বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে গণসচেতনতা অতি জরুরি by কামরুল ইসলাম খান

বিগত বছরের মতো চলতি বছরেও বার্ড ফ্লু ছোবল মেরেছে বাংলাদেশে। সিরাজগঞ্জ জেলার রানীগ্রাম এবং জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় দুটি পোল্ট্রি ফার্মে বার্ড ফ্লু ধরা পড়েছে। এসব স্থানে ৩ হাজারের অধিক মুরগিকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। লাইভস্টক বিভাগের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, তিনি ভারত থেকে ডিম এবং বাচ্চা আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছেন (স্টার, ২৭/১/২০১০)।
বার্ড ফ্লু কী?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বার্ড ফ্লু এক ধরনের সংক্রমণী রোগ (Infectious disease)। এ রোগ শুধু পাখি থেকে পাখিতে নয়, এটা অবাধে পাখি থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। এ রোগের বৈজ্ঞানিক নাম এইচ-১ এন-১। বার্ড ফ্লুর বাহক হলো অতিথি পাখি। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁস-মুরগি, রাজহাঁস, টার্কি, তিতির, সামুদ্রিক চিল ইত্যাদি পাখির মাধ্যমে এই ফ্লুর ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। বার্ড ফ্লুর উপসর্গ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। দেহে প্রচণ্ড জ্বরের পাশাপাশি পেটের অসুখ (ডায়রিয়া) শুরু হবে। এর সঙ্গে দেখা দেবে ফুসফুসে সমস্যা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, বার্ড ফ্লু জীবাণুর একমাত্র বাহক হলো পাখি। সাধারণত, এই ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে থাকে। মানুষের দেহে প্রবেশ করার মাত্র কয়েকদিন পরেই শুরু হয়ে যায় ইনফ্লুয়েঞ্জা। রোগাক্রান্ত হওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

অতিথি নাকি শত্রু
ডিসেম্বর মাস থেকেই বাংলাদেশে আসতে থাকে অতিথি পাখির দল। তারা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন খাল, বিল, হাওর অঞ্চলে। এই দলের সঙ্গে ছুটে আসে বিপদ। শুধু বিপদ বললে কম বলা হবে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের জন্য এই সময়টি এক ‘মহাবিপদ’-এর ঝুঁকি। এরপরও বাংলাদেশ সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এই হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন বলে শোনা যায়নি। বার্ড ফ্লু শতকরা একশ’ ভাগ সংক্রমণী রোগ। সংক্রমণ শুরু হলেই বেজে উঠবে বিপদের ঘণ্টাধ্বনি। একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক পত্রিকা লিখেছে—‘বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়লে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অগ্রিম জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।’ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা, দেশের পোল্ট্রি খামারগুলোতে এ রোগের বিস্তার ঠেকাতে কোনো আইনানুগ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জনসাধারণ জানেন না। ফলে এর মধ্যেই বিপদ এসে হাজির হয়েছে বাংলাদেশের দরজায়।
বিগত ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার চিড়িয়াখানায় একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অতিথি পাখি বরণ করে নেয়া হয়েছিল। দৈনিক পত্রিকায় হেডিং ছিল—‘নেচে-গেয়ে এবং ছবি এঁকে অতিথি বরণ করে নিল পাখি প্রেমিক ঢাকাবাসী’। এই ‘বিশেষ আনন্দানুষ্ঠানে’ উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পশুসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক। ‘পক্ষী প্রেম’ খুব ভালো কথা। কিন্তু অতি প্রেম ভালো নয়। বাংলাদেশের পাখি প্রেমিকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আমরা বলতে চাই, বিদেশি পাখি দেখে দেশের চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা কিন্তু মোটেই খুশি নন। কারণ, তারা একটা বিষয় ভালোভাবেই জানেন, এসব বিদেশি পাখির দল ‘দয়া করে’ বার্ড ফ্লুর রোগ বহন করে নিয়ে আসে। তারপর সেই রোগ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের শহরে-গ্রামে। বিগত ২০০৯ সালে বার্ড ফ্লুর কারণে এই দরিদ্র দেশটির হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে খামার মালিকরা এখনও উঠে আসতে সক্ষম হননি।
শুধু সেমিনার করে প্রকৃতপক্ষে কোনো লাভ হয় না। মানুষের কল্যাণের দিকে তাকিয়ে নিতে হয় কঠোর ব্যবস্থা। বিগত ২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিল অডিটোরিয়ামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে ইউএসএইড ফাও-এর কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
পরবর্তীতে ৩০ জুন, ২০০৮ তারিখে বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা বার্ড ফ্লুর উপর আলোচনা করেন। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জানান, বিদেশ থেকে আসা অতিথি পাখির মাধ্যমে রোগটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকে। তারপর তা দেশের বিভিন্ন জলজ পাখির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
গত বছর ঋঅঙ বলেছিল বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দেশের ২৬টি জেলায় এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। সংস্থাটি আরও বলেছিল বাংলাদেশের বার্ড ফ্লু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্যেও তা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পোল্ট্রি মালিক সমিতি অভিযোগ করেছিল এই বিষয়ে সরকার যথেষ্ট তত্পর নয়। তবে সরকার গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিল, পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ নয়।
FAO in a press release on 24.01.2008 stated that recent avian influenza outbreaks in 15 countries demonstrate that the HINI strain of the virus remains a global threat and requires close monitoring and strong control efforts. In Bangladesh, 21 out of 64 districts have been infected with HINI and the situation seems to be worsening (Daily Star, 25.01.2008)
বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো বাংলাদেশ সরকারকে বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও কোনো ভালো কার্যক্রম, বাস্তবভিত্তিক দিক-নির্দেশনা এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে বাংলাদেশ বর্তমানে বিপদের মধ্যে অবস্থান করছে। পত্রিকাগুলো গত বছর তাদের সম্পাদকীয়তে বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিল। ভারত থেকে চোরাইপথে মুরগি নিয়ে এসে বাংলাদেশে বিক্রি করা হয়। কিন্তু সরকার সতর্ক হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, বিগত দিনগুলোতে মহাবিপদ ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছিলো বাংলাদেশকে।

জাতিসংঘের সাবধান বাণী
গত বছর জাতিসংঘ সব রাষ্ট্রকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোতে বার্ড ফ্লু সম্পর্কে জরিপ কাজ চালিয়ে একটা বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদানের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ মি. ডেভিড নাবারোকে দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। মি. ডেভিড কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করে তার রিপোর্টে বলেন—‘আমাকে এভাবে বলতে দিন যে এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করলে এভিয়ান ফ্লুর কবলে পড়ে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন লোক মৃত্যুবরণ করতে পারে। আমরা আশা করছি, এই ভয়াবহ সংক্রমণ যে কোনো মুহূর্তে শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, জাতিসংঘ এশিয়ার যে কোনো রাষ্ট্র অথবা সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। তিনি অতিথি পাখি (Migration birds) সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সব রাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করে দেন। সংক্রমণ শুরু হলে মি. ডেভিড এটাকে Global health disaster হিসেবে সবাইকে দেখতে বলেছেন। এই বিষয়ে একটা আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। যে কোনো রাষ্ট্রকে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে একটা এন্ট্রি-ভাইরাল ভ্যাকসিন বের করে সেটাকে পরীক্ষা করে দেখছেন। এই ভ্যাকসিনের নাম—‘ট্যামিফ্লু’। এই ভ্যাকসিন কিছু কিছু সিমটমকে ভালো করতে পারবে; কিন্তু ভাইরাস বহনকারী ব্যক্তির দেহে জীবাণু থেকে যাবে কিনা, সেটা এখনও বলা সম্ভব হচ্ছে না। এই বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
দেশের হতদরিদ্র জনসাধারণ তাদের নিরক্ষরতার কারণে বার্ড ফ্লুর কথা শোনেননি অথবা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মোটেই অবহিত নন। জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের সব সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাইপথে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার মুরগি, মুরগির বাচ্চা এবং ডিম আসছে। তারপর চোরাকারবারীর দল সেগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করছে। এসব চোরাকারবারী দেশপ্রেমিক নয়, দেশের মানুষের প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি নেই। চোরাইপথে আনা এসব মুরগিতে ভাইরাস থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং এই বিষয়ে কঠোর কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের অবস্থা
বাংলাদেশের অবস্থা আর আশঙ্কার কথা লিখে এখন লাভ নেই। বিগত ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বার্ড ফ্লুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। বর্তমানে এক ভয়ানক বিপদের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। এ ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়ালে আর কোনো উপায় থাকবে না, এ ভাইরাস অত্যন্ত সংক্রমণী। তাছাড়া এর কোনো ওষুধ নেই। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বিগত দুই বছরে (২০০৮ এবং ২০০৯) বাংলাদেশের পোল্ট্রি খামারিদের কমপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ভারত থেকে ডিম এবং বাচ্চা আমদানির মাধ্যমে খামারিদের এই ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পোল্ট্রি শিল্প সমিতি।

উপসংহার
বার্ড ফ্লু বা এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা এমন একটা সংক্রমক রোগ যে, এর সম্পর্কে অগ্রিম কিছুই বলা যায় না। কারণ, এই ভাইরাস একবার মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো, সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা, যাতে ভাইরাসটি কোনো অবস্থাতেই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। সতর্কতার প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশের বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, অতিথি পাখিদের মধ্য থেকে অথবা চোরাচালানের মাধ্যমে আনা মুরগি থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভয়াবহ ভাইরাসটি। এক ভয়ানক বিপদের মধ্যে বসবাস করছে বাংলাদেশ।
এর জন্য নিম্নবর্ণিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে সবাই মনে করেন : ক. দেশ এবং মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে অতিরিক্ত পক্ষী প্রেমের বিষয়ে সরকারি অফিসারদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খ. কোনো স্থানে বিমর্ষ অথবা ঝিমিয়ে থাকা অবস্থায় মোরগ-মুরগি দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে। গ. সরকারকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে হবে। ঘ. জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু দেশপ্রেম এ ক্ষেত্রে একমাত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.