন ব্যবস্থা করা হবে, যাতে কোনো প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ পরপর দুই দফা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন আর প্রতি দফার মেয়াদ ছয় থেকে কমিয়ে চার বছর করা হবে।
এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা সন্দেহাতীতভাবে জানে যে সাহসী এই কাজকে সুনির্দিষ্ট রাজনীতিতে নিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যৎ ভীষণ অন্ধকার। তাহরির স্কয়ারে রাতের বেলা আরও কিছু অনিষ্টকর ঘটনা ঘটেছে—মারা গেছেন এক প্রকৌশলী, এক আইনজীবী ও এক তরুণ। আবারও সাদা পোশাকে পুলিশের সন্ধান মিলেছে। দিনের বেলা বিপুল সেনা উপস্থিতি সত্ত্বেও পাথর নিক্ষেপের ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটেছে। আর বেশির ভাগ বিক্ষোভকারী আতঙ্কে রয়েছে যে স্কয়ার ছেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে, তাদের পরিবারও বাদ যাবে না। মোবারকের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাযন্ত্র এর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
যেসব বিক্ষোভকারী বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, তাদের অনেকের আর হদিস না পাওয়ার খবর আসছে। কমিটি-বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেওয়া মিসরীয় লেখক মোহাম্মদ ফাদেল ফাহমির কথায় আতঙ্কের আভাস পাওয়া যায়, ‘যতক্ষণ এই স্কয়ার আমাদের, ততক্ষণ আমরা নিরাপদ।’ এ কথা বলে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তাঁর নাম লিখি—তাঁর কাঙ্ক্ষিত মুক্তির প্রতীক হিসেবে: ‘এই স্কয়ার আমাদের হাতছাড়া হলে মোবারক সব বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করবেন। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়ানক পুলিশি শাসন কায়েম হবে। তাই নিজেদের জীবনের জন্যই এ লড়াই।’
কারা টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিয়েছেন কিংবা সংবাদপত্র, ফেসবুক বা টুইটারে লিখেছেন, তাঁদের এক লম্বা তালিকা এখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পুলিশের হাতে।
বিক্ষোভকারীরা নজর রাখছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পান্ডাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান বিভক্তির ওপর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রক্ষীদের সঙ্গে তিন দিন আগে সেনাসদস্যদের গুলিবিনিময় হয়। ভূগর্ভস্থ নির্যাতনকক্ষগুলো তখনো তাদের দখলে আর রাজপথের লড়াইয়ে অক্ষত রয়ে গেছে। আমেরিকা প্রেরিত বন্দীদের এসব কক্ষেই ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো হতো। মোবারকের অধিকতর ধর্ষকামী নির্যাতকেরা যাতে নির্বিঘ্নে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালাতে পারে। এই সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে মিসরীয় শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশ্বস্ত’ মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
কমিটি নির্বাচনে জড়িত আরেক তরুণ বললেন, সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ওমর সুলেইমানকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও অতীতে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে এই সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেছেন মোবারক। সুলেইমানই সেই ব্যক্তি, যিনি পুরো সংকটের দায় বিদেশি গণমাধ্যমের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর ক্ষমতার প্রথম প্রকাশই কলুষতা ও অসততায় ভরা। তবে তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীদের সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করে বেশ চতুরতার সঙ্গে তিনি বিক্ষোভকারীদের কৌশলে পরাভূত করলেন।
শুক্রবার সকালে আমরা যারা স্কয়ারের পশ্চিমাংশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাদের সবাইকে স্তম্ভিত করে কালো কাচের গাড়িবহর আচমকা পার্শ্ববর্তী মিসরীয় জাদুঘরের বাগানের ভেতর থেকে আবির্ভূত হলো। ধীরগতিতে এসে আমাদের সামনে থামল। তৎক্ষণাৎ লাল টুপি পরা এলিট গার্ড আর বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী তাদের ঘিরে দাঁড়াল। নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা রাইফেল, টেলিস্কোপিক সাইট-সংবলিত। মাঝের গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন ক্ষুদ্রকায়, চশমা পরিহিত মিসরের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ হোসেন তানতাবি। তিনি মোবারকের আজীবন বন্ধু। তাঁর মাথায় হালকা সবুজ সামরিক টুপি আর কাঁধে জেনারেলের আড়াআড়ি তলোয়ারের তকমা।
তাঁর আগমন শ্বাসরুদ্ধকর। এই অসাধারণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যেসব বিক্ষোভকারী সামরিক বেষ্টনীর কাছে জড়ো হয়েছিল, তাদের উদ্দেশে তিনি হাত নাড়লেন। জনতা গর্জে উঠল, ‘মিসরীয় সেনাবাহিনী আমাদের সেনাবাহিনী।’ মিলিত কণ্ঠে তারা বলতে থাকল, ‘কিন্তু মোবারক আমাদের নয়।’ বন্ধু মোবারকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বার্তা তো এটাই। কিন্তু তানতাবির এই সফরও তো শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক। মোবারক যতই চিৎকার করুন যে তাঁর উচ্ছেদের দাবির পেছনে ‘বিদেশি শক্তির হাত’ আছে আর বিদেশি সাংবাদিকদের সম্পর্কে সুলেইমান যত মিথ্যাই প্রচার করুন না কেন, এসব ছাপিয়ে তানতাবি দেখিয়েছিলেন যে বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি সেনাবাহিনী আন্তরিকভাবে নিয়েছে। যারা মোবারকের বিদায় চায়, তাদের ওপর সেনাবাহিনী কোনো গুলি চালাবে না, কেননা তাদের দাবি ‘বৈধ’—সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এই বিবৃতিতে তানতাবির সায় আছে। তাই সেনাবাহিনীর নিষ্ঠার ব্যাপারে বিক্ষোভকারীরা নিঃসংশয়।
প্রস্তাবিত কমিটি থেকে বাদ পড়াদের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ নাম জাতিসংঘের সাবেক অস্ত্র পরিদর্শক ও নোবেলজয়ী মোহাম্মদ এলবারাদি আর মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা। মোবারক ও ইসরায়েলিরা সব সময় যে ইসলামপন্থীদের ভূত দেখিয়ে আমেরিকানদের প্ররোচিত করতে চায় বুড়ো মোবারককে ক্ষমতাসীন রাখতে, সেটি হলো এই মুসলিম ব্রাদারহুড। মোবারকের বিদায়ের আগে কোনো আলোচনা নয়—এই হলো মুসলিম ব্রাদারহুডের অবস্থান। আর এলবারাদির প্রতি তাদের সমর্থন আছে। এসব কারণেই কার্যত এদের বাদ দেওয়া হয়। অবশ্য সুলেইমান চালাকি করে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ব্রাদারহুডকে। তিনি তো ভালো করেই জানেন, মোবারকের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আলোচনায় বসবে না।
কমিটিতে আল-আওয়া ও ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী আহমেদ কামাল আবু মাগদের প্রস্তাবিত উপস্থিতি সুলেইমানের সঙ্গে আলোচনায় ব্রাদারহুডের ভাবনার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। এসব আলোচনায় নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকারের প্রসঙ্গ যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে ‘প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব পালন করতে না পারার’ কারণে সুলেইমানকে সামরিকভাবে শাসনকাজ চালানোর অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিও।
মোবারক যদি প্রকাশ্যে বা আড়ালে কোনোভাবেই দেশের রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা না রাখার ব্যাপারে সম্মত হন, তাহলে তাঁকে দেশের ভেতর একান্ত ব্যক্তিগত জীবন যাপন করতে দেওয়া হবে।
মোবারককে এখনো প্রচণ্ড শক্ত প্রতিপক্ষ মনে করা হয়। ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারলে বিরোধীদের বিনাশ করতে তাঁর কোনো দ্বিধা থাকবে না: ‘মোবারক পুরোনো জমানার লোক। গত দুই দিনে তাঁর আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আমাদের ওপর হামলা ও গুলি করে মারার পেছনে আসলে ওই লোকটাই।’ এ কথা বললেন প্রস্তাবিত কমিটির এক সমর্থক। এ কথার মানে মোহাম্মদ ফাহমি ভালো করেই জানেন। সাত বছর ধরে তাঁর বাবা নির্বাসনে। এককালে তিনি মোবারক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আজকের বিক্ষোভের মতোই প্রতিবাদের কথা বলেছিলেন।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
No comments