কালের আয়নায়-পঞ্চাশের মেধাবী তারুণ্যের প্রভু চলে গেলেন by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

খালেদ চৌধুরীকে শিল্পী, লেখক, কবি, সাংবাদিক কোনো বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত করা যায় না। সর্ববিষয়েই তার মনীষা ছিল ব্যাপ্ত। পঞ্চাশের বাংলাদেশে যে মেধাবী তরুণ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছিল, খালেদ চৌধুরী ছিলেন তার মধ্যমণি। আমরা সবাই তাকে ডাকতাম প্রভু।


প্রভুজনোচিত ওজস্বিতাও তার মধ্যে ছিল। কথা বলছেন, কিন্তু খুবই সংক্ষিপ্ত বাক্য। তার মধ্যে তদ্ভব-তৎসম
শব্দের সংঘর্ষ নেই


এত পাণ্ডিত্য ও মনীষা নিয়েও তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে এবং নিজের বাসায় লেখাপড়া নিয়েই মগ্ন থাকতেন। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জের এক গ্রামের বাড়িতে। বাড়িটি বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামের
শহীদ রফিক উদ্দীনের


রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে লিখেছিলেন, 'দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ।' আমার অপরিণত বয়সে কথাটি পড়ে মনে হয়েছিল, কবি ঠিক কথা বলেননি। যতদিন বেঁচে থাকা যায়, ততদিনই তো আনন্দ। আজ নিজে পরিণত বয়সে পেঁৗছে বুঝতে পারছি, রবীন্দ্রনাথের কথাটা পরম সত্য_ 'দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ।' চোখের ওপর একজনের পর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরিচিতজন চলে যাচ্ছেন, কিছুদিন পরপরই খবর পাই আর বেদনা ও শোকে দগ্ধ হই, স্মৃতিভারে জর্জরিত হই, মনে মনে ভাবি, আর কত বন্ধুর ওবিচুয়ারি লিখব। আমারও তো সময় হয়েছে, নিজেরটাও লিখে রেখে যাই।
গত কিছুদিনের মধ্যে পরপর খবর পেয়েছি শিল্পী কিবরিয়া, শিল্পী আমিনুল ইসলামের প্রয়াণের। এখন গত ১৩ জুলাই বুধবার খবর পেলাম খালেদ চৌধুরী চলে গেছেন। আগের দিন ১২ জুলাই মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। ১৯৩২ সালে মাতুলালয় বিক্রমপুরে তার জন্ম। সেদিক থেকে আর কিছুদিন পরই তিনি ৮০ বছরে পা দিতেন। তিনি আমার চেয়ে দু'বছরের বড়। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে আমরা ছিলাম অভিন্ন হৃদয়বন্ধু! নিত্যদিনের আড্ডায় একবার দেখা হওয়া চাই-ই।
খালেদ চৌধুরীকে শিল্পী, লেখক, কবি, সাংবাদিক কোনো বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত করা যায় না। সর্ববিষয়েই তার মনীষা ছিল ব্যাপ্ত। পঞ্চাশের বাংলাদেশে যে মেধাবী তরুণ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছিল, খালেদ চৌধুরী ছিলেন তার মধ্যমণি। আমরা সবাই তাকে ডাকতাম প্রভু। প্রভুজনোচিত ওজস্বিতাও তার মধ্যে ছিল। কালো গোলগাল চেহারা। কিন্তু প্রজ্ঞাদীপ্ত চোখ-মুখ, গালভর্তি পান এবং পানের রসে ঠোঁট রাঙা। কথা বলছেন, কিন্তু খুবই সংক্ষিপ্ত বাক্য। তার মধ্যে তদ্ভব-তৎসম শব্দের সংঘর্ষ নেই। রাবীন্দ্রিক নয়, বঙ্কিমী ভাষার স্টাইল তিনি কথাবার্তায়ও চালু করেছিলেন। এটাই ছিল তার কথা বলার বৈশিষ্ট্য। অন্তত গত পঞ্চাশের দশকে যখন তার সঙ্গে পরিচিত হই, তখন তার কথা বলার বৈশিষ্ট্য ছিল এটাই।
এই ভাষার একটু পরিচয় পরে দেব। পঞ্চাশের দশকের সওগাতি আড্ডাতেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি পাটুয়াটুলীর লায়াল স্ট্রিটে (পুরান ঢাকায়) মাসিক সওগাত পত্রিকা অফিসে তখনকার তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার কথা বলছি। এই আড্ডা প্রায় রোজই বসত। তখন সওগাতের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত কবি হাসান হাফিজুর রহমান। তাকে ঘিরেই এই আড্ডা। এ ছাড়া তখনকার তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের জোট পাকিস্তান সাহিত্য সংসদেরও মাসিক বৈঠক বসত সওগাত অফিসে। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন অকৃপণ হস্তে এই বৈঠকে চা-নাস্তা সরবরাহ করতেন।
আজ দীর্ঘকাল পর সেই তারুণ্যভরা উদ্দাম দিনগুলোর কথা ভাবলে মনটা স্মৃতিভারে, আনন্দ-বেদনায় আপ্লুত হয়। আমাদের সবার বয়স এক ছিল না। দু'এক বছরের ব্যবধানে কেউ বড়, কেউ ছোট। তবু আমরা ছিলাম অভিন্ন বন্ধু। নিজেদের মধ্য ঝগড়া-বিবাদ ছিল। কিন্তু পরিচয়ে প্রগতিশীল সাহিত্যের তরুণ গোষ্ঠী হিসেবে আমরা ছিলাম একাট্টা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সেই সূচনাতেই এই গোষ্ঠী ছিল অসাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় জাতীয়তার বিরোধী এবং সেক্যুলার জাতীয়তা ও সাম্যবাদের আদর্শে দীক্ষিত। এই বন্ধুত্বের বলয়ে সওগাতি আড্ডায় খালেদ চৌধুরীর আবির্ভাব একজন স্বল্পভাষী, ভাবুক ও দার্শনিক হিসেবে। তিনি নিজে লিখতেন না। কিন্তু আমরা যারা লিখতাম তাদের চিন্তা-ভাবনার খোরাক জোগাতেন। এভাবে আমাদের সবার অগোচরে কী ভাবে তিনি প্রভু নামে সম্বোধিত হলেন এবং কে তাকে প্রথম এই নামটা দিলেন, তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের আড্ডায় বা সমাবেশে এই প্রভু কথাটি উচ্চারিত হলে তিনি যে খালেদ চৌধুরী, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকত না।
পঞ্চাশের দশকে আমাদের বন্ধু গোষ্ঠীর তালিকা দীর্ঘ। সওগাতের আড্ডায় নিত্যদিনের আড্ডাবাজও ছিলেন এরা। যেমন কবি শামসুর রাহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, তাসিকুল আলম খাঁ, ফজলে লোহানী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, বিজন চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, রাবেয়া খাতুন, আনিস চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, কায়সুল হক এবং আরও অনেকে। এরাও ছিলেন খালেদ চৌধুরীর অনুরাগী এবং ঘনিষ্ঠজন।
সওগাতের আড্ডায় আমাদের চেয়ে বয়সে বড় বুদ্ধিজীবীরাও আসতেন। যেমন আবদুল গণি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দীন, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। বয়সে কিছুটা ছোট তখনকার নবীন কবিরাও আসতেন, যেমন শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, ওমর আলী। একেবারে প্রবীণদের মধ্যে মাঝেসাজে আমন্ত্রিত হয়ে আসতেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আবদুল কাদির। এদের অনেকের মুখে (আমাদের সকলের) খালেদ চৌধুরীর প্রভু নামটি মোটেই বেমানান লাগত না। খালেদ ছিলেন আমাদের বয়সী। কিন্তু ভাবুকতা ও মননে তিনি বিস্ময়করভাবে সব বয়সের মানুষের কাছ থেকেই সমীহ আদায় করেছিলেন।
খালেদ চৌধুরীর বাবা জাহেদুল হক চৌধুরী ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক। কুমিল্লার মানুষ। সেদিক থেকে খালেদ চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায়। কিন্তু জন্ম ও বড় হওয়া মাতুলালয় বিক্রমপুরে। নিজের সম্পর্কে আমাদের এই প্রভু বড় একটা কথা বলতেন না। তবু তার সম্পর্কে যতটা জেনেছি, তাতে মনে হয়, বাবার সঙ্গে তার বড় একটা সম্পর্ক ছিল না। হয়তো তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, তাই মায়ের সঙ্গে খালেদকে অনেক দিন মাতুলালয়েই কাটাতে হয়েছে। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ এবং দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। এই অস্থিরতা তার চরিত্রে স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। তিনি বোহেমিয়ান হয়ে উঠেছিলেন। লেখাপড়া করেছেন প্রচুর। তা নিজের ইচ্ছামতো; কিন্তু কলেজীয় শিক্ষা শেষ করেননি। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় যখন মূলত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও তার শিল্পীবন্ধুদের উদ্যোগে আর্টস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এখানেও শিক্ষার পাঠ শেষ করেননি। কিন্তু বিস্ময়কর ছিল শিল্পকলা এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সম্পর্কে তার জ্ঞান। বিমূর্ত চিত্রকলা সম্পর্কে তার একটি বক্তৃতা আমি একবার শুনেছি। নিজে তার সবটা বুঝেছি, তা বলব না। কিন্তু ঢাকার অনেক বড় শিল্পীকে দেখেছি তার বক্তৃতা তন্ময় হয়ে শুনতে।
পঞ্চাশের দশকে সওগাতের আড্ডায় যখন খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তখন তিনি সত্য সত্যই ভবঘুরে, একেবারে বোহেমিয়ান। কোথায় থাকেন, কোথায় যান, কী করেন তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কিন্তু তার কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগে থাকত অসংখ্য বই। অভিধান থেকে মার্কসবাদ, চার্বাকতত্ত্ব, ইমাম গাজ্জালির দর্শন থেকে সুফিবাদ_ কোনো বিষয়েই তার কাঁধের ঝোলায় বইয়ের অভাব ছিল না। আবার কখনও কখনও তার হাতে দেখেছি ভিক্টর হুগো, ভল্টেয়ার, জাঁ পল সার্ত্রের বই। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি। আমি একবার খালেদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি ভক্তিবাদে বিশ্বাসী? খালেদ জবাব দিয়েছেন, আমি বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করি না। আমি বলেছিলাম, আপনি তো মার্কসবাদে বিশ্বাসী। খালেদ বলেছেন, মার্কসবাদকে বিজ্ঞান হিসেবে বিশ্বাস করি। ডগমা ও ধর্ম হিসেবে নয়। বর্তমানে কমিউনিস্টরা মার্কসবাদকে ধর্মবিশ্বাস করে তুলেছে। মার্কস আজ বেঁচে থাকলে তার তত্ত্বে যে পরিবর্তনগুলো আনতেন, কমিউনিস্টরা সে পরিবর্তনগুলো আনতেও রাজি নয়। ফলে আর কয়েক বছরের মধ্যে মার্কসবাদ ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিণত হতে পারে এবং ধর্মরাষ্ট্রের মতো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থারও পতন ঘটতে পারে। খালেদ চৌধুরীর মুখে এই কথাটি শোনার বহু বছর পর যখন সোভিয়েত এবং পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটে, তখন খালেদ চৌধুরীকে আমার মনে পড়েছিল।
তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যে আমরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। তিনি মানুষকে আকর্ষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখতেন। বাকচাতুর্য দ্বারা নয়, তিনি বন্ধুদের অভিভূত করতেন সব বিষয়ে তার জ্ঞানের প্রসারতা দ্বারা। আমি তখন গল্প লিখতাম। খালেদ আমাকে মানব চরিত্রের দ্বান্দ্বিক বিষয়টি বোঝাতেন। বলতেন, আপনার চরিত্রগুলোর কেবল সাদা আর কালো অংশ দেখাবেন না। এই চরিত্রগুলোর গ্রে (ধূসর) অংশের কথাও মনে রাখবেন।
একদিন শামসুর রাহমান তার একটি নতুন কবিতা সওগাতের আড্ডায় আমাদের শোনালেন। তার প্রথম চরণ ছিল 'গোধূলিতে হলো যার প্রয়াণ হে প্রভু।' কবিতাটি শুনে খালেদ চৌধুরী খুব প্রশংসা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'আমি জীবনের আগমন ও প্রয়াণে বিশ্বাস করি না। জীবন একটি নিরন্তর প্রবাহ। তার অস্তিত্ব ধারণ ও অনস্তিত্বের চলে যাওয়া একটি রোটেশন। এই ব্যাপারে আমি রবীন্দ্র-দর্শনে বিশ্বাসী' বলেই আবৃত্তি করেছিলেন, 'তখন কে বলেগো সেই প্রভাতে নেই আমি/সকল খেলায় করবো খেলা এই আমি/নতুন নামে ডাকবে মোরে/বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে/আসবো যাবো চিরদিনের এই আমি।'
পঞ্চাশের দশকে সেই ভবঘুরে জীবনে খালেদ চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই ক্ষীণ। পিতার সঙ্গে সম্পর্ক বলতে তার পিতা ইসলামপুরে একটি হোটেলে পুত্রের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে সওগাত অফিসে আড্ডা দিতে এসে আমাদের পকেটে দুপুরের খাওয়ার পয়সা থাকত না। প্রায়ই এ অবস্থা হতো আমার, হাসান হাফিজুর রহমান এবং সাইয়িদ আতিকুল্লার। খালেদ চৌধুরী পরম উদারতার সঙ্গে আমাদের ওই ইসলামপুরের হোটেলে ডেকে নিতেন। খাওয়াতেন। হোটেলটিতে রিকশাওয়ালারাই বেশি খেতে আসত। ভাঙা চেয়ার-টেবিল। কিন্তু রান্না ছিল উপাদেয়। খাবার শেষ হলে হোটেলওয়ালা দামটা খাতায় টুকে রাখতেন। পরে তা খালেদের বাবা মাসিক ব্যবস্থায় দিতেন। হোটেলওয়ালা খালেদের খাওয়া শেষ হলে তার হাতে নগদ কিছু পয়সা গুঁজে দিতেন। এটা ছিল দুটো সিজার্স সিগারেট ও কয়েক খিলি পান কেনার পয়সা। ছেলের জন্য পিতার প্রাত্যহিক বরাদ্দ। আমরা তার এই উদারতায় মজা পেতাম।
খালেদ চৌধুরীর কথা বলার ভাষা বৈশিষ্ট্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। একটা উদাহরণ দিই। একদিন সওগাত অফিসে এসে আমাদের না পেয়ে একা তার হোটেলে খেতে চলে গেলেন। হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে একটা চিঠি লিখে গেলেন, তাতে লেখা_ 'হাসান, মৎ কর্তৃক ক্ষুৎপিপাসা উপলব্ধি হওয়ায় হোটেল-গমন করিলাম। ইচ্ছা হইলে অনুগমন করিতে পারো।' আরেকবার দৈনিক সংবাদের প্রথম সম্পাদক খায়রুল কবির ইন্দোনেশিয়া সফর করে এসেছেন। ফজলুল হক হলে এক ছাত্রসভায় তার সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সংবাদ তখন মুসলিম লীগের কাগজ এবং ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের ঘটনা মাত্র সংঘটিত হয়েছে।
খায়রুল কবির সবে বক্তৃতা দিতে উঠেছেন। এই সময় তৎকালীন ছাত্রনেতা গাজিউল হক (ভাষাসৈনিক) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে তার অভিমত কী? খায়রুল কবির বললেন, তিনি ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে কথা বলতে এখানে এসেছেন। ভাষা সম্পর্কে নয়। সুতরাং ভাষা সম্পর্কে তিনি কোনো কথা বলবেন না। সভায় প্রচণ্ড হৈচৈ শুরু হলো। হাতাহাতি, চেয়ার ভাঙাভাঙি শুরু হয় আর কী!
কেউ থামাতে পারছে না। খালেদ চৌধুরী হঠাৎ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আপনাদের কারোই প্রসঙ্গবোধ নেই।' এই কথায় উত্তেজিত ছাত্রেরা কী বুঝেছিলেন জানি না। হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য হাতাহাতি থেমে গিয়েছিল। সভা অবশ্য আর হতে পারেনি। কিন্তু মারামারি আর হয়নি।
আরেকবার সওগাত অফিসে সাহিত্যসভা হচ্ছে। বক্তৃতা দিচ্ছেন অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (একাত্তরের শহীদ)। তার একটি বক্তব্যকে সমর্থন জানাতে গিয়ে খালেদ বেশ জোরে বলে উঠলেন, 'অবশ্য, অবশ্য।' মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কী বুঝলেন জানি না। তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে বসে পড়লেন। সভাশেষে সবাই তাকে ধরলেন, আপনি বক্তৃতা বন্ধ করে বসে পড়লেন কেন? মোফাজ্জল হায়দার বললেন, 'আমাকে যে প্রভু বললেন, বসো বসো।' শুনে খালেদ লজ্জিত হয়ে বললেন, 'আমি আপনাকে সমর্থন জানিয়ে অবশ্য অবশ্য বলেছি, বসে পড়তে তো বলিনি।' তাছাড়া আপনাকে আমি তুমি সম্বোধনও করতে পারি না। আপনি ভুল শুনেছেন।
মধ্য বয়সে তার ভবঘুরে জীবনে কিছুটা স্থিতি আসে। তিনি বিয়ে করেন সম্ভবত ১৯৬৬ কি '৬৭ সালে। বিখ্যাত অভিনেতা আবুল খায়ের এবং বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন রহমানের ছোট বোন হাসিনা চৌধুরীকে। তাদের দুটি ছেলে। দু'জনই এখন বিদেশে। বিয়ের পর খালেদ ঢাকায় সোভিয়েত কনস্যুলেটে অনুবাদকের চাকরি করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জেলে বিচারের নামে হত্যা না করার জন্য পাকিস্তানকে যে কঠোর হুশিয়ারি প্রদান করেন, সেটির বাংলা অনুবাদের দায়িত্বও পড়েছিল খালেদ চৌধুরীর ওপর।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চাকরি নিয়ে মস্কো যান। সম্ভবত একই সঙ্গে গিয়েছিলেন দ্বিজেন শর্মা ও হায়াৎ মামুদ। এ সময় মস্কোতে ছিলেন আলাউদ্দীন আল আজাদ এবং হাসান হাফিজুর রহমানও। ফলে মস্কোতে বাঙালি আড্ডাও ভালো জমে উঠেছিল। মস্কোতে থাকার সময় খালেদ চৌধুরী একাধিক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল গ্রন্থেরও অনুবাদ শুরু করেছিলেন। শেষ করতে পারেননি। দেশে ফিরে তিনি ঢাকার রায়েরবাজারের বাসায় শেষ জীবন কাটিয়েছেন।
এখানে একটি কথা বলা না হলে প্রসঙ্গটি অসমাপ্ত থাকবে। খালেদ চৌধুরী সারাজীবন কপর্দকশূন্য অবস্থায় কাটিয়েছেন। চাকরির টাকায় কোনো রকমে সংসার চালিয়েছেন। এ সময় যে উদারহৃদয় বন্ধুটি তাকে সর্বপ্রকার আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য জুগিয়েছেন তিনি ঢাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা ফজলুল করিম। এই ফজলুল করিম ও খালেদ চৌধুরী ছিলেন অভিন্ন আত্মা। ফজলুল করিমের মৃত্যুর পরও তার পরিবার খালেদ চৌধুরী ও তার পরিবারের দেখাশোনা করার ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেনি।
খালেদ চৌধুরী ছিলেন খুবই প্রচারবিমুখ মানুষ। তাই এত পাণ্ডিত্য ও মনীষা নিয়েও তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে এবং নিজের বাসায় লেখাপড়া নিয়েই মগ্ন থাকতেন। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জের এক গ্রামের বাড়িতে। বাড়িটি বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামের শহীদ রফিক উদ্দীনের। সেখানে প্রশিকার উদ্যোগে আয়োজিত (খালেদ প্রশিকাতেও কিছুকাল কাজ করেছেন) শহীদ স্মরণসভায় ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনও গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন খালেদ চৌধুরীও। সেই আমাদের শেষ দেখা।
তার মৃত্যুতে শোক করব না, স্মরণ করব আমার কালের একজন মনীষাদীপ্ত মানুষকে। তার মৃত্যুতে এই বিদেশে বসেও নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।
লন্ডন, ১৫ জুলাই ২০১১, শুক্রবার
 

No comments

Powered by Blogger.