মহানগরীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই by লুৎফর রহমান রনো

কড়াইল বস্তি উচ্ছেদের প্রতিবাদে ৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিল বস্তিবাসী। একই দিনে সাতক্ষীরায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্রদের বিক্ষোভ ও অবরোধ ছিল শাহবাগ মোড়ে। এতে রাজধানীতে যানজটের সৃষ্টি হয়ে নাগরিকদের অশেষ ভোগান্তি পোহাতে হয়।


রাজধানীবাসীর ভোগান্তি, যানজট ও নগরীর অচলাবস্থার বিবরণই গুরুত্ব পায় মিডিয়াগুলোতে। অথচ ২০ বছর ধরে যারা একটি নিম্নমানের আবাসিক এলাকায় (বস্তি) বসবাস করে আসছে, তারা ২০ মিনিটে গৃহহীন হয়ে পড়ল। এই গৃহহীন মানুষের কষ্ট, অনিশ্চয়তা, গোছানো ঘর-সংসার তছনছ হয়ে যাওয়ার হতাশা ও ক্ষয়ক্ষতির কথা গৌণ হয়ে পড়ল। অবশ্য বস্তি উচ্ছেদ এই মহানগরীর পরিচিত ও প্রায় প্রতিবাদহীন একটি নিষ্ঠুরতা। হাজার হাজার মানুষের হতশ্বাস একসময় খোলা আকাশের বিস্তৃত প্রান্তরে মিলিয়ে যায়। দু-এক দিন মিডিয়ায় দু-একটি সংগঠনের বিবৃতি আসে- পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে বস্তি উচ্ছেদ করা যাবে না। এই গতানুগতিক ধারায় এসব নিষ্ঠুরতা অনেকটা ন্যায়সংগত হয়ে উঠেছে। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় অসহায়ত্তের অন্ধকার নেমে আসে, কিন্তু কেউই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এমন ভেঙেচুরে গেলেও সরকার মায়াকান্না করত, অন্যান্য সেবা সংস্থা এগিয়ে আসত...।
ইদানীং আমাদের আদালতকে নানা সময় অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ-নির্দেশ-পরামর্শ দিতে দেখা যায়। বস্তিবাসীর বেলায় তেমন কোনো স্বস্তির কারণ এখনো ঘটেনি। ঘটবে বলে মনে হয় না। বস্তিবাসীর বিড়ম্বনা নতুন নয়। সরকারি জমি, খাসজমি- এসব জবরদখল বা ইজারাবলে আবাসন ব্যবসায়ীরা আত্মসাৎ করে বহুতল ভবন তৈরি করেন। কেউ নির্মাণ করেন শপিং মল। কেউ বা নতুন গার্মেন্ট কারখানার জন্য ভিত্তি স্থাপন করেন। এসবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এ জাতীয় পদক্ষেপ সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উৎসাহ পেয়ে থাকে।
কথা হলো, মহানগরীর প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস করে বস্তি ও বস্তিতুল্য বাসাবাড়িতে। ক্রমশ এই নিম্নমানের ঘর-বস্তির বাসিন্দা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে হারে শহরের বাসাভাড়া বেড়েছে এবং আরো যে বাড়বে, সে পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণ হিসেবে একজন বাড়িওলা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, কম মাইনের লোকজনকে খুব শিগগির ঢাকার বাইরে চলে যেতে হবে। ভাড়া দিয়ে থাকার মতো অবস্থা থাকবে না বেশির ভাগ মানুষের। তিনি আরো বললেন, যে সরকার তিন মাসের মধ্যে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, পানি ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজছে, এ সরকারের পরিকল্পনাই বলা চলে- ঢাকা নগরী ধনীদের শহর হিসেবে গড়ে উঠুক। কথাগুলো অহেতুক নয়। গার্মেন্ট ও অন্যান্য কলকারখানার শ্রমিক এবং নিম্ন-আয়ের মানুষের বসবাসের জায়গা কোথায়? মাঝারি মাইনের অনেককেই বেতনের অর্ধেক গুনে দিতে হয় বাড়িভাড়ার জন্য। এই দুঃসহ সংকট উত্তরণের কোনো চিন্তাই নেই সরকারের। কারণ সংকট গরিব মানুষের। সরকারের উচ্চাভিলাষী চিন্তাভাবনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। উন্নয়নের সংজ্ঞা সরকারের সংশ্লিষ্ট চিন্তাবিদদের কাছে কিরূপ কে জানে। এ পর্যন্ত গত তিন বছরের কোনো পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের জীবন সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়নি। খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেল। কোনো কিছুরই আর দাম কমল না। বাড়িভাড়া বৃদ্ধি পেল অস্বাভাবিক মাত্রায়। কিছুদিন আগে ওষুধের দাম বাড়ল একেবারে অযৌক্তিকভাবে। এই সব কিছুর দাম বাড়ার পর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দাম বাড়ানোর কোনো কারণ ঘটেনি- ভোজ্য তেল থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ পর্যন্ত। সব কিছুরই দাম বাড়ানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের মর্জিতে, অধিক মুনাফার বাসনায়। আর এতে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে গিয়ে জীবনের মান নিম্নমুখী হয়েছে। অথচ সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। তারা ব্যস্ত মহাপরিকল্পনা নিয়ে- ডিসিসি, পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু ও সড়ক, সমুদ্র বিজয়, আকাশ বিচরণ, আন্তর্জাতিক জোটে সদস্যপদ, আগামী নির্বাচনের ধান্ধায় আর বিএনপির নানা কথাবার্তার পাল্টা জবাব দেওয়ার নিরর্থক চেষ্টায়। অপরদিকে মানুষ গৃহহীন হচ্ছে, ভাড়াবাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছে। পণ্যদ্রব্য ও ওষুধপত্র কেনা যাচ্ছে না। জীবনযাপনে সংকট তীব্র হচ্ছে। অথচ তারা ব্যবসায়ী, পণ্য উৎপাদক বা ওষুধ কম্পানির মালিকদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছে না। ব্যবসায়িক নিয়মনীতি, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির যুক্তি-ভিত্তি ইত্যাদি দেখাশোনার লোক নেই। তাহলে হচ্ছেটা কী? 'মহাপরিকল্পনাও' বাস্তবায়ন হয়নি একটিও। জনসাধারণের জীবনের স্বস্তিও দিন দিন শেষ হয়ে পড়ল। শুধু বিগত তিন বছরে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা হলেন লাভবান। তাঁদের জন্য তাই প্রয়োজন না-থাকা সত্ত্বেও ছয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলো। বাকি রয়েছে শুধু সরকারি ঘোষণার যে- 'এ দেশ শুধু ধনীদের, আমাদের, বাকিদের নয়।' আরো কয়েক মাস পরই শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনের তোড়জোড়। দলীয় পরামর্শক, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যুৎসই একটি নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করা হবে। নানা রঙের বাচনভঙ্গিতে ভোট চাওয়া হবে। অসমাপ্ত কাজ শেষ করার সুযোগ চাওয়া হবে!- এখনো সময় আছে, সাধারণ মানুষের জীবনের দিকে নজর দিন। লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.