খোলা জানালাঃ একটি মৃত্যু ও দেড় লাখ টাকার গল্প by ড. তারেক শামসুর রেহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক মারা গেল গত বুধবার ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে মাথায় আঘাত লেগে। মাথায় আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও। কেউ কেউ বলছেন এ আঘাত লেগেছে পুলিশের নিক্ষেপ করা টিয়ারগ্যাসের শেলে।
যদিও ডিএমপি অস্বীকার করেছে এ অভিযোগ। আর বৃহস্পতিবার আমরা জানলাম মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবু বকরের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা দেবে! একজন মেধাবী ছাত্রের জীবনের মূল্য মাত্র দেড় লাখ টাকা। মধুপুরের এক দিনমজুরের সন্তান ছিল আবু বকর। ভূমিহীন রুস্তম আলী, দিনমজুরি আর হকারি করে যার জীবন চলে, চেয়েছিলেন ছেলে আবু বকর তার দুঃখ লাঘব করবে। যে পরিবার বাবার একমাত্র উপার্জনে চলে, সেই পরিবারের সন্তানের সাধারণ উচ্চশিক্ষা আটকে যায়। কৈশোর ও যৌবনেও সংসারের বোঝা টানার জন্য বাবার পাশে এসে দাঁড়াতে হয় সন্তানকে। কিন্তু রুস্তম আলী তা করেননি। ধার-কর্জ করে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক’জনের সৌভাগ্য হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার? আবু বকর সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন ছিল। ক্লাসে ভালোও ছিল। ছাত্র রাজনীতি অপছন্দ করত। বাড়িতেও যেত না। কারণ, তাতে পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে। এখন লাশ হয়ে বাড়ি গেল। যে বাবা এক হাজার টাকা ধার করে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন, ধারের টাকা তিনি শোধও করতে পারেননি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবু বকর সিদ্দিকের লাশের সঙ্গে দেড় লাখ টাকার একটি ‘চেক’ও দেবে বাবা রুস্তম আলীকে। রুস্তম আলী তার ছেলেকে আর কোনোদিনই ফিরে পাবেন না। এই দেড় লাখ টাকায় একজন মেধাবী ছাত্রের মৃত্যুকে ‘কেনা’ যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। একই কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এ ধরনের কথা নতুন নয়। অতীতে যখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ‘পড়েছে’, ভিসিরা একই বক্তব্য দিয়েছেন। একই ধরনের বক্তব্য বার বার ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে একাধিক। এবারও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে; কিন্তু দিব্যি দিয়েই বলতে পারি এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কোনোদিনই আলোর মুখ দেখবে না। অতীতেও হয়নি। এবারও হবে না। ভিসি সাহেব বলেছেন দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে। আসলেই কি শাস্তি হবে? ছাত্রলীগের এফ রহমান হল কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সভাপতিকে বহিষ্কার করা হয়েছে। হল সভাপতিসহ ৮ জন আটক হয়েছে। ১৪ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে; কিন্তু খুনের মামলা কি হয়েছে? যদি খুনের মামলা না হয়ে থাকে, তাহলে তো দোষীদের শাস্তি দেয়া যাবে না। আবু বকরের বন্ধুরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে। তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এটা স্বাভাবিক। আবু বকরের ভাই, ভাই হত্যার বিচার চেয়েছেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একজন দিনমজুরের সন্তানের হত্যার বিচার হয় না। এসব দিনমজুর, রুস্তম আলীরা, সমাজের ‘কেউকেটা’ নন। সমাজের নামি-দামি ব্যক্তি নন। পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হয় না। তিনি তার সন্তানের হত্যার বিচার চাইতেই পারেন; কিন্তু সেই বিচার কোনোদিনই হবে না। সংবাদকর্মীরা আমাদের জানাচ্ছেন, গেল ৩৮ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪টি লাশ পড়েছে। এর মাঝে মাত্র দু’টির বিচার হয়েছে। বাকি ৭২টি হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। আজ তাই আবু বকরের মৃত্যু নিয়ে আমাকে ভাবায়। কেন এই মৃত্যু? স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের বিবাদের জের ধরেই ঘটল এই বিয়োগান্তক ঘটনা। হল কর্তৃপক্ষ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী এই মৃত্যুর দায়ভার এড়াতে পারেন? না, পারেন না। একজন ছাত্র যখন ক্যাম্পাসে থাকতে শুরু করে, তখন কর্তৃপক্ষই তার অভিভাবক। আমি খুশি হতাম যদি হল কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুর ঘটনায় ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করতেন। তারা তা করেননি। এমনকি ভিসি সাহেবও তার দায়ভার এড়াতে পারেন না। তিনি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত। তার কাছে তো তথ্য ছিল ওই হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের। দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনি উদ্যোগ নিলেন না কেন? তিনি কি স্বীকার করবেন, এটা তার ব্যর্থতা? ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ একজন ভিসি যখন দায়িত্ব নেন, তার দায়িত্ব কি শুধু ভিসি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা? বুধবার যারা বিবিসির বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান শুনেছেন, তারা আবু বকরের বন্ধুদের অভিযোগগুলো শুনেছেন। বন্ধুরা অভিযোগ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততাকে। তাদের অভিযোগগুলো মিথ্যা ছিল না। এখন ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিকে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম এই ১৫ দিনের জন্য। তদন্ত কমিটি যদি ‘তদন্তে’ কিছু খুঁজে না পায়(?), আমি অবাক হব না। এক সময় মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৭৪টি হত্যাকাণ্ডের মতো, এই হত্যাকাণ্ডকেও ভুলে যাবে। যেদিন আবু বকরের মৃত্যুর খবর ও সাধারণ ছাত্রদের অসন্তোষের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেদিন জাতীয় সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও ছাপা হয়েছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই ‘হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে একটি কথাও বললেন না। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম তিনি কথা বলবেন; কিন্তু তিনি বলবেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কোনো বিবৃতি দিলেন না সংসদে। এই ‘হত্যাকাণ্ড’কে কি তিনি গুরুত্ব মনে করলেন না? মেধাবী ছিল আবু বকর। হয়তো একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হতে পারত সে। তার বন্ধুরা তো এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল। তাহলে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়ায়, আমি শিক্ষক হিসেবে কষ্ট পেয়েছি।
আবু বকরের ‘মৃত্যু’ আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। যে রাজনীতি মেধাবী জীবন কেড়ে নেয়, সেই রাজনীতি আমরা চাই না। ক’দিন আগেও ছাত্রদলের সভাপতিকে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পিটিয়ে আহত করেছে সন্ত্রাসীরা। (১৯ জানুয়ারি)। অস্ত্রধারী যুবক পাশার ছবি ছেপেছিল সংবাদপত্রগুলোয়। রামদা হাতে পুলিশের পাশে দাঁড়ানো অপর এক যুবকের ছবিও ছাপা হয়েছিল। পুলিশ কি তাকে গ্রেফতার করেছিল? নাকি পুলিশ তাকে ‘প্রোটেকশন’ দিয়েছিল? ছবি তো কথা বলে। পুলিশ যখন সংঘর্ষ থামাতে(?) তত্পর, তখন তার পাশে একজন সন্ত্রাসী রামদা নিয়ে থাকে কীভাবে? পাঠক, ১৯ জানুয়ারির সমকাল আর ২০ জানুয়ারির আমার দেশ দেখুন। ছাত্রদল সভাপতির মাথায় খুব কাছ থেকে রেঞ্জ দিয়ে আঘাত করছে জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগ কর্মী বরকত (আমার দেশ)। চাপাতি হাতে ছাত্রলীগ কর্মী সাকিব। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। তাহলে পুলিশ এদের গ্রেফতার করল না কেন? নাকি ‘উপরের’ কোনো নির্দেশ ছিল না? এর জবাব সম্ভবত আমরা সবাই জানি। আজ একজন সাধারণ কৃষকের ছেলে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন হলে ‘সিট’ পেতে তাকে সাহায্য নিতে হয় ছাত্র নেতাদের। হল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা এখানে গৌণ হয়ে যায়। তারপর ওই ছাত্রটিকে বাধ্য করা হয় মিছিলে যোগ দিতে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে মিছিলে যেতে হয়। নাম লেখাতে হয়। এই হচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতি’। এই ‘ছাত্র রাজনীতি’ কি আমরা চাই! যে ছাত্র রাজনীতি একদিন এ দেশের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করেছে, আজকের ছাত্র রাজনীতি সেই নেতৃত্ব তৈরি করতে পারছে না। আজ তৈরি করছে পাশার মতো সন্ত্রাসীকে। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। সন্ত্রাসনির্ভর যে ছাত্র রাজনীতি, সেই রাজনীতি আমরা চাই না। অস্ত্রবাজ কোনো ছাত্রনেতাকে আমরা চাই না। চাপাতি হাতে যে ‘ছাত্র’ মিছিল করে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা উচিত। আমি জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সে ‘ক্ষমতা’ নেই। তিনি ‘উপরের নির্দেশ’ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। নিতে পারবেনও না। আজ তাই লাশ পড়বে। ভিসি সাহেব দুঃখ প্রকাশ করবেন। সিন্ডিকেট নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবে। এক সময় আবু বকরের মতো মেধাবী তরুণদের আমরা মনেও রাখব না।
তবুও একটা সময় বোধহয় এসেছে কথা বলার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভবুদ্ধির যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তারা কথাগুলো বলতে পারেন। সেমিনার করতে পারেন। এতে করে কিছুটা হলেও জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দুটি বড় দলকে। বড় দল দুটো যদি সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে তা কখনওই কার্যকর করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্বউদ্যোগে একটি ‘ডায়লগ’ ওপেন করতে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের যে সংগঠন রয়েছে, সেখানেও বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। তারা তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি বন্ধে সরকার প্রধানের কাছে কিছু সুপারিশ পেশ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। আমি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সেরও ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। জার্মানিতে ছাত্র রাজনীতিও আমার দেখা। নিউইয়র্কের বিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি গেছি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিকে আমি মেলাতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে থাকাকালীন সময়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা আমরা তৈরি করেছিলাম। সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল। এখনকার মঞ্জুরি কমিশন কি তেমনটি ভাবে? আমার মনে হয় না। যে অভিন্ন আইন আমরা তৈরি করেছিলাম, তা সম্ভবত ‘গভীর বরফে’ ঢাকা পড়ে গেছে। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বোধ করি এ ব্যাপারে আগ্রহ কম।
প্রয়াত আবু বকর আমার ছাত্রতুল্য। ছাত্র মানেই তো সন্তান। একজন ‘সন্তান’ যখন মারা যায়, বাবা সে ‘ভার’ বইতে পারে না। আবু বকরের মৃত্যু ‘ভার’ও আমি বইতে পারছি না। আসুন, আমরা সবাই মিলে দোষারোপের রাজনীতি পরিত্যাগ করে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলি। সীমিত সময়ের জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলেও, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন। তাতে করে রুস্তম আলীর মতো অনেক অভিভাবকের সমর্থন তিনি পাবেন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষক
ই-মেইল: tsrahmanbd@yahoo.com
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। একই কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এ ধরনের কথা নতুন নয়। অতীতে যখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ‘পড়েছে’, ভিসিরা একই বক্তব্য দিয়েছেন। একই ধরনের বক্তব্য বার বার ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে একাধিক। এবারও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে; কিন্তু দিব্যি দিয়েই বলতে পারি এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কোনোদিনই আলোর মুখ দেখবে না। অতীতেও হয়নি। এবারও হবে না। ভিসি সাহেব বলেছেন দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে। আসলেই কি শাস্তি হবে? ছাত্রলীগের এফ রহমান হল কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সভাপতিকে বহিষ্কার করা হয়েছে। হল সভাপতিসহ ৮ জন আটক হয়েছে। ১৪ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে; কিন্তু খুনের মামলা কি হয়েছে? যদি খুনের মামলা না হয়ে থাকে, তাহলে তো দোষীদের শাস্তি দেয়া যাবে না। আবু বকরের বন্ধুরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে। তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এটা স্বাভাবিক। আবু বকরের ভাই, ভাই হত্যার বিচার চেয়েছেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একজন দিনমজুরের সন্তানের হত্যার বিচার হয় না। এসব দিনমজুর, রুস্তম আলীরা, সমাজের ‘কেউকেটা’ নন। সমাজের নামি-দামি ব্যক্তি নন। পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হয় না। তিনি তার সন্তানের হত্যার বিচার চাইতেই পারেন; কিন্তু সেই বিচার কোনোদিনই হবে না। সংবাদকর্মীরা আমাদের জানাচ্ছেন, গেল ৩৮ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪টি লাশ পড়েছে। এর মাঝে মাত্র দু’টির বিচার হয়েছে। বাকি ৭২টি হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। আজ তাই আবু বকরের মৃত্যু নিয়ে আমাকে ভাবায়। কেন এই মৃত্যু? স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের বিবাদের জের ধরেই ঘটল এই বিয়োগান্তক ঘটনা। হল কর্তৃপক্ষ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী এই মৃত্যুর দায়ভার এড়াতে পারেন? না, পারেন না। একজন ছাত্র যখন ক্যাম্পাসে থাকতে শুরু করে, তখন কর্তৃপক্ষই তার অভিভাবক। আমি খুশি হতাম যদি হল কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুর ঘটনায় ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করতেন। তারা তা করেননি। এমনকি ভিসি সাহেবও তার দায়ভার এড়াতে পারেন না। তিনি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত। তার কাছে তো তথ্য ছিল ওই হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের। দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনি উদ্যোগ নিলেন না কেন? তিনি কি স্বীকার করবেন, এটা তার ব্যর্থতা? ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ একজন ভিসি যখন দায়িত্ব নেন, তার দায়িত্ব কি শুধু ভিসি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা? বুধবার যারা বিবিসির বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান শুনেছেন, তারা আবু বকরের বন্ধুদের অভিযোগগুলো শুনেছেন। বন্ধুরা অভিযোগ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততাকে। তাদের অভিযোগগুলো মিথ্যা ছিল না। এখন ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিকে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম এই ১৫ দিনের জন্য। তদন্ত কমিটি যদি ‘তদন্তে’ কিছু খুঁজে না পায়(?), আমি অবাক হব না। এক সময় মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৭৪টি হত্যাকাণ্ডের মতো, এই হত্যাকাণ্ডকেও ভুলে যাবে। যেদিন আবু বকরের মৃত্যুর খবর ও সাধারণ ছাত্রদের অসন্তোষের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেদিন জাতীয় সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও ছাপা হয়েছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই ‘হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে একটি কথাও বললেন না। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম তিনি কথা বলবেন; কিন্তু তিনি বলবেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কোনো বিবৃতি দিলেন না সংসদে। এই ‘হত্যাকাণ্ড’কে কি তিনি গুরুত্ব মনে করলেন না? মেধাবী ছিল আবু বকর। হয়তো একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হতে পারত সে। তার বন্ধুরা তো এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল। তাহলে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়ায়, আমি শিক্ষক হিসেবে কষ্ট পেয়েছি।
আবু বকরের ‘মৃত্যু’ আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। যে রাজনীতি মেধাবী জীবন কেড়ে নেয়, সেই রাজনীতি আমরা চাই না। ক’দিন আগেও ছাত্রদলের সভাপতিকে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পিটিয়ে আহত করেছে সন্ত্রাসীরা। (১৯ জানুয়ারি)। অস্ত্রধারী যুবক পাশার ছবি ছেপেছিল সংবাদপত্রগুলোয়। রামদা হাতে পুলিশের পাশে দাঁড়ানো অপর এক যুবকের ছবিও ছাপা হয়েছিল। পুলিশ কি তাকে গ্রেফতার করেছিল? নাকি পুলিশ তাকে ‘প্রোটেকশন’ দিয়েছিল? ছবি তো কথা বলে। পুলিশ যখন সংঘর্ষ থামাতে(?) তত্পর, তখন তার পাশে একজন সন্ত্রাসী রামদা নিয়ে থাকে কীভাবে? পাঠক, ১৯ জানুয়ারির সমকাল আর ২০ জানুয়ারির আমার দেশ দেখুন। ছাত্রদল সভাপতির মাথায় খুব কাছ থেকে রেঞ্জ দিয়ে আঘাত করছে জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগ কর্মী বরকত (আমার দেশ)। চাপাতি হাতে ছাত্রলীগ কর্মী সাকিব। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। তাহলে পুলিশ এদের গ্রেফতার করল না কেন? নাকি ‘উপরের’ কোনো নির্দেশ ছিল না? এর জবাব সম্ভবত আমরা সবাই জানি। আজ একজন সাধারণ কৃষকের ছেলে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন হলে ‘সিট’ পেতে তাকে সাহায্য নিতে হয় ছাত্র নেতাদের। হল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা এখানে গৌণ হয়ে যায়। তারপর ওই ছাত্রটিকে বাধ্য করা হয় মিছিলে যোগ দিতে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে মিছিলে যেতে হয়। নাম লেখাতে হয়। এই হচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতি’। এই ‘ছাত্র রাজনীতি’ কি আমরা চাই! যে ছাত্র রাজনীতি একদিন এ দেশের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করেছে, আজকের ছাত্র রাজনীতি সেই নেতৃত্ব তৈরি করতে পারছে না। আজ তৈরি করছে পাশার মতো সন্ত্রাসীকে। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। সন্ত্রাসনির্ভর যে ছাত্র রাজনীতি, সেই রাজনীতি আমরা চাই না। অস্ত্রবাজ কোনো ছাত্রনেতাকে আমরা চাই না। চাপাতি হাতে যে ‘ছাত্র’ মিছিল করে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা উচিত। আমি জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সে ‘ক্ষমতা’ নেই। তিনি ‘উপরের নির্দেশ’ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। নিতে পারবেনও না। আজ তাই লাশ পড়বে। ভিসি সাহেব দুঃখ প্রকাশ করবেন। সিন্ডিকেট নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবে। এক সময় আবু বকরের মতো মেধাবী তরুণদের আমরা মনেও রাখব না।
তবুও একটা সময় বোধহয় এসেছে কথা বলার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভবুদ্ধির যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তারা কথাগুলো বলতে পারেন। সেমিনার করতে পারেন। এতে করে কিছুটা হলেও জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দুটি বড় দলকে। বড় দল দুটো যদি সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে তা কখনওই কার্যকর করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্বউদ্যোগে একটি ‘ডায়লগ’ ওপেন করতে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের যে সংগঠন রয়েছে, সেখানেও বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। তারা তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি বন্ধে সরকার প্রধানের কাছে কিছু সুপারিশ পেশ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। আমি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সেরও ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। জার্মানিতে ছাত্র রাজনীতিও আমার দেখা। নিউইয়র্কের বিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি গেছি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিকে আমি মেলাতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে থাকাকালীন সময়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা আমরা তৈরি করেছিলাম। সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল। এখনকার মঞ্জুরি কমিশন কি তেমনটি ভাবে? আমার মনে হয় না। যে অভিন্ন আইন আমরা তৈরি করেছিলাম, তা সম্ভবত ‘গভীর বরফে’ ঢাকা পড়ে গেছে। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বোধ করি এ ব্যাপারে আগ্রহ কম।
প্রয়াত আবু বকর আমার ছাত্রতুল্য। ছাত্র মানেই তো সন্তান। একজন ‘সন্তান’ যখন মারা যায়, বাবা সে ‘ভার’ বইতে পারে না। আবু বকরের মৃত্যু ‘ভার’ও আমি বইতে পারছি না। আসুন, আমরা সবাই মিলে দোষারোপের রাজনীতি পরিত্যাগ করে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলি। সীমিত সময়ের জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলেও, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন। তাতে করে রুস্তম আলীর মতো অনেক অভিভাবকের সমর্থন তিনি পাবেন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষক
ই-মেইল: tsrahmanbd@yahoo.com
No comments