১১ বছর আগের ঘটনায় ইলিয়াসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতার মামলা-সিলেটে বিস্ময়, ক্ষোভ by আবদুর রাহমান
সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে সিলেটে দুটি মামলা দায়েরের ঘটনা নতুন রহস্যের সৃষ্টি করেছে। প্রায় ১১ বছর আগের একটি ঘটনার অভিযোগ এনে মামলা দুটি করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বশারত আলী বাছা মিয়া।
ঘটনার দীর্ঘদিন পর ইলিয়াস নিখোঁজ হওয়ার পরই কেন এই মামলা- তা নিয়ে জনমনে এখন নানা প্রশ্ন।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন ১৭ এপ্রিল রাতে। রাত দেড়টার দিকে তাঁর গাড়ি উদ্ধার করা হয় ঢাকার বনানী এলাকা থেকে। এর কিছুক্ষণ পরই সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় এ মামলা করা হয়। ১৮ এপ্রিল সকালে মামলাটি রেকর্ড দেখানো হয়েছে; যদিও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, মামলাটি আসলে করা হয়েছে ১৮ এপ্রিল রাতে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে থানার ওসি বিষয়টি গোপন রেখেছেন। ওসির দাবি, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ ঘটনাটি তিনি জানতেন না।
মামলার অভিযোগনামা : মামলার বাদী বশারত আলী বাছা মিয়া অভিযোগ করেন, বিশ্বনাথ-রামপাশা সড়কের পুরানবাজারে তাঁর মালিকানার 'সোনার বাংলা' রেস্টুরেন্টে ইলিয়াস আলী ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর লোক মারফত ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় ১৫ অক্টোবর ইলিয়াস আলী সশস্ত্র অবস্থায় দলবল নিয়ে রেস্টুরেন্ট হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় চার-পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে তাঁর তিন লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এজাহারে আনীত অভিযোগে চাঁদাবাজির ঘটনায় একটি মামলা (মামলা নম্বর ১০) এবং বিস্ফোরক ঘটনায় পৃথক মামলা (মামলা নম্বর ১১) রুজু করা হয়। মামলা গ্রহণের তারিখ ১৮ এপ্রিল। মামলায় ইলিয়াস আলীকে প্রধান আসামি করা হয়। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি সোহেল আহমদ চৌধুরী, সাবেক প্রচার সম্পাদক কলমদর আলী, উপজেলা যুবদলের সদস্য আজাদ নূরের নাম উল্লেখ করে ১৪ থেকে ১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
মামলা রেকর্ড নিয়ে লুকোচুরি : বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক বশারত আলী বাছা মিয়ার দায়ের করা মামলাটি নিয়ে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করছে পুলিশ। মামলাটি কোন দিন এবং কখন রুজু করা হয়, তা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রশাসন) আবুল কালাম আজাদ বলছেন, '১৮ এপ্রিল সকাল ৮টা ৫ মিনিটে মামলা দুটি রেকর্ড হয়েছে।' অথচ থানার অভ্যন্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলাটি রেকর্ড হয়েছে ১৮ এপ্রিল রাত ২টার পরে। ওই সূত্র আরো জানায়, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর ১১ বছরের পুরনো ঘটনা নিয়ে মামলা দায়ের করায় উপস্থিত পুলিশ সদস্যরাও বিস্মিত হন।
ওসি আবুল কালাম আজাদ মামলার কোনো এজাহারের কপি সাংবাদিকদের কাছে দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব দুই কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে।
চাঁদাবাজি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নজরুল ইসলাম এবং বিস্ফোরক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দেবদুলাল বলেন, 'আমরা বাদীর সঙ্গে কথা বলেছি। মামলার অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছি। আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু তাঁরা পলাতক রয়েছেন।'
মামলা ও সরেজমিন ঘটনাস্থল : মামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল শুক্রবার সকালে বিশ্বনাথ উপজেলা সদরে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। মামলার বাদী যে স্থানে তাঁর রেস্টুরেন্ট ছিল বলে দাবি করেছেন, সেখানে এখন কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, আছে একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন বাজারের এই জায়গাটি সরকারি খাসজমি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বশারত আলী বাছা মিয়া একসনা বন্দোবস্ত নেন। সেখানে ঝুপড়িঘরের মতো একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। ছেলেপেলে আড্ডা দিত। পাশেই রয়েছে হাজি মফিজ আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় বখাটেরা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বাছা মিয়ার বন্দোবস্ত বাতিল করা হয় এবং রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করা হয়। এর পর থেকে জায়গাটি খালি ছিল।
স্ট্যান্ডের চালকরা বলেন... : জায়গাটি এখন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন বিশ্বনাথ উপজেলা শাখার নিয়ন্ত্রণে। ইউনিয়নের সভাপতি আবুল মিয়া, মাইক্রোবাসচালক আবদুল হাশিম, শহিদুল ইসলামসহ উপস্থিত একাধিক চালক বলেন, 'এই জায়গাটি ছিল খালের মতো। আমরা এখানে নিজেদের টাকায় মাটি ভরাট করেছি। এরপর এমপি থাকাকালে ইলিয়াস আলীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি রাখছি। আমরা ওই জায়গার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাউকে একটা পয়সাও দিইনি।'
'আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে' : গতকাল সকালে বিশ্বনাথ উপজেলার জানাইয়া গ্রামে বাদীর বাড়িতে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ ছিল না। ঘরের ভেতর থেকে একজন নারী জানান, বাছা মিয়া দশঘর নোয়াগাঁওয়ে এক আত্মীয়ের জানাজায় গেছেন। পরে খবর নিয়ে জানা যায়, তিনি উপজেলা সদরেই রয়েছেন। বাছা মিয়ার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য যাচ্ছি।' তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই বলেই ফোন কেটে দেন। এর পর থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। পরে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে ওই নামে কোনো রোগী গতকাল ভর্তি হয়নি বলে জানানো হয়।
বাদীর ছেলে খোকনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাঁরা ইলিয়াস আলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। ২০০১ সালে দোকান ভাঙচুরের পর তাঁদের বিরুদ্ধে তখন ডাকাতি, নারী নির্যাতন মামলা দেওয়া হয়। তিনি ও তাঁর বাবা জেলও খেটেছেন।
১১ বছর পর এই ঘটনা নিয়ে একজন নিখোঁজ লোকের বিরুদ্ধে তাঁর বাবার মামলা দায়েরের কথা তিনি বা তাঁদের পরিবারের কেউ জানে না বলে জানান খোকন। খোকন বলেন, 'আমরা নির্যাতিত হয়েছি। এ কথা সত্যি। কিন্তু একজন মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পর দুশমনও এভাবে মামলা করতে পারে না। বিষয়টি আমরাও মেনে নিতে পারছি না। আমরাও ইলিয়াস আলীর সন্ধানের অপেক্ষায় আছি।'
খোকন আরো বলেন, 'আমরা নির্যাতিত হওয়ার ব্যাপারে সরকারের কাছে পিটিশন আছে। অনেক আগে এসব পিটিশন করা হয়েছে। এখন এই মুহূর্তে মামলা দায়েরের বিষয়টি বুঝতে পারছি না।' বাবা সম্পর্কে তিনি জানান, তাঁর অবস্থা ভালো নয়। হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা। সিলেটে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন তিনি।
কে এই বাদী : মামলার বাদীর নাম বশারত আলী বাছা মিয়া। বাড়ি বিশ্বনাথের জানাইয়া গ্রামে। তাঁরা চার ভাই, চার বোন। এক ভাই ও এক বোন যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। বাকিরা দেশে থাকেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব বাছা মিয়া আওয়ামী লীগের উপজেলা শাখার শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মুহিবুর রহমানের সঙ্গে থাকায় তাঁকেসহ ১৪ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলে তিনি পদ ফিরে পান।
নেতা-কর্মী-সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ : একজন মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করায় ক্ষুব্ধ দলের নেতা-কর্মীরা। উপজেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোনায়েম খান মামলাটি মিথ্যা দাবি করে বলেন, 'এই মামলাটি প্রমাণ করে- সরকারই ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রেখেছে। ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তার ইর্ষান্বিত হয়ে সরকার এ ঘটনা ঘটাচ্ছে।' উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শামসুল ইসলাম বলেন, 'ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে গোটা সিলেটের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন সুসংগঠিত হচ্ছে। এই প্রতিহিংসা থেকে সরকার তাঁকে নিখোঁজ করেছে।
শাহাবুদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, 'একজন মানুষ নিখোঁজ। তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন কাঁদছে। দেশের মানুষ উৎকণ্ঠায় আছে। এ অবস্থায় সেই মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে- এটা চিন্তা করা যায় না। এই কাজটি খুব বাজে হয়েছে।'
এ মামলা দায়ের নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাও বিব্রত। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, 'দলের সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি এ মামলা করেছেন। আমরা মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না।' এর বেশি তিনি কোনো মন্তব্য করতে বিব্রত বোধ করেন।
প্রতিবাদে অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ : ইলিয়াস আলীর সন্ধান দেওয়া ও তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে বিশ্বনাথ উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল এবং আধা ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেছে স্থানীয় বিএনপি। উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে রামধানা গ্রাম থেকে মিছিলটি বের হয়। সেখান থেকে উপজেলা সদর ঘুরে রশিদপুর গিয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক আধা ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ ছিল। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লিলু মিয়া চেয়ারম্যান। বক্তব্য দেন রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন, উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লিলু মিয়া চেয়ারম্যান, আবদুল হাই, আবুল কালাম কচি, জামায়াত নেতা নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী, ফখরুল ইসলাম প্রমুখ। বক্তারা অবিলম্বে ইলিয়াস আলীকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে এবং মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানান। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
গতকাল জুমার নামাজের পর ইলিয়াস আলীর জন্য বিশ্বনাথ উপজেলা ইমাম সমিতির উদ্যোগে উপজেলার ৪৪২টি মসজিদে বিশেষ মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন ১৭ এপ্রিল রাতে। রাত দেড়টার দিকে তাঁর গাড়ি উদ্ধার করা হয় ঢাকার বনানী এলাকা থেকে। এর কিছুক্ষণ পরই সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় এ মামলা করা হয়। ১৮ এপ্রিল সকালে মামলাটি রেকর্ড দেখানো হয়েছে; যদিও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, মামলাটি আসলে করা হয়েছে ১৮ এপ্রিল রাতে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে থানার ওসি বিষয়টি গোপন রেখেছেন। ওসির দাবি, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ ঘটনাটি তিনি জানতেন না।
মামলার অভিযোগনামা : মামলার বাদী বশারত আলী বাছা মিয়া অভিযোগ করেন, বিশ্বনাথ-রামপাশা সড়কের পুরানবাজারে তাঁর মালিকানার 'সোনার বাংলা' রেস্টুরেন্টে ইলিয়াস আলী ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর লোক মারফত ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় ১৫ অক্টোবর ইলিয়াস আলী সশস্ত্র অবস্থায় দলবল নিয়ে রেস্টুরেন্ট হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় চার-পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে তাঁর তিন লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এজাহারে আনীত অভিযোগে চাঁদাবাজির ঘটনায় একটি মামলা (মামলা নম্বর ১০) এবং বিস্ফোরক ঘটনায় পৃথক মামলা (মামলা নম্বর ১১) রুজু করা হয়। মামলা গ্রহণের তারিখ ১৮ এপ্রিল। মামলায় ইলিয়াস আলীকে প্রধান আসামি করা হয়। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি সোহেল আহমদ চৌধুরী, সাবেক প্রচার সম্পাদক কলমদর আলী, উপজেলা যুবদলের সদস্য আজাদ নূরের নাম উল্লেখ করে ১৪ থেকে ১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
মামলা রেকর্ড নিয়ে লুকোচুরি : বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক বশারত আলী বাছা মিয়ার দায়ের করা মামলাটি নিয়ে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করছে পুলিশ। মামলাটি কোন দিন এবং কখন রুজু করা হয়, তা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রশাসন) আবুল কালাম আজাদ বলছেন, '১৮ এপ্রিল সকাল ৮টা ৫ মিনিটে মামলা দুটি রেকর্ড হয়েছে।' অথচ থানার অভ্যন্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলাটি রেকর্ড হয়েছে ১৮ এপ্রিল রাত ২টার পরে। ওই সূত্র আরো জানায়, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর ১১ বছরের পুরনো ঘটনা নিয়ে মামলা দায়ের করায় উপস্থিত পুলিশ সদস্যরাও বিস্মিত হন।
ওসি আবুল কালাম আজাদ মামলার কোনো এজাহারের কপি সাংবাদিকদের কাছে দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব দুই কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে।
চাঁদাবাজি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নজরুল ইসলাম এবং বিস্ফোরক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দেবদুলাল বলেন, 'আমরা বাদীর সঙ্গে কথা বলেছি। মামলার অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছি। আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু তাঁরা পলাতক রয়েছেন।'
মামলা ও সরেজমিন ঘটনাস্থল : মামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল শুক্রবার সকালে বিশ্বনাথ উপজেলা সদরে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। মামলার বাদী যে স্থানে তাঁর রেস্টুরেন্ট ছিল বলে দাবি করেছেন, সেখানে এখন কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, আছে একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন বাজারের এই জায়গাটি সরকারি খাসজমি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বশারত আলী বাছা মিয়া একসনা বন্দোবস্ত নেন। সেখানে ঝুপড়িঘরের মতো একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। ছেলেপেলে আড্ডা দিত। পাশেই রয়েছে হাজি মফিজ আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় বখাটেরা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বাছা মিয়ার বন্দোবস্ত বাতিল করা হয় এবং রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করা হয়। এর পর থেকে জায়গাটি খালি ছিল।
স্ট্যান্ডের চালকরা বলেন... : জায়গাটি এখন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন বিশ্বনাথ উপজেলা শাখার নিয়ন্ত্রণে। ইউনিয়নের সভাপতি আবুল মিয়া, মাইক্রোবাসচালক আবদুল হাশিম, শহিদুল ইসলামসহ উপস্থিত একাধিক চালক বলেন, 'এই জায়গাটি ছিল খালের মতো। আমরা এখানে নিজেদের টাকায় মাটি ভরাট করেছি। এরপর এমপি থাকাকালে ইলিয়াস আলীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি রাখছি। আমরা ওই জায়গার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাউকে একটা পয়সাও দিইনি।'
'আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে' : গতকাল সকালে বিশ্বনাথ উপজেলার জানাইয়া গ্রামে বাদীর বাড়িতে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ ছিল না। ঘরের ভেতর থেকে একজন নারী জানান, বাছা মিয়া দশঘর নোয়াগাঁওয়ে এক আত্মীয়ের জানাজায় গেছেন। পরে খবর নিয়ে জানা যায়, তিনি উপজেলা সদরেই রয়েছেন। বাছা মিয়ার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য যাচ্ছি।' তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই বলেই ফোন কেটে দেন। এর পর থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। পরে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে ওই নামে কোনো রোগী গতকাল ভর্তি হয়নি বলে জানানো হয়।
বাদীর ছেলে খোকনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাঁরা ইলিয়াস আলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। ২০০১ সালে দোকান ভাঙচুরের পর তাঁদের বিরুদ্ধে তখন ডাকাতি, নারী নির্যাতন মামলা দেওয়া হয়। তিনি ও তাঁর বাবা জেলও খেটেছেন।
১১ বছর পর এই ঘটনা নিয়ে একজন নিখোঁজ লোকের বিরুদ্ধে তাঁর বাবার মামলা দায়েরের কথা তিনি বা তাঁদের পরিবারের কেউ জানে না বলে জানান খোকন। খোকন বলেন, 'আমরা নির্যাতিত হয়েছি। এ কথা সত্যি। কিন্তু একজন মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পর দুশমনও এভাবে মামলা করতে পারে না। বিষয়টি আমরাও মেনে নিতে পারছি না। আমরাও ইলিয়াস আলীর সন্ধানের অপেক্ষায় আছি।'
খোকন আরো বলেন, 'আমরা নির্যাতিত হওয়ার ব্যাপারে সরকারের কাছে পিটিশন আছে। অনেক আগে এসব পিটিশন করা হয়েছে। এখন এই মুহূর্তে মামলা দায়েরের বিষয়টি বুঝতে পারছি না।' বাবা সম্পর্কে তিনি জানান, তাঁর অবস্থা ভালো নয়। হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা। সিলেটে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন তিনি।
কে এই বাদী : মামলার বাদীর নাম বশারত আলী বাছা মিয়া। বাড়ি বিশ্বনাথের জানাইয়া গ্রামে। তাঁরা চার ভাই, চার বোন। এক ভাই ও এক বোন যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। বাকিরা দেশে থাকেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব বাছা মিয়া আওয়ামী লীগের উপজেলা শাখার শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মুহিবুর রহমানের সঙ্গে থাকায় তাঁকেসহ ১৪ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলে তিনি পদ ফিরে পান।
নেতা-কর্মী-সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ : একজন মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করায় ক্ষুব্ধ দলের নেতা-কর্মীরা। উপজেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোনায়েম খান মামলাটি মিথ্যা দাবি করে বলেন, 'এই মামলাটি প্রমাণ করে- সরকারই ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রেখেছে। ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তার ইর্ষান্বিত হয়ে সরকার এ ঘটনা ঘটাচ্ছে।' উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শামসুল ইসলাম বলেন, 'ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে গোটা সিলেটের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন সুসংগঠিত হচ্ছে। এই প্রতিহিংসা থেকে সরকার তাঁকে নিখোঁজ করেছে।
শাহাবুদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, 'একজন মানুষ নিখোঁজ। তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন কাঁদছে। দেশের মানুষ উৎকণ্ঠায় আছে। এ অবস্থায় সেই মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে- এটা চিন্তা করা যায় না। এই কাজটি খুব বাজে হয়েছে।'
এ মামলা দায়ের নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাও বিব্রত। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, 'দলের সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি এ মামলা করেছেন। আমরা মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না।' এর বেশি তিনি কোনো মন্তব্য করতে বিব্রত বোধ করেন।
প্রতিবাদে অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ : ইলিয়াস আলীর সন্ধান দেওয়া ও তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে বিশ্বনাথ উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল এবং আধা ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেছে স্থানীয় বিএনপি। উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে রামধানা গ্রাম থেকে মিছিলটি বের হয়। সেখান থেকে উপজেলা সদর ঘুরে রশিদপুর গিয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক আধা ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ ছিল। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লিলু মিয়া চেয়ারম্যান। বক্তব্য দেন রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন, উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লিলু মিয়া চেয়ারম্যান, আবদুল হাই, আবুল কালাম কচি, জামায়াত নেতা নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী, ফখরুল ইসলাম প্রমুখ। বক্তারা অবিলম্বে ইলিয়াস আলীকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে এবং মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানান। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
গতকাল জুমার নামাজের পর ইলিয়াস আলীর জন্য বিশ্বনাথ উপজেলা ইমাম সমিতির উদ্যোগে উপজেলার ৪৪২টি মসজিদে বিশেষ মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
No comments