শিক্ষা-নৈতিকতা-শিক্ষার্থীদের আমরা কী শেখাচ্ছি? by জোবাইদা নাসরীন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬তম সমাবর্তনে অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধিত কেউ কেউ গাউন ও উপহারসামগ্রী নিতে গিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য উপহারসামগ্রীর একটি থলে নির্ধারিত থাকলেও একেকজন একাধিক থলে নিয়ে যান।


ঘটনাস্থলে ছুটে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘তোমাদের আমরা এই শিখিয়েছি, এই শিক্ষা দিয়েছি?’
১৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী তাঁরই সহপাঠিনীকে ছুরিকাঘাত করেছেন বিভাগের সেমিনারের সামনে। পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি থেকে জানা যায়, মেয়েটিকে ছুরিকাঘাত করার জন্যই তিনি ছুরি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তাঁর সহপাঠীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সেই শিক্ষার্থী তাঁর ওই সহপাঠীকে আগেও মারধর করেছেন। এ চিত্র শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক কারণে একে অপরকে হলের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলছেন, একজনের বুকে আরেকজন রিভলবার ধরে হত্যা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েক দিন পরপরই দেখা যায়, বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হওয়া শিক্ষার্থীদের ছুরি, বন্দুক, রামদা ও হকিস্টিক নিয়ে একে অপরকে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার চিত্র। সেমিস্টারের টাকা পরিশোধের জন্য সহপাঠীকে অপহরণ করে তারপর তাঁকে হত্যা, একই ক্লাসে পড়া ছাত্রীর ছবি তুলে সেটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছেন তাঁরই কোনো সহপাঠী।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে যে চিত্রটি আসে তা হলো, শিক্ষার্থীরা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বেশি। রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকার আল সাবাহু একাডেমির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস কার্টনে করে সওয়ার হয়ে গেল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। তবে এই যাওয়া নিজের ইচ্ছায় নয়, বেঁচে থেকেও নয়। প্রথমে ধর্ষণ, তারপর হত্যা। ঘাতকও ছোট্ট মেয়েটির পূর্বপরিচিত। একই বাড়ির ভিন্ন ফ্ল্যাটে তাদের বসবাস। আসামিদের একজন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়।
এ ঘটনায় যখন দেশের মানুষ হতভম্ব, ঠিক এর এক দিন পরই আরেকটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের খবর। সে ঘটনার শিকারও হয়েছে আরেক স্কুলছাত্র। মর্মান্তিক এ খবরে জানা যায়, বগুড়ার কাহালুতে স্কুলছাত্র নাইমুল ইসলামকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণের পাঁচ লাখ টাকা অপহরণকারীদের দেওয়ার পরও ছেলেকে জীবন্ত ফেরত পায়নি নাইমুলের পরিবার। মৃত ছেলেকে দেখতেও পায়নি তারা। নাইমুল অপরাধীদের চিনে ফেলায় অপহরণকারীরা তার গলায় রশি পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে এবং তার লাশের যেন কোনো অস্তিত্ব না থাকে, সে জন্য ইটভাটার জ্বলন্ত আগুনে সেই লাশ নিক্ষেপ করে ছাইয়ে পরিণত করা হয়। পত্রিকা থেকে জানা যায়, মুক্তিপণের টাকা দিয়ে এক আসামি পরের দিনই মোটরসাইকেল কিনেছে। সেও কলেজের শিক্ষার্থী।
এর পেছনে কী কারণ? আমাদের বিরাজমান সমাজব্যবস্থা? শিক্ষাব্যবস্থা? পণ্যের রকমারি হাতছানি এবং সবকিছু পাওয়ার নেশা? নাকি সমাজের মূল্যবোধ শেখানোর প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা? নাকি বিদ্যালয়ে যেসব বইপত্র শিক্ষার্থীরা পড়ে, সেগুলো মানবিকতার বিপক্ষে? কিংবা এগুলো মানুষকে মানবিকতা শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়? শিক্ষার্থীরা জানে, একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে এখানে ফেল খুব কম করে, তৃতীয় শ্রেণী পাওয়া খুব কষ্টের। সনদের জন্যই শুধু অপেক্ষা। পড়াশোনা যদি মানুষকে মানবিকতাই না শিক্ষা দেয়, তাহলে সেই পড়াশোনায় কোথাও বিশাল এক গলদ আছে, আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়তই তাদের মগজে জমাচ্ছে মানুষের প্রতি সম্মান-ভালোবাসার বদলে নগদ বিনোদন, অন্যকে আহত করা, আক্রান্ত করা ও নগদ প্রাপ্তির পসরা।
এর বিপরীত কথাও আছে। শিক্ষার্থীদের দেখা জগৎও এর বাইরে তাদের কিছু শিখতে দিচ্ছে না। সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যেও কারও কারও বিরুদ্ধে উঠছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেকের বিরুদ্ধে ঠিকমতো ক্লাস না নেওয়ার অভিযোগ তো অনেক পুরোনো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি গেছে কয়েকজন শিক্ষকের যৌন হয়রানির অভিযোগে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ে শিক্ষকদের মধ্যকার হাতাহাতির ঘটনা পত্রিকায় এসেছে। শিক্ষার্থীদের কাছে একজন শিক্ষক অন্য শিক্ষকের বদনাম করছেন, কুৎসা রটাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন অন্য শিক্ষককে হেয় করার কাজে। বর্ণভিত্তিক দলাদলির বাইরেও আছে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকদের নিজস্ব কোন্দল, বিভাগে আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি। সেখানেও জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার বাইরের অবস্থাও শিক্ষার্থীদের মনে মানবিকতার বীজ রোপণের অনুকূলে নয়। রাজনীতিবিদদের একে অপরের প্রতি অসম্মানমিশ্রিত ভাষার ব্যবহার, ঘরে-বাইরে বইছে অনিরাপত্তার বাষ্প। আছে গুম হয়ে যাওয়ার ভয়। অকারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের ওপর পুলিশি নির্যাতন কিংবা র‌্যাবের নির্যাতনের শিকার লিমনের মতো পা হারানোর ভয় থাকা অমূলক মোটেও নয়।
তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই আসলে আমাদের শিক্ষার্থীদের এই মানবিকতার বোধের অভাবের জন্য দায়ী। আর তাই দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনবিরোধী সমাবেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর পেছনের কারণও হয়তো এটি। তবে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজ নেতারা আমরা কি তাহলে শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছি?
 জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.