সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-অনিশ্চিত ডিসিসি নির্বাচন by এম সাখাওয়াত হোসেন

আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের নিজের স্বার্থে এই নির্বাচনটি যাতে এ বছরই অনুষ্ঠিত হতে পারে সে প্রয়াস নেওয়া। ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তারা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে আপিলের ব্যবস্থা নেবেন কি-না তা নিশ্চিত করবেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি যতক্ষণে হাতে আসবে ততক্ষণ বহু দেরি হয়ে যাবে।


আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিভাজিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সত্যিই 'কুফা' লেগেছে। কবে এই 'কুফা' কাটবে বলা খুবই কঠিন

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (এটিএম শামসুল হুদা) অনেক গুণের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ ছিল_ যা আমরা উপভোগ করতাম তা হলো, অত্যন্ত কঠিন কথাকে এত সহজভাবে প্রকাশ করা যে তা বুঝতে বা বিশ্লেষণ করতে পাণ্ডিত্যের দরকার হতো না। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করার জন্য আমাদের গোটাতিনেক উদ্যোগ বিফল হওয়ার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কুফা লেগেছে। কবে এ কুফা কাটবে কিনা জানি না।' তার কথায় তখন কিছুটা রসাত্মক উপাদান খুঁজে পেলেও পরবর্তী সময়ে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে, এ নির্বাচন অন্তত আমাদের মেয়াদকালে আমাদের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত করতে পারব না। কেন মনে হতো তার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি; তবে এতদিন পরে লিখতে বসে ওই জটিল রাজনৈতিক হিসাব-কিতাবে যেতে চাই না। উচ্চ আদালতে রিট করার সময় রিট আবেদনকারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ইত্যাদিতে এই রিটের পেছনে একটি কারণই জনমনে উদয় হয়েছে_ আমারও ওই রকমই ধারণা হয়েছিল। যদিও আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী একটি টিভি চ্যানেলে বহু বিষয়ের অবতারণা করেছেন, তারপরও ঢাকাবাসীর যারা অধীর আগ্রহে এই নির্বাচনের অপেক্ষায় ছিলেন, তাদের পেছনের কারণটি বুঝতে বাকি নেই।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা রসাত্মক যে উক্তি করেছিলেন তা এই সাম্প্রতিক স্থগিতাদেশের পরে সত্যিই প্রমাণ হলো। সত্যিই ঢাকা সিটি করপোরেশন যেমন আর একক রইল না, তেমনি বিভাজিত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে 'কুফাই' লেগেছে। এই 'কুফা' যদি উচ্চতর আদালত না ছোটান সেক্ষেত্রে অন্তত এ বছর নির্বাচন হবে বলে মনে হয় না। আগামী বছর (২০১৩) হিসাব মতে নির্বাচনী বছর। হালের আলামতে পরিষ্কার যে ওই সময়ে রাজনীতির মাঠ থাকবে উত্তপ্ত। আর এই উত্তপ্ত পরিবেশে ঢাকার মতো এ বিশাল শহরে, যতই বিভাজিত হোক নির্বাচন করা সহজতর বিষয় হবে না। সম্ভবত হবে না কারণ, তখন নির্বাচন কমিশনকে আরও প্রো-একটিভ থাকতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে, যা তাদের প্রধান সাংবিধানিক দায়িত্ব।
আমি প্রবন্ধের অন্যান্য বিষয়ের অবতারণা করার আগে আমাদের মেয়াদের সময়ের কয়েকটি উদ্যোগের বিষয় তুলে ধরব। যদিও এসব তথ্য প্রতিটি বিফল উদ্যোগের পর মিডিয়ার মাধ্যমে শুধু ঢাকাবাসীকেই নয়, সমগ্র দেশবাসীকে জানানো হয়েছিল। মাত্র কয়েকদিন আগেও পত্রপত্রিকায় পুনরাবৃত্তি করা হয়। সে সূত্র ধরেই এগুলো পুনরায় উল্লেখ করছি।
আমরা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পেয়েছিলাম সে বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ওই সময়ে আমাদের মেয়াদকালে (২০০৭-২০১২) যে বিশাল কর্মযজ্ঞ আমরা করেছি তার মাত্র অর্ধেক জনসমক্ষে এসেছে। এত কর্মসম্পাদন করার কারণেই বাংলাদেশের নির্বাচন সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে আমাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ডিজিটাল তথ্য ভাণ্ডার তৈরির মাধ্যমে জাতিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ছবিসহ ভোটার তালিকা উপহার দেওয়া। এমন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা যাতে ভবিষ্যতে ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। এমন একটি ভোটার তালিকা যার মাধ্যমে একের ভোট অন্যজনে দিতে না পারে। আমরা তেমনি একটি ভোটার তালিকা প্রস্তুতে সক্ষম হয়েছি। এর কাজ শুরু হয়েছিল ১০ জুন ২০০৭ সালে। শ্রীপুরে পাইলটের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এবং পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছিল ৯ জুলাই ২০০৮ সালে। এরপরের কয়েক মাস লেগেছিল তালিকা মুদ্রণের কাজে।
ওই সময়ের মধ্যে অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আইন জচঙ-১৯৭২, স্থানীয় সরকারের উপজেলা, সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য আইনে নির্বাচনী অনুচ্ছেদগুলোর সংস্কার এবং তারই আলোকে বিধি ও আচরণবিধি প্রস্তুতিকরণের প্রক্রিয়াও করতে হয়েছিল। যদিও আইনের খসড়া প্রস্তুত করা আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ, তবুও আমরা যতদূর সম্ভব সে কাজটিও করেছি। তার কারণ সংস্কার ও পরিবর্তনের অনুচ্ছেদগুলো ছিল আমাদেরই উদ্ভাবিত। তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যার প্রতিশ্রুতি ও সময়সীমার ঘোষণা আমরা আগেই দিয়েছিলাম। একই সঙ্গে আমরা প্রায় ১৮ বছর পর উপজেলা নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এত কিছুর মধ্যেও আগস্ট ২০০৮ সালে চারটি সিটি করপোরেশন ও নয়টি পৌরসভার নির্বাচন সদ্য পরিবর্তিত নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার মধ্যে এক প্রকার পাইলটের মতো সম্পন্ন করতে হয়েছিল।
ওপরে বর্ণিত ওই পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়াদ মে ২০০৭ সালে শেষ হলেও ভোটার তালিকা না থাকায় আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভোটার তালিকার অংশটুকু মুদ্রণ হয়েছিল সবার শেষে। কাজেও আগস্টে আমরা নির্বাচনটি করতে পারিনি। পারলে ভালোই হতো হয়তো, পরে 'কুফা' লাগত না। আমরা এ নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রস্তাবিত সময়ে উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময় কোনো রাজনৈতিক দলই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে রাজি হয়নি। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে উপজেলার সঙ্গে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও রাজি হয়নি। তবে আমাদের শক্ত অবস্থানের কারণে অন্তত উপজেলা নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে করার পক্ষে মত দিলে স্বল্প ব্যবধানেই ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম। তা না হলে ওই নির্বাচনেও 'কুফা' লাগত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জচঙ-১৯৭২-এর অধিকতর সংশোধন ভোটার তালিকা আইন, স্বাধীন সচিবালয় আইন ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গৃহীত আর কোনো অধ্যাদেশ নবম সংসদ পাস করেনি। স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরের আইন না থাকায়, বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ঢাকার নির্বাচন অসম্পন্ন রয়ে যায়। আরও পরে ১৫ অক্টোবর ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধ্যাদেশটি বাদ দিয়ে ১৯৯৮ সালের সিটি করপোরেশন আইন পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। ১৯৯৮ সালের মূল আইনে সংশোধিত নির্বাচনী আইনের পরিবর্তিত অনুচ্ছেদগুলো সংযোজিত করা হয়নি। তবে বিধি দ্বারা প্রণয়নের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে প্রদান করলে, নতুন আঙ্গিকে বিধি তৈরি করলে ওই বিধি কার্যকর হয় ৬ এপ্রিল ২০১০ সালে। বিধি প্রণয়নের পূর্বেই নির্বাচন কমিশন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে বেশ কয়েকবার আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে উলি্লখিত ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাস ও সীমানা নির্ধারণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পত্র দেওয়া হয়। ওই পত্রের কোনো উত্তর না পেলেও আমরা একটি অত্যন্ত সফল জাতীয় নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষ_ আমাদের মতো করে উদযাপিত করতে ২৯ ডিসেম্বর ২০১০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত করেছিলাম। সে কারণেই প্রজ্ঞাপন দ্বারা বিধির বৈধতা পাওয়ার পরপরই ১৮ এপ্রিল ২০১০ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এরপর আরও কয়েকবার একই বিষয়ে পত্র মারফত জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণের সময়ে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তি জিপিএস (এচঝ _গ্গ্নোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ব্যবহারের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে ওই অভিজ্ঞতার আলোকে সহযোগিতার পুনঃআশ্বাস দেওয়ার পরও ওই পত্রের উত্তরও আমরা পাইনি।
বস্তুতপক্ষে আমরা মন্ত্রণালয়কে ওয়ার্ডের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য ২৩ ডিসেম্বর ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের এপ্রিলে শেষ চিঠি দেওয়া পর্যন্ত চার দফা পত্র দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে এ বিষয়ে একটি আধা-অফিসিয়াল পত্র লিখেও বলা হয়েছিল যে, এ কাজটি সম্পন্ন না করে নির্বাচন করলে আইনি জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে। আমার যতদূর মনে পড়ে, এসব চিঠির কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে কোনো এক সময়ে জিপিএস সিস্টেমের ওপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। তারপরও আমাদের পূর্ণ এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তারপরও নির্বাচনের জন্য আমাদের উদ্যোগ থেমে থাকেনি। পরে ১৩ অক্টোবর ২০১০ সালে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী নিজে উপস্থিত হয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানালে নির্বাচন কমিশন আর উদ্যোগ নেয়নি। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে এর আগে নিম্ন আদালতে মামলাও হয়েছিল। ২০১১ সালে আমরা সারাদেশে পৌরসভা, ইউনিয়ন কাউন্সিল ও দুটি নবগঠিত সিটি করপোরেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম এবং সফলভাবে এসব নির্বাচন শেষ করতে পেরে যেমন তৃপ্ত হয়েছিলাম, তেমনি অতৃপ্ত ছিলাম ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন না করতে পারায়। আমার কাছে সবসময় মন হয়েছে যে, বিভাজিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর দুটি দলসহ অন্য দলগুলোও সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন ছিল না। বিরোধী জোটের গরজ ছিল না, কারণ ওই সময়ের মেয়র ওই জোটের অন্যতম প্রধান নেতা। অন্যদিকে নানা হিসাব-নিকাশের কারণে সরকারি দলও ওই সময়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আগ্রহী ছিল না।
হালে দায়েরকৃত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত আইনে সাদা-কালো অক্ষরে যা লেখা রয়েছে তার ওপরই স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা হালনাগাদ না করে নির্বাচন করার কেন উদ্যোগ নেওয়া হলো এবং এসব পূরণ করে নির্বাচন করার জন্য রুল জারি করে তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এর মধ্যে একজন মেয়র প্রার্থীর আপিল সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এবং রুল বহাল রেখেছেন। কাজেই বল এখন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের মাঠে।
আমার এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে পাঠকদের সম্যক ধারণা হবে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলেও ওয়ার্ডভিত্তিক সীমানা নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কারণ সংবিধানে যে চারটি নির্বাচন কমিশনের অবশ্য করণীয় উলি্লখিত রয়েছে তার মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ একটি। তবে সীমানা নির্ধারণের আইনে নির্বাচন কমিশনের সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ওপর আদালতে রিট করার ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। স্থানীয় সরকারের আইনে এমন ব্যবস্থা নেই। কাজেই সীমানা নির্ধারণ করলেও মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করতে বহু সময় অতিবাহিত হয়। যাই হোক, বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রায় দু'মাস হাতে সময় পেয়েছিল ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের খুঁটিনাটি আইনি বিষয়ে অবগত হওয়ার। সিটি করপোরেশন আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ধারাগুলো ভালো করে বিশ্লেষণ করা; কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং আদমশুমারির পর সীমানা পুনর্নির্ধারণ না করতে পারলে যে ধরনের ছাড় দেওয়া আছে সে ধরনের কোনো ছাড় দেওয়ার অবকাশ স্থানীয় সরকার আইনে নেই। কাজেই তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান কমিশন এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারকে তাগাদা দিয়েছিল কি-না জানা যায়নি। যদি এ বিষয়ে তারা সজাগ থাকতেন তাহলে হয়তো তফসিল ঘোষণা করতেন না। মনে হয়, এ কমিশন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কাজেই শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে কমিশন নিজের দায়িত্ব লাঘব করতে পারে না। এ আইনি ব্যত্যয়ের আংশিক দায়দায়িত্ব কমিশনেরও বটে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়ে আদালতের রুলের জবাব নির্বাচন কমিশনের জন্য সহজ হবে। সবসময় স্থানীয় সরকার নির্বাচন হালনাগাদ করে করা সম্ভব নয়। কারণ প্রায় ছয় হাজার নির্বাচনী ইউনিটের নির্বাচন বছরব্যাপী হতে পারে। এ কারণেই ভোটার তালিকা আইন-২০০৯ (৬নং আইন ২০ ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত সংশোধিত) অনুচ্ছেদের ১১ (১) শর্তে উল্লেখ রয়েছে। তবে শর্ত থাকে যে, যদি ভোটার তালিকা পূর্বোলি্লখিতভাবে হালনাগাদ না করা হয় তাহলে এর বৈধতা বা ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হবে না। এমন শর্ত পূর্বতন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকা আইনেও ছিল। তাছাড়া অনেক ধরনের জটিলতা এড়াতে আমরা বহু আলোচনার পর এ শর্ত রেখেছিলাম। প্রসঙ্গত, যতগুলো আইনের সংস্কার আমরা করেছি প্রত্যেকটিই অনেক আলোচনা, অনেক বিশ্লেষণের পর প্রতিটি লাইন এবং শব্দের আইনি যৌক্তিকতাও আমরা সংযোজন করেছি। দু'একবার সংশোধনীও করেছি। আরও সংশোধনীর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে খসড়া পাঠানোও হয়েছিল। আমরা বহু সময় যেমন ব্যয় করেছি এসব আইনের খসড়া এবং বিধান প্রস্তুতে, তেমনি সময় ব্যয় করেছি মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ করতে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেই আইনে এ শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই নির্বাচন কমিশন নিদেনপক্ষে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচন না করার যৌক্তিকতা আদালতের রুলের এ জবাবে এই অনুচ্ছেদ তুলে ধরলে হয়তো আদালত পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। অন্যথায় সিটি করপোরেশন নির্বাচন কোনোভাবেই হালনাগাদ করে এ বছর সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
আমি শুরু করেছিলাম সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একটি সরস উক্তি দিয়ে। আমার মনে হচ্ছে, তার উপলব্ধিই সঠিক হতে পারে। কারণ তিন মাসের মধ্যে ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাস সম্পন্ন করতে পারলেও যা নিয়ে আমার সন্দেহ থেকেই যাবে_ এই পুনর্বিন্যাস নিয়ে নিম্ন আদালতে বহু মামলা হতে পারে, সেগুলোর নিষ্পত্তি আইন জটিলতার কারণে সহজ হওয়ার নয়। বহু ইউনিয়ন কাউন্সিলে সীমানা বিরোধ নিয়ে মামলার কারণে এক যুগের বেশি সময় নির্বাচন হতে পারেনি। ওয়ার্ডের সঙ্গে স্বার্থ জড়িয়ে আছে সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের এবং ঢাকার বহু স্থানে, বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় ওয়ার্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ভোটার এবং বাসিন্দাদের আবেগ। কাজেই এসব মামলা নিষ্পত্তি না হলে নির্বাচন ঝুলে থাকবে।
আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এখনই। কাজেই এ বছর এ নির্বাচন না হলে কবে হবে বলা সহজ নয়। তবে আমি মনে করি, এ নির্বাচনটি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন যদিও নেই তবু সংক্ষেপে বলা যায় যে, জনগণের আস্থা অর্জনে এই নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করত। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের নিজের স্বার্থে এই নির্বাচনটি যাতে এ বছরই অনুষ্ঠিত হতে পারে সে প্রয়াস নেওয়া। ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তারা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে আপিলের ব্যবস্থা নেবেন কি-না তা নিশ্চিত করবেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি যতক্ষণে হাতে আসবে ততক্ষণ বহু দেরি হয়ে যাবে।
আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিভাজিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সত্যিই 'কুফা' লেগেছে। কবে এই 'কুফা' কাটবে বলা খুবই কঠিন। তবুও আশা করি যে, আইনি জট কাটাতে নির্বাচন কমিশন সর্বপ্রয়াস নেবে। অন্যথায় জনগণের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম হতেই থাকবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন :সাবেক নির্বাচন কমিশনার, (২০০৭-২০১২) নির্বাচন ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক
যযরহঃষনফ@ুধযড়ড়.পড়স

No comments

Powered by Blogger.