বাঙালির আচার-অনুষ্ঠান ঋতু বৈশিষ্ট্য ও বর্ষগণনা by ডা. এম এ হাসান

বাংলা সনের উৎপত্তি এবং বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে নানা মতের প্রচলন আছে। বাস্তবতার আলোকে এই নববর্ষ বাঙালি জীবনে একটি উপলব্ধির স্থান, আত্মপরিচয়ের স্থান, প্রাণের মেলা ও উৎসবের জায়গা। ভারতের ইতিহাসে, বিশ্বের ইতিহাসে, বিশ্বের নানা জাতির ইতিহাসে, পৃথিবীর নানা স্থানে নানা ধরনের বর্ষগণনার প্রচলন রয়েছে।


এই বর্ষের হিসাব হয়েছে কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কোনো জাতীয় উত্থান, ধর্মের উত্থান, জাগরণ, বিজয় বা বিকাশকে উপলক্ষ করে। এ যেন পথচলার মাঝে সময়ের পরিক্রম; সমাজ ও জাতীয় জীবনের দৈর্ঘ্যকে পরিমাপের চেষ্টা। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষ এমন একটি সময়ের মধ্যে জীবন অতিক্রম করে যা কিনা জীবন ও বাস্তব অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। অপরদিকে নববর্ষ হলো সৌরবৎসর বা চান্দ্রবৎসরের যে কোনো অংশকে শুরু হিসেবে মেনে নেওয়া এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় তথা সুচিহ্নিত করে রাখা। সৌরবৎসর হলো সেই কাল বা পথ যে সময়ে পৃথিবী সূর্যকে একবার ঘুরে আসে। এর মাঝে যে অঞ্চলভিত্তিক ঋতু পরিবর্তন হয় এবং তাতে মানুষের জীবনে ও প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয় তাকে চিহ্নিত করা হয় বহুমুখী প্রয়োজনে। এর সঙ্গে কৃষি, উৎপাদন, খাদ্য সংগ্রহ, জীবন সংরক্ষণ, জীবনের পথচলা, আনন্দ উৎসব- সব কিছুই জড়িত। কৃষিভিত্তিক সমাজে বর্ষগণনা ও ফসলের উৎপাদন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। গ্রীষ্মের দাবদাহ, খরা, মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ, বৃষ্টিবাহী মেঘের সঞ্চালন, বারিপাত, বীজ ছেড়ে অঙ্কুরের উদ্গমন, প্লাবন, বৃষ্টিবিহীন স্নিগ্ধ দিন, হালকা মেঘের সঞ্চালন, হলুদ পাতার এবং পাতা ঝরার দিন, ফসল কাটার ক্ষণ, শীতের আগমন, নব কিশলয় ও ফুল ফোটার উৎসব, পরাগায়ণ, ফলের বিকাশ, বীজের জন্ম, উদ্ভিদের আগমন- এসবকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় ঋতু বিভাজন, ঋতুর নামকরণ। ঋতুকে স্মরণ রেখেই মাসের নামকরণ হয়। এরপর এই মাসের সঙ্গে জীবনের নানা কর্মসূচি সম্পৃক্ত করা হয়। ফসল বোনা, ফসল তোলা, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বপন, পূজা-পার্বণ, বিয়ে, রাজ্যাভিযান, মৃগয়া, মৎস্য শিকার, পর্বতারোহণ, নদী ভ্রমণ, বাণিজ্য, যুদ্ধ- সব কিছুই এই ঋতু ও মাসকে মাথায় রেখে করা হয়। চান্দ্রমাসের হিসাবের সঙ্গে যে গ্রহণক্ষেত্রের হিসাব জড়িত, তা অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মাভাবে ফসল উৎপাদনসহ সব জীবনের উদ্গমন মানুষের আবেগ ইত্যাদির পাঠ সম্ভব করে তোলে। এর সঙ্গে সৌর বৎসরের আনুপাতিক হিসাব বা সৌর বৎসরের সঙ্গে চান্দ্রবৎসরের সামঞ্জস্য বিধান কঠিন নয়। সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে যে প্রকৃতি বিজ্ঞান (Natural Science) বা ভূয়োদর্শন তৈরি হয়, তা বাংলার মাটিতে এতটা বিকশিত হয় যে তা আসাম ও ভারতের অন্যত্র ছড়িয়ে পরে। এমন এক ক্ষণজন্মা ক্ষণা বা ক্ষণা নামের একাধিক নারী ছিল যারা এই প্রকৃতিবিজ্ঞান এবং ভূয়োদর্শনকে এমন শীর্ষে নিয়ে যায় যে তা বাংলা ও ভারতের ঘরে ঘরে চর্চিত হয়, অনুসরিত হয়। তবে এই ক্ষণা নারী হওয়ায় তার স্থান রাজদরবারে হয়নি। বরং একপর্যায়ে তার (অন্তত একজন ক্ষণার) জিহ্বা কেটে নেওয়া হয়। ক্ষণার একটি বিখ্যাত বচন হলো- যদি বর্ষে মাঘের শেষ ধন্যি রাজার পুণ্য দেশ/যদি বর্ষে ফাগুনে মা নিয়ে যায় আগনে
আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৯-১০ শতকে চর্যাপদ যুগে জন্ম নেওয়া ক্ষণার বচনে বাংলা মাসের উল্লেখ এবং সেসব মাসের সঙ্গে ফসলের উৎপাদন এবং সমাজজীবনের নানা বিষয় সম্পৃক্তকরণ বাংলা সন ও মাসের প্রচলনকে হাজার বছর পেছনে নিয়ে যায়। বাংলার মাটিতে বিভিন্ন ফলক এবং প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনে যে সনগুলো উল্লিখিত হয়েছে তা হলো শকাব্দ, গুপ্তাব্দ, ত্রিপুরাব্দ, খ্রিস্টাব্দ, সর্বসিদ্ধ সন ইত্যাদি। এ ছাড়া বুদ্ধাব্দের কথা উল্লেখ আছে বিভিন্ন স্থানে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে শক নামের ইরানি উপজাতি (সাই উপজাতি) মধ্য এশিয়া অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে এবং নানা সংঘাতের মধ্য দিয়ে এ দেশে ইন্দোশক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। শক রাজা মউয়েস কাশ্মির থেকে গান্ধার পর্যন্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে শকস্থান (দ্রানগিয়ানা) থেকে এ দেশে আগমনের সময়টি ভারতবাসীর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। এ কারণে শকাব্দের প্রচলন হয়। ইতিবাচক বা নেতিবাচক অর্থে এটি বাংলার মাটিতে গৃহীত হয়। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের ইচ্ছার সংঘাত থাকা অসম্ভব নয়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে (৩২০-সপ্তম শতকে) দ্বিতীয়বারের মতো গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে এবং ঘটনাবহুল গুপ্ত যুগের সূচনা হয়। বিক্রমবাদিত্য ছিলেন সেই বিখ্যাত গুপ্ত রাজা (খ্রি. ৩৮০-৪১৯) যাঁকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বলা হতো। এ যুগে কবি কালিদাসসহ অনেক সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক জন্ম নেন। বহুমুখী সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশ এই গুপ্তাব্দের প্রচলনের সঙ্গে সম্পর্কিত। উল্লেখ্য, মৌর্য বংশের এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের অভিষেক হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ অব্দে। এ তারিখটি বৌদ্ধ, জৈন এবং ইউরোপীয় সূত্রে প্রাপ্ত। সেলুকাস নিকেটার ওই সময় রাজত্ব করায় এবং তাঁর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের যুদ্ধ ও শান্তি সম্পন্ন হওয়ায় এটাকে সত্য বলে মানা যাচ্ছে। চন্দ্রগুপ্তের শাসন ২৪ বছর স্থায়ী হয়। এরপর রাজত্ব করেন তাঁর পুত্র বিন্দুসার। বিন্দুসার ২৯৩-২৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পুত্র রাজা অশোক সিংহাসনে বসেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮-তে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
চন্দ্রগুপ্ত অথবা বিন্দুসারের নামে কোন অব্দ প্রচলিত না হলেও অশোকাব্দের প্রচলন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চন্দ্রগুপ্তের প্রধান পরামর্শক কৌটিল্য শত রকম গ্রন্থ প্রণয়ন করেও সংখ্যাতত্ত্ব্ব বা নক্ষত্রবিদ্যাসংশ্লিষ্ট চান্দ্রবৎসর বা সৌরবর্ষ গণনা করেন নি- এটা মেনে নেওয়া কঠিন। বঙ্গদেশসহ ভারতে জৈন ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা একসময় অনেক ছিল। এরপরও মহাবীর যিনি কিনা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধর্ম প্রচারে বঙ্গদেশসহ ভারতের অধিকাংশ স্থানে ভ্রমণ করেন এবং বিপুলসংখ্যক অনুসারী রেখে যান। তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কেন যে প্রচেষ্টা নেওয়া হলো না এর উত্তর হয়তো জৈন ধর্মেই পাওয়া যাবে। আর এমন অব্দ প্রচলিত হলেও তরী যে চলেনি, তা প্রমাণিত। শকগণের আগমন খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে হলেও শকাব্দের গণনা শুরু হয় খ্রিস্টীয় ৭৮ থেকে। বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে ৮ কিমি দূরে যোগীর ভবন নামক একটা স্থান রয়েছে। সেখানকার মন্দির গাত্রে উৎকীর্ণ আছে 'সর্বসিদ্ধ সন ১১৪৮ (১৭৪১ খ্রি.) শ্রীসুফলা' কথা কয়টি। কালভৈরবী মন্দির গাত্রে যে লিপি আছে তাতে 'শ্রী রামসিদ্ধ সন ১১৭৩ (১৭৬৬ খ্রি.), শ্রী জয়নাথ নারায়ণ' কথাটির উল্লেখ আছে। ধর্মডুঙ্গী মন্দির গাত্রে লেখা রয়েছে 'সর্বসিদ্ধ সন ১১৪৮ সুফল।' ওই স্থানের কালভৈরব শিবলিঙ্গ মন্দির গাত্রে। 'শ্রী রামসিদ্ধ সন ১১৭৩ সাল আমলে শ্রী জয়নাথ নরনারায়ণ।' বাক্যটি উৎকীর্ণ আছে। (সূত্র : 'বাংলাদেশের প্রত্ন সম্পদ' আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া) অর্থাৎ সর্বসিদ্ধ সন এবং শ্রী রামসিদ্ধ সন দুটো একই। এই সনের গণনা খ্রিস্টীয় সনের ৫১৩ বছর পর ধরা হয়েছে। অর্থাৎ দুই সনের ব্যবধান ৫১৩ বছর। বাংলা সনের সঙ্গে খ্রিস্টীয় সনের ব্যবধান ৫১৩ বছর দুই মাসের মতো। এ ক্ষেত্রে পাথরে উৎকীর্ণ সনের সঙ্গে মাস উল্লিখিত না হওয়ায় তা বিবেচনায় নেওয়া যায়নি। শ্রী রামসিদ্ধ সন এবং সর্বসিদ্ধ সনটি বাংলা সনের সঙ্গে অতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাঁরা মনে করেন যে বাংলা সন ও নববর্ষ মুর্শিদকুলি খাঁ প্রবর্তন করেছেন তা কতটুকু সঠিক সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বৈশাখের প্রথম দিনে বর্ষ শুরু উদ্যাপন খুব বেশি দিনের নয়। ইরানিদের নওরোজের অনুকরণে এ বর্ষবরণ করা হয়। বাঙালি জাতিসত্তা বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে বাংলাদেশে মহাসাড়ম্বরে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। এটা সাংস্কৃতিক শুদ্ধি এবং বাঙালি জাতিসত্তার মাস। এর সঙ্গে সংক্রান্তির উৎসবটিও ব্যাপকভাবে পালিত হওয়া প্রয়োজন জাতিগত ঐক্য ও সম্প্রীতিকে দৃঢ়প্রোথিত করার জন্য।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি

No comments

Powered by Blogger.