শ্রদ্ধাঞ্জলি-স্যামসন এইচ চৌধুরীড. by ড. এম শাহ আলম

আমার ৩০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবনের পুরোটাই কেটেছে প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিন্দ্য সুন্দর ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায়। আড়াই বছর থেকে এই প্রথম আমি সপরিবারে ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছি এবং প্রেষণে আইন কমিশনে কর্মরত। আমার ভাড়া বাসায় থাকার অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুনেছি মালিক-ভাড়াটে সম্পর্ক সব সময় মধুর থাকে না।


আমার এক চাচার মাধ্যমে যখন মগবাজারের সেঞ্চুরি এস্টেটে আমার একটি বাসা ভাড়ার বন্দোবস্ত হয়, তখনো আমি জানতাম না এটি স্কয়ার গ্রুপের কর্ণধার স্যামসন এইচ চৌধুরীর মেয়ের বাসা। সুন্দর ছিমছাম প্রায় দুই হাজার বর্গফুটের বাসা। চুক্তি সই হওয়ার সময় তাঁদের পরিচয় পাই। তাঁদের সঙ্গে কখনোই আমার সাক্ষাৎ হয়নি। সব কিছুই তাঁদের গ্রুপের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে সাধিত হয়েছে। বাসায় থাকার কয়েক দিন পর আমারই উদ্যোগে টেলিফোনে কথা হয় চৌধুরী সাহেবের মেয়ের জামাই চার্লস সি আর পাত্রের সঙ্গে, যিনি স্কয়ার গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। খুবই অমায়িক ভদ্রলোক। আমরা একে অপরকে নিমন্ত্রণ জানালাম। আমি একটু অনুযোগের সুরেই বললাম, আপনাদের বাসায় কে উঠল একটু দেখে যাবেন না। তিনি সুন্দরভাবে বললেন, অবশ্যই। এরপর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। সব যোগাযোগ এবং প্রয়োজনীয় কাজ হতো এবং এখনো হয় তাঁদের প্রতিনিধির মাধ্যমে। গত আড়াই বছর ভাড়াটে হিসেবে বাসার মালিক সম্পর্কে আমার ধারণা একেবারেই পাল্টে গেছে। ছোটখাটো দু-একটা সমস্যার কথা জানালে সঙ্গে সঙ্গেই মালিকপক্ষ লোক পাঠিয়ে ঠিক করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিনিধির মাধ্যমে খবর নেন আমাদের কোনো সমস্যা আছে কি না। লজ্জা পাই এবং ছোটখাটো সমস্যা বাড়িওয়ালাকে না বলে নিজেই ঠিক করে নিই। আমি জানতাম না সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী তখন সংকটাপন্ন অবস্থায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত। ওই সময় স্বভাবতই পরিবারের সব সদস্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। এ সময় আমার গরম পানির জন্য গিজারটি নষ্ট হয়ে যায়, যা বাড়িওয়ালাকেই ঠিক করে দিতে হবে বলে এস্টেট কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়। ফোন করলাম, প্রতিনিধি শুধু আমাকে জানালেন যে স্যারকে বলতে হবে, কিন্তু তাঁদের পরিবারের একটু সমস্যা আছে, দুয়েক দিন সময় লাগতে পারে। অবাক কাণ্ড, পরের দিনই মিস্ত্রি এসে হাজির। ঠিক করে দিয়ে গেল। যদিও স্যামসন এইচ চৌধুরী সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই আগে শুনেছি, কিন্তু বাড়িওয়ালা হিসেবে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে তাঁরা যে ব্যক্তি বা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করেন তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে ইচ্ছে করেছে এবং জেনেছিও। আমার বিশ্বাস, দেশবাসী সেটা জানে এবং যাঁরা জানতেন না অবশ্যই তাঁর প্রয়াণের পর তা জেনেছেন। কোনো দেশে কোনো শিল্পপতির প্রয়াণে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দুজনই শোকবাণী প্রেরণ করেন, তা বিরল ঘটনা। আমি গিয়েছিলাম কাকরাইলের খ্রিস্টান চার্চে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। প্রায় রাত-দুপুরেও যেন পুরো ঢাকা সেখানে ভেঙে পড়েছে। ধর্ম-বর্ণ-পেশা-শ্রেণী নির্বিশেষে সবাই এসেছেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এরপর গ্রামের বাড়ি পাবনায় যখন তাঁর সর্বশেষ কৃত্য অনুষ্ঠিত হয় হাজারো মানুষের ঢল নামে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্যামসন এইচ চৌধুরীর অবদানের কথা বাদই দিলাম। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি, দানশীলতা, সততা এবং শৃঙ্খলা সবার জন্য বিশেষ করে অন্যান্য শিল্পপতির জন্য হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
ড. এম শাহ আলম

No comments

Powered by Blogger.