প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ-মানবাধিকার ও বাংলাদেশ by আব্বাস ফয়েজ
ব্রিটেনে সরকারি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ছিল এটি উত্তম সুযোগ। আমরা ছিলাম তিনজন। ব্রিটেনের লর্ডসভার লর্ড এরিক এভেবারি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্রাড অ্যাডামস ও এই নিবন্ধের লেখক। গত ৩০ জানুয়ারি লন্ডনের একটি হোটেল স্যুটে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. সাইদুর রহমান খান সভায় উপস্থিত ছিলেন।
আমাদের আলোচনা শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি যে ১৯৯৭ সালে এই চুক্তি তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের আমলেই ঘটেছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে বিলম্ব ঘটছে। পার্বত্য অঞ্চল সফরে মানবাধিকার গ্রুপগুলো বিধিনিষেধের কবলে পড়ছে।
আমাদের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, তাঁর সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ। তিনি এ জন্য পরামর্শ পেতে এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানালেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার যে আইনের আওতায় হবে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনজীবী সমিতির উদ্বেগের বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। তিনি আরও বললেন, সরকার ওই সব উদ্বেগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেছে। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্দেশ্য হলো ক্ষত নিরাময়। সরকার বিচার-সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের দিকে নজর রাখছে এবং আইনের শাসন নিশ্চয়ই অনুসরণ করা হবে।’ তবে ওই আইনের আওতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ এবং জামিনের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট নয় যে সরকার এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে আইন সংশোধনে অগ্রসর হবে কি না।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং এটা যাতে স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যেতে পারে, সে বিষয়ে তাঁর আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রাইফেলসের বিদ্রোহের ঘটনার সময় যে খুন-নির্যাতন হয়েছে, এর বিচার সামরিক আদালত বাদ দিয়ে বেসামরিক আদালতে করার সিদ্ধান্তকেও তারা স্বাগত জানিয়েছে।
মানবাধিকার-সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে শুধু তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগের সদস্যরাই যে আনুকূল্য পাচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আমার উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। বাংলাদেশ দীর্ঘকাল এক অস্বস্তিকর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। সেটা হলো, অপরাধবিষয়ক কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিষয়ে সরকারের নমনীয় থাকা। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, সম্প্রতি একটি ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ২০ জনের সাজা মওকুফ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯ জনই কেন শুধু ক্ষমতাসীন দলভুক্ত? সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের তৎপরতার ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করে বললাম, তাদের নিজেদের কোন্দলের পরিণতিতে মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন ঘটেছে, কিন্তু এ ঘটনাগুলো শাস্তির বাইরে থাকছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানালেন, মৃত্যুদণ্ডগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সে কারণে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মার্জনা করা হয়েছে। তাঁর এ ব্যাখ্যা আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ, আমি আশা করেছিলাম, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও অধিকসংখ্যক বন্দীকে মার্জনা করা হবে, সে আশ্বাস তিনি দেবেন এবং সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি বাছাইয়ে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হবে। প্রধানমন্ত্রী জানালেন, তিনি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং অপরাধ করার কারণে ছাত্রলীগের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন ব্যাপক মাত্রায় অব্যাহত থাকার ব্যাপারে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চেয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নীতিমালা মেনে চলবে কি না। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সে বিষয়েও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। অথচ এ হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে এবং তা বন্ধে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ২০০৪ সাল থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে এবং বললেন, গোড়া থেকেই আমি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তবে তিনি জানালেন, রাতারাতি এটা বন্ধ করা যাবে না। তবে সব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। যদি কোনো কর্মকর্তা অপরাধ সংঘটন করে থাকেন, তাহলে দ্রুতই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এটা ঠিক যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা বন্ধ করার লক্ষ্যে এখনই কাজ শুরু করা যেতে পারে। যখন প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে আশাবাদের কথা শোনা গেছে, তখন সরকার এদিকে মনোযোগী হবে, সে আশা আমরা করতে পারি। কিন্তু এরপর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে যখন শুনলাম, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেইনি, তখন সেই আশাবাদ ম্লান হয়ে পড়ে।
আব্বাস ফয়েজ: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া গবেষক।
আমাদের আলোচনা শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি যে ১৯৯৭ সালে এই চুক্তি তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের আমলেই ঘটেছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে বিলম্ব ঘটছে। পার্বত্য অঞ্চল সফরে মানবাধিকার গ্রুপগুলো বিধিনিষেধের কবলে পড়ছে।
আমাদের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, তাঁর সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ। তিনি এ জন্য পরামর্শ পেতে এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানালেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার যে আইনের আওতায় হবে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনজীবী সমিতির উদ্বেগের বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। তিনি আরও বললেন, সরকার ওই সব উদ্বেগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেছে। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্দেশ্য হলো ক্ষত নিরাময়। সরকার বিচার-সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের দিকে নজর রাখছে এবং আইনের শাসন নিশ্চয়ই অনুসরণ করা হবে।’ তবে ওই আইনের আওতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ এবং জামিনের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট নয় যে সরকার এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে আইন সংশোধনে অগ্রসর হবে কি না।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং এটা যাতে স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যেতে পারে, সে বিষয়ে তাঁর আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রাইফেলসের বিদ্রোহের ঘটনার সময় যে খুন-নির্যাতন হয়েছে, এর বিচার সামরিক আদালত বাদ দিয়ে বেসামরিক আদালতে করার সিদ্ধান্তকেও তারা স্বাগত জানিয়েছে।
মানবাধিকার-সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে শুধু তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগের সদস্যরাই যে আনুকূল্য পাচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আমার উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। বাংলাদেশ দীর্ঘকাল এক অস্বস্তিকর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। সেটা হলো, অপরাধবিষয়ক কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিষয়ে সরকারের নমনীয় থাকা। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, সম্প্রতি একটি ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ২০ জনের সাজা মওকুফ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯ জনই কেন শুধু ক্ষমতাসীন দলভুক্ত? সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের তৎপরতার ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করে বললাম, তাদের নিজেদের কোন্দলের পরিণতিতে মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন ঘটেছে, কিন্তু এ ঘটনাগুলো শাস্তির বাইরে থাকছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানালেন, মৃত্যুদণ্ডগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সে কারণে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মার্জনা করা হয়েছে। তাঁর এ ব্যাখ্যা আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ, আমি আশা করেছিলাম, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও অধিকসংখ্যক বন্দীকে মার্জনা করা হবে, সে আশ্বাস তিনি দেবেন এবং সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি বাছাইয়ে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হবে। প্রধানমন্ত্রী জানালেন, তিনি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং অপরাধ করার কারণে ছাত্রলীগের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন ব্যাপক মাত্রায় অব্যাহত থাকার ব্যাপারে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চেয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নীতিমালা মেনে চলবে কি না। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সে বিষয়েও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। অথচ এ হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে এবং তা বন্ধে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ২০০৪ সাল থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে এবং বললেন, গোড়া থেকেই আমি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তবে তিনি জানালেন, রাতারাতি এটা বন্ধ করা যাবে না। তবে সব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। যদি কোনো কর্মকর্তা অপরাধ সংঘটন করে থাকেন, তাহলে দ্রুতই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এটা ঠিক যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা বন্ধ করার লক্ষ্যে এখনই কাজ শুরু করা যেতে পারে। যখন প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে আশাবাদের কথা শোনা গেছে, তখন সরকার এদিকে মনোযোগী হবে, সে আশা আমরা করতে পারি। কিন্তু এরপর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে যখন শুনলাম, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেইনি, তখন সেই আশাবাদ ম্লান হয়ে পড়ে।
আব্বাস ফয়েজ: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া গবেষক।
No comments