সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য জাতি জানতে চায়-নিখোঁজ, গুপ্তহত্যা, লাশ

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৭ মাস ১৯ দিনে সারা দেশে ১০০ মানুষ অপহূত হয়েছেন। ২১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, তিনজন ছাড়া পেয়েছেন এবং ৭৬ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এটা গুরুতর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী।


পেশাদার অপরাধীদের হাতে মানুষ অপহূত ও খুন হয়, এটা পুরোনো বিষয়। নতুন বিষয় হচ্ছে, অভিযোগ রয়েছে, উল্লিখিত ১০০ ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছেন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের দ্বারা। বাড়তি উদ্বেগের কারণ নিহিত রয়েছে এখানেই।
মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন, তারপর তাঁর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। অথবা তিনি নিখোঁজই থেকে যাচ্ছেন; তাঁর পরিবার-পরিজনরা জানতেই পারছেন না, লোকটি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলছে, ‘তদন্ত চলছে, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’ কিন্তু এভাবে স্বজন হারানো মানুষগুলোকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার করা অথবা তাঁরা ইতিমধ্যে গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে থাকলে তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের হাতে মানুষ অপহরণ ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন—এই অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য জাতিকে জানানো প্রয়োজন। নিখোঁজ কোনো ব্যক্তির পরিবার যখন অভিযোগ করে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছেন, তখন ওই বাহিনীর পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয় এবং তারা মনে করে, এই অস্বীকারের মধ্য দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিলে, জবাবদিহি নিশ্চিত করলে পরিস্থিতি এমন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছাত না। সরকার কি নীতিগতভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে এ বিষয়ে চোখ-কান বন্ধ করেই থাকবে? জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহির প্রয়োজন নেই?
এসব গুম-খুনের ব্যাপারে যৌক্তিকভাবে দুটো সম্ভাবনার কথা ভাবা যায়। এক. সরকারের নীতিনির্ধারকদের জ্ঞাতসারে ও অনুমোদন সাপেক্ষেই এসব ঘটানো হচ্ছে। অথবা, দুই. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, গুম করে দিচ্ছে। তাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। এই দুইয়ের কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। উভয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা এক অশুভ অপরাধব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। এর পরিণতি ভয়ংকর হতে বাধ্য।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গত বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বলেছেন, ‘আগামী বছর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে নাগরিকদের নিখোঁজ হওয়ার এই ঘটনাগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে জবাবদিহি করতে হবে। সেখানে সরকার কী ব্যাখ্যা দেবে, আমরা জানি না।’ কিন্তু বিদেশিদের কাছে ব্যাখ্যা, জবাবদিহির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করার তাগিদ বোধ করা। জনগণ ভোট দিয়ে যে সরকার নির্বাচিত করেছে, সে তো সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধ জনগণের কাছেই।

No comments

Powered by Blogger.