মজলিশি মানুষের জলসার অবসান! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
২১ জানুয়ারি সকালবেলা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন লাউঞ্জে নির্বাক টিভি স্ক্রিনের দিকে মাঝে মাঝে চোখ পড়ছিল ঘুরেফিরে। পর্দায় কি দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল, শতকরা নিরানব্বইজনই বোধহয় বলতে পারবেন না। মনে তখন একটি মাত্র চিন্তা। কখন বিমানে আরোহণের ডাক আসে।
নির্বাক টিভি স্ক্রিনের নিচের দিকে চলমান টিকারে অনেক খবর আসছিল আর চকিতে মিলিয়েও যাচ্ছিল। অধিকাংশ খবরই চোখে পড়লেও মাথায় গাঁথছিল না। এ এক ধরনের শূন্যতাবোধের মধ্যে বিহ্বল তাকিয়ে থাকার মতো ব্যাপার।
সহসা সচকিত হতে হলো একটি বার্তা পড়ে। চলমান বার্তাটি পড়লাম বটে, তবে এর মর্মার্থ হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার আগেই বাক্যটি পর্দা থেকে অপসৃত হয়ে গেল। আবার ঘূর্ণায়মান টিকারের অপেক্ষায় বসে থাকলাম পার্শ্ববর্তী স্ত্রীকেও না বলে। খবরটি ভুল কিংবা আমার দৃষ্টি বিভ্রমও তো হতে পারে!
না তার কোনোটাই হলো না। দুঃসংবাদ সাধারণত ভুল হয়ও না।
কি কঠিন একটি বার্তা একটি মাত্র বাক্যে জানানো হয়েছে : একটি সফল কর্মময় জীবনের ওপর চিরকালের যতি টেনে দেয়ার জন্য কয়েকটি হরফের
সমষ্টিতে একটি বাক্য—নাট্যকার
সাঈদ আহমদ আজ সকালে পরলোক গমন করেছেন। ...
শুধু একটি বাক্যই তো নয়! এ যে তারও অনেক বেশি। প্রতিটি মৃত্যুর খবর ঘোষিত হয় একটি মাত্র বাক্যে। তারপর সেই নিষ্করুণ বাক্যটির বক্তব্য ছাপিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে বিদায়ী মানুষটির কর্মময় জীবনের নানা ঘটনা। নানা অর্জন।
পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যশালী পরিবারের জাতক সাঈদ আহমদ ছিলেন ঢাকার হারানো গৌরবের প্রতিভূ। ঢাকার খাওয়া-দাওয়া, চলন-বলন, শানশওকত, সামাজিকতার আধুনিক প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। অন্তরঙ্গ মহলে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভাষা ব্যবহারে তিনি ছিলেন যেমন স্বাচ্ছন্দ্য, তেমনি আনুষ্ঠানিক জীবনে ইংরেজি, উর্দু এবং কখনও কখনও পরিমিত ফরাসি ভাষার ব্যবহারে তার দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর।
জীবনের বেশিরভাগ সময়, লেখাপড়া কিংবা কর্তব্য কর্মোপলক্ষে বিদেশে অবস্থানের কারণে এক ধরনের আন্তর্জাতিক মনমানসিকতা নিয়ে জীবনযাপন করেছেন সাঈদ আহমদ। স্ত্রী পারভীন আহমদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় যাপিত সুখী জীবনের অধিকারী ছিলেন সাঈদ আহমদ।
এক সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি ‘বিশ্ব নাটক’ শিরোনামে পৃথিবীর সেরা নাটকের বাংলা রূপায়ন উপহার দিতেন তার জ্ঞানগর্ভ উপস্থাপন-বক্তব্যসহ। উপস্থাপনা করতেন তিনি তার নিজস্ব বাকভঙ্গিতে। বক্তব্যের গভীরতার কারণে অনেকে বলতেন, বিশ্ব নাটকের আসল বক্তব্য হলো ওর উপস্থাপনা, নাট্যাংশ অতিরিক্ত প্রাপ্তি।
এই কলাম লেখকের অনূদিত ফেডেরিকো গার্সিয়া লরকার বিখ্যাত নাটক ‘ইয়ারমা’ প্রসঙ্গে সাঈদ আহমদের উপস্থাপনায় লরকা সম্পর্কে নতুন তথ্য পরিবেশিত হয়েছিল। ইয়ারমা শব্দের অর্থ বন্ধ্যা। এই বন্ধ্যাত্বের ব্যাখ্যায় সাঈদ আহমদ যে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন, তা এখনও মনে পড়ে।
যদি বলি অ্যাবসার্ড নাটকের সঙ্গে তিনি আমাদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন, তাহলে বেশি বলা হবে না।
ইংরেজিতে লেখা তার নাম ‘দি থিং’ যার বাংলা অনুবাদ কালবেলা, আমাদের নাট্যজগতের এক বিরাট মাইলফলক। এছাড়া তিনি লেখেন মাইল পোস্ট, তৃষ্ণায়, সারভাইভ্যাল, একদিন প্রতিদিন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে তিনি লেখেন ‘শেষ নবাব’। এটি সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা পরিচিত অন্যান্য নাটকের চেয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে লেখা।
সাঈদ আহমদ লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকস-এ পড়াশোনা করা কিংবা বিবিসিতে কাজ করার সময়ে ইউরোপীয় নাট্য ধারার সঙ্গে পরিচিত হন যা তার লেখক মানসকে সমৃদ্ধ করে। অ্যাবসার্ড ধারার ইউরোপীয় নাট্যকারদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিল আন্তরিক ও গভীর।
চাকরি জীবনে এক অপ্রত্যাশিত বাঁক বদলের সময়ে সাঈদ আহমদের নিবিড় সাহচর্যে আসার যে সুযোগ এসেছিল তা অব্যাহত ছিল তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। যদিও শেষের দিকে শারীরিক দুর্বলতার কারণে জলসা-মেজাজি সাঈদ আহমদকে খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর।
বছর কয়েক আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত সাঈদ আহমদের বাকযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বিদেশে চিকিত্সার ফলে কিছুটা উন্নতি হয়েছিল তার কথাবার্তা বলায়। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম লালমাটিয়ায় তার বাসভবনে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয়ভাজন বিটিভিতে আমার এককালীন সহকর্মী মোস্তফা কামাল সৈয়দ।
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার; কিন্তু রসবোধ ছিল অক্ষুণ্ন, যার জন্য সাঈদ আহমদের পরিচিতি ছিল।
অনেক স্মৃতি আছে তাকে ঘিরে। ওয়াশিংটনের অ্যারেনা থিয়েটারে দর্শকের একটি সারি তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। একটি স্টিল ছবি আমার হাতে দিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক চিত্রালীর তত্কালীন সম্পাদক আজাচৌ যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে ছবিসহ সংবাদটি ছেপেছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে খবর বের হলে প্রসন্ন হতেন।
এখন তাকে নিয়ে এতো যে খবর, কে প্রসন্ন হচ্ছে তাতে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
সহসা সচকিত হতে হলো একটি বার্তা পড়ে। চলমান বার্তাটি পড়লাম বটে, তবে এর মর্মার্থ হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার আগেই বাক্যটি পর্দা থেকে অপসৃত হয়ে গেল। আবার ঘূর্ণায়মান টিকারের অপেক্ষায় বসে থাকলাম পার্শ্ববর্তী স্ত্রীকেও না বলে। খবরটি ভুল কিংবা আমার দৃষ্টি বিভ্রমও তো হতে পারে!
না তার কোনোটাই হলো না। দুঃসংবাদ সাধারণত ভুল হয়ও না।
কি কঠিন একটি বার্তা একটি মাত্র বাক্যে জানানো হয়েছে : একটি সফল কর্মময় জীবনের ওপর চিরকালের যতি টেনে দেয়ার জন্য কয়েকটি হরফের
সমষ্টিতে একটি বাক্য—নাট্যকার
সাঈদ আহমদ আজ সকালে পরলোক গমন করেছেন। ...
শুধু একটি বাক্যই তো নয়! এ যে তারও অনেক বেশি। প্রতিটি মৃত্যুর খবর ঘোষিত হয় একটি মাত্র বাক্যে। তারপর সেই নিষ্করুণ বাক্যটির বক্তব্য ছাপিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে বিদায়ী মানুষটির কর্মময় জীবনের নানা ঘটনা। নানা অর্জন।
পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যশালী পরিবারের জাতক সাঈদ আহমদ ছিলেন ঢাকার হারানো গৌরবের প্রতিভূ। ঢাকার খাওয়া-দাওয়া, চলন-বলন, শানশওকত, সামাজিকতার আধুনিক প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। অন্তরঙ্গ মহলে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভাষা ব্যবহারে তিনি ছিলেন যেমন স্বাচ্ছন্দ্য, তেমনি আনুষ্ঠানিক জীবনে ইংরেজি, উর্দু এবং কখনও কখনও পরিমিত ফরাসি ভাষার ব্যবহারে তার দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর।
জীবনের বেশিরভাগ সময়, লেখাপড়া কিংবা কর্তব্য কর্মোপলক্ষে বিদেশে অবস্থানের কারণে এক ধরনের আন্তর্জাতিক মনমানসিকতা নিয়ে জীবনযাপন করেছেন সাঈদ আহমদ। স্ত্রী পারভীন আহমদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় যাপিত সুখী জীবনের অধিকারী ছিলেন সাঈদ আহমদ।
এক সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি ‘বিশ্ব নাটক’ শিরোনামে পৃথিবীর সেরা নাটকের বাংলা রূপায়ন উপহার দিতেন তার জ্ঞানগর্ভ উপস্থাপন-বক্তব্যসহ। উপস্থাপনা করতেন তিনি তার নিজস্ব বাকভঙ্গিতে। বক্তব্যের গভীরতার কারণে অনেকে বলতেন, বিশ্ব নাটকের আসল বক্তব্য হলো ওর উপস্থাপনা, নাট্যাংশ অতিরিক্ত প্রাপ্তি।
এই কলাম লেখকের অনূদিত ফেডেরিকো গার্সিয়া লরকার বিখ্যাত নাটক ‘ইয়ারমা’ প্রসঙ্গে সাঈদ আহমদের উপস্থাপনায় লরকা সম্পর্কে নতুন তথ্য পরিবেশিত হয়েছিল। ইয়ারমা শব্দের অর্থ বন্ধ্যা। এই বন্ধ্যাত্বের ব্যাখ্যায় সাঈদ আহমদ যে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন, তা এখনও মনে পড়ে।
যদি বলি অ্যাবসার্ড নাটকের সঙ্গে তিনি আমাদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন, তাহলে বেশি বলা হবে না।
ইংরেজিতে লেখা তার নাম ‘দি থিং’ যার বাংলা অনুবাদ কালবেলা, আমাদের নাট্যজগতের এক বিরাট মাইলফলক। এছাড়া তিনি লেখেন মাইল পোস্ট, তৃষ্ণায়, সারভাইভ্যাল, একদিন প্রতিদিন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে তিনি লেখেন ‘শেষ নবাব’। এটি সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা পরিচিত অন্যান্য নাটকের চেয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে লেখা।
সাঈদ আহমদ লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকস-এ পড়াশোনা করা কিংবা বিবিসিতে কাজ করার সময়ে ইউরোপীয় নাট্য ধারার সঙ্গে পরিচিত হন যা তার লেখক মানসকে সমৃদ্ধ করে। অ্যাবসার্ড ধারার ইউরোপীয় নাট্যকারদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিল আন্তরিক ও গভীর।
চাকরি জীবনে এক অপ্রত্যাশিত বাঁক বদলের সময়ে সাঈদ আহমদের নিবিড় সাহচর্যে আসার যে সুযোগ এসেছিল তা অব্যাহত ছিল তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। যদিও শেষের দিকে শারীরিক দুর্বলতার কারণে জলসা-মেজাজি সাঈদ আহমদকে খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর।
বছর কয়েক আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত সাঈদ আহমদের বাকযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বিদেশে চিকিত্সার ফলে কিছুটা উন্নতি হয়েছিল তার কথাবার্তা বলায়। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম লালমাটিয়ায় তার বাসভবনে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয়ভাজন বিটিভিতে আমার এককালীন সহকর্মী মোস্তফা কামাল সৈয়দ।
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার; কিন্তু রসবোধ ছিল অক্ষুণ্ন, যার জন্য সাঈদ আহমদের পরিচিতি ছিল।
অনেক স্মৃতি আছে তাকে ঘিরে। ওয়াশিংটনের অ্যারেনা থিয়েটারে দর্শকের একটি সারি তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। একটি স্টিল ছবি আমার হাতে দিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক চিত্রালীর তত্কালীন সম্পাদক আজাচৌ যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে ছবিসহ সংবাদটি ছেপেছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে খবর বের হলে প্রসন্ন হতেন।
এখন তাকে নিয়ে এতো যে খবর, কে প্রসন্ন হচ্ছে তাতে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
No comments