জ্বালানি-সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পেতে কয়লার বিকল্প নেই by মুশফিকুর রহমান
বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। অবশ্য নির্ভরযোগ্য ও বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ তাতে নিশ্চিত হয়নি। সর্বশেষ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
প্রস্তাবিত বেশি দামের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সময় ও সরবরাহ করা বিদ্যুতের বৈশিষ্ট্যভেদে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ১৩-২২ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটা স্পষ্ট, বিদ্যমান বিদ্যুৎমূল্যের চেয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাম কয়েক গুণ বেশি হবে। এর পরও ডিজেলচালিত ছোট ছোট জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর চেয়ে নতুন প্রস্তাব অনেকের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে। প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হলে বেশি মূল্য দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী গ্রাহকের জন্য সুযোগ বাড়বে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি কিছু কমতে পারে। কিন্তু সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের সুযোগ তাতে নেই। এখনো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বেশি দামের বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে গ্রাহককে কারিগরি প্রস্তুতির জন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে; কোন কোন এলাকায় গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া যাবে, তা স্পষ্ট নয়। আবার সীমিত উৎপাদনের বিদ্যুৎ বেশি দামে কিনতে ইচ্ছুক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গ্রাহককে সরবরাহ করতে হলে সাধারণ গ্রাহকের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সেবার মানের কী হবে, সেটিও বড় জিজ্ঞাসা।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, আমদানি করা তেলের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এবং উৎপাদিত বিদ্যুতের বিদ্যমান মূল্যের মধ্যে বিশাল পার্থক্য এখন আর তারা সরকারের দেওয়া ভর্তুকি দিয়ে মেটাতে পারছেন না। উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে সরকারের ঋণসহায়তা নেওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বারবার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য গ্রাহক পর্যায়ে ‘যৌক্তিকীকরণের’ চাপ বাড়ছে। সম্প্রতি সরকার আইএমএফের কাছে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য আনতে সহায়তার জন্য ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার সম্মতি পেয়েছে। এই ঋণ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য যৌক্তিকীকরণ। শর্ত অনুযায়ী, সরকার ২০১২ সালের মধ্যে দেশের বাজারে আমদানি করা জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে। তেল আমদানি ব্যয় অব্যাহতভাবে বেড়ে চলায় দেশের সীমিত সম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে এবং অর্থনীতির ভারসাম্যে শৃঙ্খলা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, আগামী অর্থবছরে আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে কয়লার সরবরাহ-ঘাটতি ও মূল্যও বাড়ছে। আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে যে কটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই জ্বালানি তেলনির্ভর। গ্যাসভিত্তিক পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হয় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের অভাবে বা যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতায় সীমিত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। অন্যদিকে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ গ্যাস পোড়াতে হয়, তা দিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনেক বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সে কারণে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে ঘাটতির গ্যাস অগ্রাধিকারের জায়গায় পাঠানোর চাপ আছে। সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৭টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ করতে চেয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পিত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই সময়মতো উৎপাদনে যেতে পারবে না। এর কোনোটির কার্যাদেশ দিতে বেশি সময় লেগেছে, কোনোটি কার্যাদেশ পেয়েও অর্থ সংস্থান করতে না পারায় কাজ শুরু করতে পারেনি। স্বল্পমেয়াদি ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যেগুলো চালু হয়েছে, সেগুলোও সীমিত সময়ের জন্য চালু রাখা হচ্ছে। কেননা এসব প্ল্যান্টের জন্য জ্বালানি তেলের সরবরাহ-ঘাটতি রয়েছে এবং উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কেবল তেলের সরবরাহ-ঘাটতির কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক হাজার ১০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। অপর দিকে চালু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে জ্বালানির চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, জরুরি ঘাটতি পূরণের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বেশি মনোযোগ দিলেও এর জন্য জ্বালানি সরবরাহ অবকাঠামো, আর্থিক দায় এবং তা সামাল দেওয়ার কৌশল যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এদিকে গ্রাহক ও চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এ কারণে উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে। অবধারিত হয়ে উঠছে লোডশেডিং। গরমের তীব্রতা বাড়লে জনজীবনে বিদ্যুৎহীন ঘণ্টাগুলো অসহনীয় হয়ে উঠছে।
গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় কম। সাধারণভাবে বিবেচনা করা হয় যে ফার্নেস তেল দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের চেয়ে কয়লা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় আড়াই গুণ কম। ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আমদানি করা জ্বালানি তেল ও কয়লা উভয়ই আমাদের জন্য বড় বোঝা। চাইলেও জ্বালানি আমদানির জন্য অফুরান বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আমরা পেতে পারি না। তা ছাড়া বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানির প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আমাদের নেই। আমদানি অবকাঠামো নির্মাণ সময়সাপেক্ষ এবং বিপুল বিনিয়োগনির্ভর। এ ছাড়া অনিশ্চিত বিশ্ববাজারের জ্বালানি কিনে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করা সহজ নয়। প্রাথমিক জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার শামিল। ধনাঢ্য দেশগুলোই জ্বালানি আমদানির ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্প্রতি তাঁর সরকারের সাফল্যের সূচক হিসেবে বলছেন আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎসের প্রাথমিক জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোকে।
ইতিমধ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা ও সরকারের নিয়োজিত পরামর্শকেরা দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়া ঘুরে দেখে এসেছেন কয়লা আমদানির ব্যয় ও চ্যালেঞ্জ। সময় এসেছে আমদানি করে আনা কয়লা এবং দেশের কয়লা তোলার বিষয়গুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা করার। আমাদের যে পরিমাণ ভালোমানের কয়লার মজুদ রয়েছে, তা যদি পরিকল্পিতভাবে উত্তোলন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়, তাহলে প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি-নির্ভরতা অনেকটা কমে আসবে। কিন্তু এ জন্য বিনিয়োগ ও কারিগরি দক্ষতা দুটোই প্রয়োজন। দেশে এককভাবে কয়লা উত্তোলন করার প্রযুক্তি, জনবল ও বিনিয়োগের সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা প্রয়োজন হবে। এ কাজ শুরু না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানীয় সামর্থ্য গড়ে উঠবে না। দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-ঘাটতি বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার কারণ হিসেবে অতীতের সিদ্ধান্তহীনতাকে যৌক্তিকভাবেই দায়ী করা হয়। এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পের বাইরে দৃশ্যমান তেমন কিছুর বাস্তবায়ন দেখছি না। বিশেষত আগামী দিনের বড় চাহিদার আলোকে বড় আয়োজনে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ এখনো শুরুই হয়নি। প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে অবিলম্বে দেশের কয়লা বড় পরিসরে লাভজনকভাবে উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যত দেরি হবে, দায় ও সংকট তত বাড়বে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী। জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, আমদানি করা তেলের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এবং উৎপাদিত বিদ্যুতের বিদ্যমান মূল্যের মধ্যে বিশাল পার্থক্য এখন আর তারা সরকারের দেওয়া ভর্তুকি দিয়ে মেটাতে পারছেন না। উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে সরকারের ঋণসহায়তা নেওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বারবার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য গ্রাহক পর্যায়ে ‘যৌক্তিকীকরণের’ চাপ বাড়ছে। সম্প্রতি সরকার আইএমএফের কাছে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য আনতে সহায়তার জন্য ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার সম্মতি পেয়েছে। এই ঋণ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য যৌক্তিকীকরণ। শর্ত অনুযায়ী, সরকার ২০১২ সালের মধ্যে দেশের বাজারে আমদানি করা জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে। তেল আমদানি ব্যয় অব্যাহতভাবে বেড়ে চলায় দেশের সীমিত সম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে এবং অর্থনীতির ভারসাম্যে শৃঙ্খলা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, আগামী অর্থবছরে আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে কয়লার সরবরাহ-ঘাটতি ও মূল্যও বাড়ছে। আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে যে কটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই জ্বালানি তেলনির্ভর। গ্যাসভিত্তিক পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হয় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের অভাবে বা যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতায় সীমিত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। অন্যদিকে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ গ্যাস পোড়াতে হয়, তা দিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনেক বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সে কারণে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে ঘাটতির গ্যাস অগ্রাধিকারের জায়গায় পাঠানোর চাপ আছে। সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৭টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ করতে চেয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পিত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই সময়মতো উৎপাদনে যেতে পারবে না। এর কোনোটির কার্যাদেশ দিতে বেশি সময় লেগেছে, কোনোটি কার্যাদেশ পেয়েও অর্থ সংস্থান করতে না পারায় কাজ শুরু করতে পারেনি। স্বল্পমেয়াদি ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যেগুলো চালু হয়েছে, সেগুলোও সীমিত সময়ের জন্য চালু রাখা হচ্ছে। কেননা এসব প্ল্যান্টের জন্য জ্বালানি তেলের সরবরাহ-ঘাটতি রয়েছে এবং উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কেবল তেলের সরবরাহ-ঘাটতির কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক হাজার ১০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। অপর দিকে চালু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে জ্বালানির চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, জরুরি ঘাটতি পূরণের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বেশি মনোযোগ দিলেও এর জন্য জ্বালানি সরবরাহ অবকাঠামো, আর্থিক দায় এবং তা সামাল দেওয়ার কৌশল যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এদিকে গ্রাহক ও চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এ কারণে উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে। অবধারিত হয়ে উঠছে লোডশেডিং। গরমের তীব্রতা বাড়লে জনজীবনে বিদ্যুৎহীন ঘণ্টাগুলো অসহনীয় হয়ে উঠছে।
গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় কম। সাধারণভাবে বিবেচনা করা হয় যে ফার্নেস তেল দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের চেয়ে কয়লা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় আড়াই গুণ কম। ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আমদানি করা জ্বালানি তেল ও কয়লা উভয়ই আমাদের জন্য বড় বোঝা। চাইলেও জ্বালানি আমদানির জন্য অফুরান বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আমরা পেতে পারি না। তা ছাড়া বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানির প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আমাদের নেই। আমদানি অবকাঠামো নির্মাণ সময়সাপেক্ষ এবং বিপুল বিনিয়োগনির্ভর। এ ছাড়া অনিশ্চিত বিশ্ববাজারের জ্বালানি কিনে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করা সহজ নয়। প্রাথমিক জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার শামিল। ধনাঢ্য দেশগুলোই জ্বালানি আমদানির ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্প্রতি তাঁর সরকারের সাফল্যের সূচক হিসেবে বলছেন আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎসের প্রাথমিক জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোকে।
ইতিমধ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা ও সরকারের নিয়োজিত পরামর্শকেরা দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়া ঘুরে দেখে এসেছেন কয়লা আমদানির ব্যয় ও চ্যালেঞ্জ। সময় এসেছে আমদানি করে আনা কয়লা এবং দেশের কয়লা তোলার বিষয়গুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা করার। আমাদের যে পরিমাণ ভালোমানের কয়লার মজুদ রয়েছে, তা যদি পরিকল্পিতভাবে উত্তোলন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়, তাহলে প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি-নির্ভরতা অনেকটা কমে আসবে। কিন্তু এ জন্য বিনিয়োগ ও কারিগরি দক্ষতা দুটোই প্রয়োজন। দেশে এককভাবে কয়লা উত্তোলন করার প্রযুক্তি, জনবল ও বিনিয়োগের সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা প্রয়োজন হবে। এ কাজ শুরু না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানীয় সামর্থ্য গড়ে উঠবে না। দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-ঘাটতি বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার কারণ হিসেবে অতীতের সিদ্ধান্তহীনতাকে যৌক্তিকভাবেই দায়ী করা হয়। এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পের বাইরে দৃশ্যমান তেমন কিছুর বাস্তবায়ন দেখছি না। বিশেষত আগামী দিনের বড় চাহিদার আলোকে বড় আয়োজনে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ এখনো শুরুই হয়নি। প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে অবিলম্বে দেশের কয়লা বড় পরিসরে লাভজনকভাবে উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যত দেরি হবে, দায় ও সংকট তত বাড়বে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী। জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments