বহেকাল নিরবধি-আশফাক কায়ানি ও প্রধানমন্ত্রী গিলানি কেউ কারো চেয়ে কম নন by এম আবদুল হাফিজ
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, জারদারির নেতৃত্বাধীন পিপিপি সরকারকে ঘিরে প্রতিকূলতার মেঘ ক্রমেই কেটে যাচ্ছে। ফলে পাকিস্তানে দীর্ঘদিন পর একটি বেসামরিক সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করার পথে। এ সরকারই সম্ভবত তার নিজ শর্তে এবং সুবিধায় পরবর্তী নির্বাচন দেওয়ার বিলাসিতা ভোগ করতে যাচ্ছে।
বিষয়টি স্বয়ং আশফাক কায়ানিই এই বলে খোলাসা করেছেন যে সামরিক বাহিনী 'অতীতের মতোই' দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখবে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান মেমোগেট বিতর্কের তদন্তকারী দলকে আরো দুই মাসের সময় দিয়েছে এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানির বিদেশ ভ্রমণের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পাকিস্তানি ব্যবসায়ী এজাজ মনসুর হুসেন হাক্কানির তরফ থেকে অ্যাডমিরাল মাইক মুলেনকে একটি মেমোর মাধ্যমে পাকিস্তানে একটি সম্ভাব্য সামরিক ক্ষমতা দখল ঠেকানোর অনুরোধ করা হয়েছিল এবং তা থেকেই 'মেমোগেট' নামটি চালু হয়। স্মরণ থাকতে পারে যে এর কিছুদিন আগে ২ মে-তে (২০১১) মার্কিন বিশেষ বাহিনী অ্যাবোটাবাদে চোরা আক্রমণে বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল। এখানে দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। এক. লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার নেপথ্যে কে বা কারা ছিল; দুই. যুক্তরাষ্ট্রই বা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে কোন অধিকারে পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে চোরা আক্রমণে লিপ্ত হয়েছিল। মেমোগেটও ঘটেছিল পাক-মার্কিন সম্পর্কের এক স্পর্শকাতর আস্থাহীনতার পটভূমিতে।
অতঃপর কয়েক মাস ধরে মেমোগেটের অভিযোগকে পুঁজি করে ফেডারেল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা। সামরিক বাহিনী এবং দেশের উচ্চ আদালত, যদিও বা তাদের সবারই লক্ষ্য অভিন্ন ছিল না। কিন্তু এখন যা এত দিন পাকিস্তানকে রুদ্ধশ্বাস করে রেখেছিল এবং আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের অপচ্ছায়া সৃষ্টি করে রেখেছিল, সেই অস্বস্তিকর সময়ের অবসান হয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতে ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে মোড় নেবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে এ মুহূর্তের ধারণা যে ক্ষয়প্রাপ্ত পাকিস্তান, যা তার অস্তিত্বের অর্ধেক সময় ধরে সেনাশাসিত থেকেছে, আবার 'ব্লাডি সিভিলিয়ানরা' ক্ষমতায় আসীন থাকার সময়ও অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় জড়োসড়ো থেকেছে, তা বোধ হয় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক সৃষ্টি করে মেমোগেটের প্রবেশপথ ধরে অন্তর্হিত হলো।
পাকিস্তানের সম্মিলিত জনস্মৃতিতে এমন কোনো বেসামরিক শাসন নেই, যা নাকি মিলিটারির চোখে চোখে তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু তা এবার এমন একটি সরকারের মুখোমুখি যা শুধু তাদের চোখের ওপর দৃষ্টিপাত করেনি, রীতিমতো অক্ষিগোলক (Eyeball to eyeball) দিয়েই তাকিয়েছে উর্দি পরা ক্ষমতাবানের দিকে। তার পরও সে বেসামরিক সরকার অক্ষত আছে তা অন্তত সুপ্রিম কোর্ট ও সামরিক বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণকে অল্প সময়ের ব্যবধানে ঠেকিয়ে টিকে আছে। মনে হচ্ছে, এখনো টিকে থাকা এ সরকারই মেয়াদ শেষ করে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনেরও তদারকির দায়িত্বে থাকবে।
অযোগ্য এ সরকারের বিরুদ্ধে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই এমনটি ভাবা যাবে না। বিশেষ করে একটি পিপিপি সরকার কখনোই তীক্ষ্ন সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারেনি কারণ যা-ই হোক না কেন। গণমাধ্যম ও নিন্দুক ভাবাপন্নদের কাছে তা কদাচিৎ গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অবশ্য কেউ এখনো পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানকে 'অতীতের বিষয়' বলার ঝুঁকি নিতে নারাজ। তবে পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে তা আর আগের মতো সহজসাধ্য হবে না।
অ্যাবোটবাদে লাদেনের গুপ্তবাসের বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলেও সামরিক বাহিনী নিজেদেরও আশ্রয়দানের ব্যাপারে দোষী ভাবতে শুরু করলেই নানাভাবে পর্যুদস্ত জারদারি সরকারের পালে হাওয়া লাগতে থাকে। তার পরে মিস্টার টেন পারসেন্টের এই সরকারকে দেশবাসী বৈধতা দিতে চায়নি। জারদারির গলায় অতীতের অপকর্মগুলো মালার মতো ঝুলতে থাকে। বেনজির ভুট্টোর পর যে প্রক্রিয়ায় জারদারি ক্ষমতারোহণ করেন তাও অনেক পাকিস্তানি, এমনকি পিপিপি সমর্থকদের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। মূলত জারদারির একগুঁয়েমি মনোভাব বহুলাংশে পিপিপি সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।
বালুচ বংশোদ্ভূত জারদারি রাজনীতিতেও লড়াকু এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিও রাজনীতিতে তাঁর তেজস্ক্রিয়তা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর স্পেডকে স্পেড বলার দুর্দান্ত সাহস আছে। যখন সুপ্রিম কোর্ট ও সামরিক বাহিনী পিপিপি নেতৃত্বের শ্বাসনালিকে রুদ্ধ করার উপক্রম করেছিল, গিলানিই প্রথমবারের মতো ২ মে থেকে সার্বভৌমত্ব এবং দুমুখো খেলার যে প্রশ্নটি, যা সারা জাতি শুধু আকারে-ইংগিতে তুলে ধরেছিল, স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন।
জারদারি সরকার যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হক্কানিকে পরোক্ষভাবে সেনা তোষণে পদত্যাগ করতে বলে বিশ্বস্ত একজন রাষ্ট্রদূতকে হারিয়েছিল। যখন সামরিক বাহিনী এতেও তুষ্ট ছিল না তখন পিপিপিই সিদ্ধান্ত নেয় তার কণ্ঠনালি চেপে ধরার এবং শেষ পর্যন্ত লড়ার। হক্কানিকে মিলিটারি যখন অতি মার্কিন ভক্ত হিসেবে এবং মার্কিনিদের অনেক বেশি সংখ্যায় ভিসা প্রদানের দায়ে অভিযুক্ত করে, গিলানি প্রথমবারের মতো ওপরে তুলে আনেন, যা কট্টর গণতন্ত্রীরা তাঁর কাছ থেকে শুনতে তাঁকে চাপ দিয়ে আসছিল, বিশেষ করে ২০১১ সালের ২ মে থেকে।
এত দীর্ঘদিন বিন লাদেন কিভাবে, কোন ব্যবস্থায় পাকিস্তানে বাস করে আসছিল? তিনি (লাদেন) কি প্রকারের ভিসার বলে সপরিবারে এখানে থাকতেন? গত বছরের ২২ ডিসেম্বর গিলানি খোদ পার্লামেন্টে এ প্রশ্নগুলো তোলেন, যাতে বিষয়টি দাপ্তরিকভাবেই নথিভুক্ত থাকে। গিলানি সে সময় এও অভিযোগ করেন যে সেনাবাহিনীর আচরণ রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্রের (A state within a state) মতো, যা অনভিপ্রেত।
ক্রিস্টমাসের আগে ও পরে পার্লামেন্টে আরো কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন গিলানি। এতে তিনি সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সরকার উৎখাত হওয়া সম্বন্ধেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এতে সামরিক বাহিনীর যথেচ্ছাচারে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে থাকে। সরকারের প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, সেনাবাহিনীর কৃতকর্মে নিজেদের সম্বন্ধেও সেনাবাহিনীর অপরাধবোধ ও দ্রুত চলমান প্রতিকূল ঘটনাপ্রবাহে এবং সর্বোপরি সামগ্রিক প্রবণতা জেনারেল কায়ানিকে বাধ্য করে সমগ্র বিষয়টির একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদানে, বিশেষ করে সরকার বনাম সামরিক বাহিনীর সমীকরণে সন্দেহ ও সংশয় দূরীকরণে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে তিনি ঘোষণা দেন, সামরিক বাহিনী তাঁর আমলে সব সময়ই দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছে এবং ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে।
পাকিস্তান-আফগান সীমান্তের মেহমন্দ ও খুররাম এজেন্সিতে রণাঙ্গন এলাকায় সেনা সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণদানকালে জেনারেল কায়ানি একটি সেনা অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতের সব অনুমানকে 'ভুয়া' বলে অভিহিত করেন এবং পরিষ্কার বলেন যে এসবই দেশের সত্যিকারের সমস্যা থেকে দৃষ্টি হটিয়ে রাখার প্রয়াস। পরিণতিতে কিছুদিনের জন্য উদ্বেগ-আশঙ্কা থিতিয়ে এলে আবার সেগুলো নতুন মাত্রা পায় নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। চীনের 'দ্য পিপলস ডেইলির' সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টে মেমোগেট মামলায় সেনা ও সেনা-গোয়েন্দা প্রধানের প্রদত্ত প্রতিবেদনকে 'অসাংবিধানিক' ও আইনবহির্ভূত বলেছেন। এ সাক্ষাৎ দেওয়ার সময় জেনারেল কায়ানি সশরীরে চীনে সরকারি সফরে ছিলেন।
একটি তাৎক্ষণিক প্রত্যাঘাতের মতো সেনাবাহিনীও প্রত্যুত্তরে জানায় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেনা ও সেনা গোয়েন্দা প্রধানের বিরুদ্ধে সংবিধান ভঙ্গের যে অভিযোগ এনেছেন তা মারাত্মক, যার অনেক শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে আসতে পারে এবং দেশের জন্য আনতে পারে দুঃখজনক পরিণতি। এবার স্পষ্টভাবে বেকায়দায় পড়ে প্রধানমন্ত্রী সঠিক ঘা-টিই বসালেন। তাঁর মতে, ১৬ ডিসেম্বরে যখন তিনি কায়ানির সঙ্গে মিলিত হন তখন তিনি স্বীকার করেন যে সেনাপ্রধানও সেনা গোয়েন্দা প্রধানের সুপ্রিম কোর্টকে লেখা পত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই পৌঁছানো হয়েছিল এবং তা রুলস অব বিজনেস মোতাবেকই ছিল। তাই এটাকে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এক দ্বন্দ্বের লক্ষণ বলে ভুল ব্যাখ্যা করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত এই ব্যাখ্যা পুনরুত্তর হিসেবে প্রেরণের সময় যথাযথভাবে চিহ্নিতও করা হয়েছিল।
একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টও সরকারকে চাপ দিতে থাকে সরকারের অভ্যন্তরে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির মামলাগুলো পুনরারম্ভ করতে। স্মরণ থাকতে পারে, ওই মামলাগুলো জেনারেল মোশাররফের তথাকথিত National Reconciliation Ordinance-এর আওতায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। জারিদারির বিরুদ্ধে তো জলজ্যান্ত অর্থ কেলেঙ্কারির মামলা আছেই, এখন গিলানিকেও দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হচ্ছে।
বেকায়দায় পড়ে বিষয়টির নিষ্পত্তিকল্পে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের একটি জরুরি বৈঠক ডাকলেও জারদারির দুর্নীতির মামলাগুলো পুনরারম্ভ না করায় গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবজ্ঞা করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। চিহ্ন স্পষ্ট হতে থাকে যে এবার হয়তো সরকারকে সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের (Constitutional coup) মুখোমুখি হতে হবে। যাহোক, এমন একটি অভিযোগ নিয়েই একজন বিমর্ষ গিলানি আদালতে হাজির হন। অপরদিকে প্রেসিডেন্ট জারদারিও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভিন্নমতের স্থানগুলো মসৃণ করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী জারদারির বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সম্পর্কে তাঁর পুরনো যুক্তিতে অটল থাকেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রপ্রধানদের সচরাচর এমন ক্ষেত্রে অব্যাহতির ঐতিহ্য আছে।
যাহোক, কোর্ট থেকে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ধরনের শাস্তি স্থগিত করা সত্ত্বেও মামলা যথারীতি চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে হক্কানীও প্রাণভয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিবাসেই অবস্থানরত। তবে কোনো বিষয়েই কোনো সমঝোতা হয়নি। অনেক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সব কিছুই অনিশ্চয়তায় ঝুলে রয়েছে। আশ্চর্য যে সব কিছু প্রায় কিনারে ভিড়লেও তরী এখনো ডুবতে পারে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পাকিস্তানি ব্যবসায়ী এজাজ মনসুর হুসেন হাক্কানির তরফ থেকে অ্যাডমিরাল মাইক মুলেনকে একটি মেমোর মাধ্যমে পাকিস্তানে একটি সম্ভাব্য সামরিক ক্ষমতা দখল ঠেকানোর অনুরোধ করা হয়েছিল এবং তা থেকেই 'মেমোগেট' নামটি চালু হয়। স্মরণ থাকতে পারে যে এর কিছুদিন আগে ২ মে-তে (২০১১) মার্কিন বিশেষ বাহিনী অ্যাবোটাবাদে চোরা আক্রমণে বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল। এখানে দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। এক. লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার নেপথ্যে কে বা কারা ছিল; দুই. যুক্তরাষ্ট্রই বা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে কোন অধিকারে পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে চোরা আক্রমণে লিপ্ত হয়েছিল। মেমোগেটও ঘটেছিল পাক-মার্কিন সম্পর্কের এক স্পর্শকাতর আস্থাহীনতার পটভূমিতে।
অতঃপর কয়েক মাস ধরে মেমোগেটের অভিযোগকে পুঁজি করে ফেডারেল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা। সামরিক বাহিনী এবং দেশের উচ্চ আদালত, যদিও বা তাদের সবারই লক্ষ্য অভিন্ন ছিল না। কিন্তু এখন যা এত দিন পাকিস্তানকে রুদ্ধশ্বাস করে রেখেছিল এবং আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের অপচ্ছায়া সৃষ্টি করে রেখেছিল, সেই অস্বস্তিকর সময়ের অবসান হয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতে ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে মোড় নেবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে এ মুহূর্তের ধারণা যে ক্ষয়প্রাপ্ত পাকিস্তান, যা তার অস্তিত্বের অর্ধেক সময় ধরে সেনাশাসিত থেকেছে, আবার 'ব্লাডি সিভিলিয়ানরা' ক্ষমতায় আসীন থাকার সময়ও অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় জড়োসড়ো থেকেছে, তা বোধ হয় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক সৃষ্টি করে মেমোগেটের প্রবেশপথ ধরে অন্তর্হিত হলো।
পাকিস্তানের সম্মিলিত জনস্মৃতিতে এমন কোনো বেসামরিক শাসন নেই, যা নাকি মিলিটারির চোখে চোখে তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু তা এবার এমন একটি সরকারের মুখোমুখি যা শুধু তাদের চোখের ওপর দৃষ্টিপাত করেনি, রীতিমতো অক্ষিগোলক (Eyeball to eyeball) দিয়েই তাকিয়েছে উর্দি পরা ক্ষমতাবানের দিকে। তার পরও সে বেসামরিক সরকার অক্ষত আছে তা অন্তত সুপ্রিম কোর্ট ও সামরিক বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণকে অল্প সময়ের ব্যবধানে ঠেকিয়ে টিকে আছে। মনে হচ্ছে, এখনো টিকে থাকা এ সরকারই মেয়াদ শেষ করে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনেরও তদারকির দায়িত্বে থাকবে।
অযোগ্য এ সরকারের বিরুদ্ধে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই এমনটি ভাবা যাবে না। বিশেষ করে একটি পিপিপি সরকার কখনোই তীক্ষ্ন সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারেনি কারণ যা-ই হোক না কেন। গণমাধ্যম ও নিন্দুক ভাবাপন্নদের কাছে তা কদাচিৎ গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অবশ্য কেউ এখনো পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানকে 'অতীতের বিষয়' বলার ঝুঁকি নিতে নারাজ। তবে পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে তা আর আগের মতো সহজসাধ্য হবে না।
অ্যাবোটবাদে লাদেনের গুপ্তবাসের বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলেও সামরিক বাহিনী নিজেদেরও আশ্রয়দানের ব্যাপারে দোষী ভাবতে শুরু করলেই নানাভাবে পর্যুদস্ত জারদারি সরকারের পালে হাওয়া লাগতে থাকে। তার পরে মিস্টার টেন পারসেন্টের এই সরকারকে দেশবাসী বৈধতা দিতে চায়নি। জারদারির গলায় অতীতের অপকর্মগুলো মালার মতো ঝুলতে থাকে। বেনজির ভুট্টোর পর যে প্রক্রিয়ায় জারদারি ক্ষমতারোহণ করেন তাও অনেক পাকিস্তানি, এমনকি পিপিপি সমর্থকদের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। মূলত জারদারির একগুঁয়েমি মনোভাব বহুলাংশে পিপিপি সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।
বালুচ বংশোদ্ভূত জারদারি রাজনীতিতেও লড়াকু এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিও রাজনীতিতে তাঁর তেজস্ক্রিয়তা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর স্পেডকে স্পেড বলার দুর্দান্ত সাহস আছে। যখন সুপ্রিম কোর্ট ও সামরিক বাহিনী পিপিপি নেতৃত্বের শ্বাসনালিকে রুদ্ধ করার উপক্রম করেছিল, গিলানিই প্রথমবারের মতো ২ মে থেকে সার্বভৌমত্ব এবং দুমুখো খেলার যে প্রশ্নটি, যা সারা জাতি শুধু আকারে-ইংগিতে তুলে ধরেছিল, স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন।
জারদারি সরকার যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হক্কানিকে পরোক্ষভাবে সেনা তোষণে পদত্যাগ করতে বলে বিশ্বস্ত একজন রাষ্ট্রদূতকে হারিয়েছিল। যখন সামরিক বাহিনী এতেও তুষ্ট ছিল না তখন পিপিপিই সিদ্ধান্ত নেয় তার কণ্ঠনালি চেপে ধরার এবং শেষ পর্যন্ত লড়ার। হক্কানিকে মিলিটারি যখন অতি মার্কিন ভক্ত হিসেবে এবং মার্কিনিদের অনেক বেশি সংখ্যায় ভিসা প্রদানের দায়ে অভিযুক্ত করে, গিলানি প্রথমবারের মতো ওপরে তুলে আনেন, যা কট্টর গণতন্ত্রীরা তাঁর কাছ থেকে শুনতে তাঁকে চাপ দিয়ে আসছিল, বিশেষ করে ২০১১ সালের ২ মে থেকে।
এত দীর্ঘদিন বিন লাদেন কিভাবে, কোন ব্যবস্থায় পাকিস্তানে বাস করে আসছিল? তিনি (লাদেন) কি প্রকারের ভিসার বলে সপরিবারে এখানে থাকতেন? গত বছরের ২২ ডিসেম্বর গিলানি খোদ পার্লামেন্টে এ প্রশ্নগুলো তোলেন, যাতে বিষয়টি দাপ্তরিকভাবেই নথিভুক্ত থাকে। গিলানি সে সময় এও অভিযোগ করেন যে সেনাবাহিনীর আচরণ রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্রের (A state within a state) মতো, যা অনভিপ্রেত।
ক্রিস্টমাসের আগে ও পরে পার্লামেন্টে আরো কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন গিলানি। এতে তিনি সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সরকার উৎখাত হওয়া সম্বন্ধেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এতে সামরিক বাহিনীর যথেচ্ছাচারে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে থাকে। সরকারের প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, সেনাবাহিনীর কৃতকর্মে নিজেদের সম্বন্ধেও সেনাবাহিনীর অপরাধবোধ ও দ্রুত চলমান প্রতিকূল ঘটনাপ্রবাহে এবং সর্বোপরি সামগ্রিক প্রবণতা জেনারেল কায়ানিকে বাধ্য করে সমগ্র বিষয়টির একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদানে, বিশেষ করে সরকার বনাম সামরিক বাহিনীর সমীকরণে সন্দেহ ও সংশয় দূরীকরণে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে তিনি ঘোষণা দেন, সামরিক বাহিনী তাঁর আমলে সব সময়ই দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছে এবং ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে।
পাকিস্তান-আফগান সীমান্তের মেহমন্দ ও খুররাম এজেন্সিতে রণাঙ্গন এলাকায় সেনা সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণদানকালে জেনারেল কায়ানি একটি সেনা অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতের সব অনুমানকে 'ভুয়া' বলে অভিহিত করেন এবং পরিষ্কার বলেন যে এসবই দেশের সত্যিকারের সমস্যা থেকে দৃষ্টি হটিয়ে রাখার প্রয়াস। পরিণতিতে কিছুদিনের জন্য উদ্বেগ-আশঙ্কা থিতিয়ে এলে আবার সেগুলো নতুন মাত্রা পায় নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। চীনের 'দ্য পিপলস ডেইলির' সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টে মেমোগেট মামলায় সেনা ও সেনা-গোয়েন্দা প্রধানের প্রদত্ত প্রতিবেদনকে 'অসাংবিধানিক' ও আইনবহির্ভূত বলেছেন। এ সাক্ষাৎ দেওয়ার সময় জেনারেল কায়ানি সশরীরে চীনে সরকারি সফরে ছিলেন।
একটি তাৎক্ষণিক প্রত্যাঘাতের মতো সেনাবাহিনীও প্রত্যুত্তরে জানায় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেনা ও সেনা গোয়েন্দা প্রধানের বিরুদ্ধে সংবিধান ভঙ্গের যে অভিযোগ এনেছেন তা মারাত্মক, যার অনেক শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে আসতে পারে এবং দেশের জন্য আনতে পারে দুঃখজনক পরিণতি। এবার স্পষ্টভাবে বেকায়দায় পড়ে প্রধানমন্ত্রী সঠিক ঘা-টিই বসালেন। তাঁর মতে, ১৬ ডিসেম্বরে যখন তিনি কায়ানির সঙ্গে মিলিত হন তখন তিনি স্বীকার করেন যে সেনাপ্রধানও সেনা গোয়েন্দা প্রধানের সুপ্রিম কোর্টকে লেখা পত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই পৌঁছানো হয়েছিল এবং তা রুলস অব বিজনেস মোতাবেকই ছিল। তাই এটাকে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এক দ্বন্দ্বের লক্ষণ বলে ভুল ব্যাখ্যা করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত এই ব্যাখ্যা পুনরুত্তর হিসেবে প্রেরণের সময় যথাযথভাবে চিহ্নিতও করা হয়েছিল।
একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টও সরকারকে চাপ দিতে থাকে সরকারের অভ্যন্তরে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির মামলাগুলো পুনরারম্ভ করতে। স্মরণ থাকতে পারে, ওই মামলাগুলো জেনারেল মোশাররফের তথাকথিত National Reconciliation Ordinance-এর আওতায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। জারিদারির বিরুদ্ধে তো জলজ্যান্ত অর্থ কেলেঙ্কারির মামলা আছেই, এখন গিলানিকেও দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হচ্ছে।
বেকায়দায় পড়ে বিষয়টির নিষ্পত্তিকল্পে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের একটি জরুরি বৈঠক ডাকলেও জারদারির দুর্নীতির মামলাগুলো পুনরারম্ভ না করায় গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবজ্ঞা করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। চিহ্ন স্পষ্ট হতে থাকে যে এবার হয়তো সরকারকে সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের (Constitutional coup) মুখোমুখি হতে হবে। যাহোক, এমন একটি অভিযোগ নিয়েই একজন বিমর্ষ গিলানি আদালতে হাজির হন। অপরদিকে প্রেসিডেন্ট জারদারিও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভিন্নমতের স্থানগুলো মসৃণ করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী জারদারির বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সম্পর্কে তাঁর পুরনো যুক্তিতে অটল থাকেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রপ্রধানদের সচরাচর এমন ক্ষেত্রে অব্যাহতির ঐতিহ্য আছে।
যাহোক, কোর্ট থেকে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ধরনের শাস্তি স্থগিত করা সত্ত্বেও মামলা যথারীতি চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে হক্কানীও প্রাণভয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিবাসেই অবস্থানরত। তবে কোনো বিষয়েই কোনো সমঝোতা হয়নি। অনেক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সব কিছুই অনিশ্চয়তায় ঝুলে রয়েছে। আশ্চর্য যে সব কিছু প্রায় কিনারে ভিড়লেও তরী এখনো ডুবতে পারে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট
No comments