প্রণব মুখার্জির ঝুলিতে কী আছে?-সমকালীন প্রসঙ্গ by আশফাকুর রহমান
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিলি্ল সফরের পর দুই বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এর ফিরতি সফরে মনমোহন সিং ঢাকা এসেছিলেন। আপাতত শেখ হাসিনার দিলি্ল যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সেটা সঙ্গতও হবে না। এর পটভূমি নতুন করে তৈরির প্রয়োজন রয়েছে।
যৌথ নদী কমিশন, সীমান্ত সংক্রান্ত কমিটি, ট্রানজিট কমিটি, বাণিজ্য কমিটি প্রভৃতি যেসব ফোরাম রয়েছে সেগুলো পুরোদমে কাজ করে তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের পর 'পরবর্তী শীর্ষ বৈঠকটি কবে হবে?' শিরোনামে সমকালে লিখেছিলাম :'এক যুগ পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় সফর কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারেনি। আমি সফরকে ব্যর্থ বলব না, তবে উভয় পক্ষের হতাশা যে চরমে তাতে সন্দেহ নেই।'
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে অনেক কিছু মিলবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু মনমোহন সিংয়ের ঝুলি খুলে দেখা গেল, তাতে তেমন কিছু আসলে ছিলই না। সংবাদপত্রে দেখেছি, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এই ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা আসছেন। একটি সংবাদপত্র এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে শিরোনাম দিয়েছে :'সম্পর্কে গতি আনতে আসছেন প্রণব'। একটি মহলের আশাবাদ : বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি ও প্রটোকলের বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি পূরণে ভারত বদ্ধপরিকর। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে দিলি্লর আন্তরিকতার কথাও ফের জানাবেন তিনি।
আন্তর্জাতিক কূটনীতির খবরাখবর যারা রাখেন অনেকেই হয়তো বলবেন, কেবল সদিচ্ছা ব্যক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সফরের আয়োজন কম ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। কূটনৈতিক বার্তা পাঠাতে এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক। দিলি্লর তা জানা আছে। প্রণব মুখার্জি ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ। তার প্রভাব অনেক। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর তিনি আস্থাভাজন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দিলি্লতে তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের গার্ডিয়ান অ্যান্ড ফ্রেন্ড। মাত্র পাঁচ মাস আগে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় তিনি ঢাকা আসেননি। প্রত্যাশায় জল ঢেলে দেওয়া ওই সফরের মাত্র একদিন আগে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফরসঙ্গী তো হচ্ছেনই না, এমনকি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতেও তার ঘোরতর আপত্তি। সফরের পর দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলেছে, তিন মাসের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হবে। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের তরফে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল বলে মনে হয় না। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা ত্যাগ করার আগেই দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল, পানি বণ্টন হবে 'ফেয়ার অ্যান্ড ইক্যুইটেবল বেসিসে'। এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অধিকর্তার অঙ্গীকার। তাদের বিভিন্ন রাজ্য কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো দফতরকে এ বিষয়ে ঐকমত্যে আনার দায় সম্পূর্ণই তাদের। এরপর চুক্তি সম্পাদনে কোনো বাধা থাকার কথা ছিল না। দুই দেশের পানিসম্পদ দফতরের মন্ত্রীরাই এ কাজটি করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। প্রণব মুখার্জি কি এ বিষয়ে কেবল ব্যাখ্যা দিতে ঢাকায় আসবেন, নাকি কোনো কার্যকর ফর্মুলা নিয়ে আসবেন? সম্প্রতি তিনি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলেছেন বিভিন্ন ইস্যুতে। তিস্তা ইস্যু এতে ছিল কি-না, সেটা জানা নেই। এ নদীর পানি বণ্টনের ইস্যুতে ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠান এবং সম্মতি আদায় তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একই কথা বলা চলে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বিষয়ে। গত কয়েক মাসে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গীকার পূরণে কার্যকর অগ্রগতি হয়েছে কি-না সেটা প্রণব মুখার্জিই বলতে পারবেন। তবে লক্ষণীয় কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না। বরং এই সময় আমরা লক্ষ্য করলাম নতুন করে টিপাইমুখ ইস্যুটি সামনে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে সর্বত্র এ ইস্যুতে উদ্বেগ রয়েছে। সিলেট অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ ব্যক্ত হচ্ছে নানাভাবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও এ ইস্যুটি গুরুত্ব পাচ্ছে। দিলি্ল নিশ্চয়ই তার খবর রাখে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিলি্ল সফরের পর দুই বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এর ফিরতি সফরে মনমোহন সিং ঢাকা এসেছিলেন। আপাতত শেখ হাসিনার দিলি্ল যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সেটা সঙ্গতও হবে না। এর পটভূমি নতুন করে তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। যৌথ নদী কমিশন, সীমান্ত সংক্রান্ত কমিটি, ট্রানজিট কমিটি, বাণিজ্য কমিটি প্রভৃতি যেসব ফোরাম রয়েছে সেগুলো পুরোদমে কাজ করে তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। শেখ হাসিনা সম্প্রতি ত্রিপুরা সফর করেছেন। তার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি বড় দল ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছিল সন্তোষজনক। আমি মনে করি, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও আলোচনা চলতে পারে। বাংলাদেশ কেবল দিলি্লর সঙ্গে কথা বলবে, এমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সব সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তাকে ঢাকা সফরের জন্য বিশেষ আমন্ত্রণও জানাতে পারি। তিনি একবার আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হননি, সে কারণে চিরকাল মুখ ফিরিয়ে রাখা কূটনীতির দর্শনে পড়ে না।
ভারত ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা ঘোষণা করেছে। তা কাজে লাগানোর পথে অশুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) কী আসবে, সেটা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এ বিষয়ে গতি আনায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখার্জি ভূমিকা রাখতে পারবেন। অভিন্ন নদনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান, সীমান্তে বিএসএফের অবন্ধুসুলভ কার্যকলাপ বন্ধ, ছিটমহল বিনিময়_ এসব ইস্যুতে সমঝোতার বাস্তবায়ন একান্তই ভারতের দায়। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি না হওয়ায় ভারতীয় নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমাদের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে বলেছিলেন, দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে। কিন্তু চুক্তিই হয়নি। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, তিন মাসের মধ্যে চুক্তি হবে। কিন্তু হলো না। এখন প্রণব মুখার্জি আসছেন আমাদের অর্থমন্ত্রীর আমন্ত্রণে। তারা দু'জনে গত জানুয়ারি মাসে যশোর সীমান্তের পেট্রাপোল স্থলবন্দরে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তারা অনুষ্ঠানসূচির বাইরেও কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। দুই দেশের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে প্রণব মুখার্জি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন যে, দুই প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে যেসব ইস্যুতে চুক্তি ও সহমত হয়েছে তার বাস্তবায়নই হচ্ছে সম্পর্কে গতি আনার ভিত্তি। এ ক্ষেত্রে বাধা আসছে ভারতেরই একটি রাজ্য থেকে। পরিণতিতে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। এটা কীভাবে দূর করা হবে, সেটা নিশ্চয়ই ভারতের অর্থমন্ত্রী জানাবেন। তিনি যদি নিছক বাংলাদেশের হতাশা-যন্ত্রণায় সান্ত্বনা দিতে সচেষ্ট থাকেন এবং কার্যকর কিছু অগ্রগতির দিকনির্দেশনা তুলে না ধরেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারত এক পরীক্ষিত বন্ধু হারাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে। সাধারণ নির্বাচন বেশি দূরে নয় এবং বরাবরের মতো এতেও ভারত-ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশও ভারতকে আস্থায় নিতে দ্বিধা করবে। আমাদের এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় দেশ হিসেবে ভারতের ভূমিকার কথা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু সে ভূমিকা আমরা দেখছি না। ভারতের গণমাধ্যমও কিন্তু এ বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছে। ঢাকায় আমরা যা বলছি, তার প্রতিধ্বনি দেখছি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আনন্দবাজার ও দি হিন্দুর সম্পাদকীয় কলামে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে : 'বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিতে মমতা ব্যানার্জি রাজি না হওয়ায় ভারত চমৎকার একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে। শেখ হাসিনার জন্য নয়, ভারতের স্বার্থেও ওই চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। এতে করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে খুব সহজে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করার বিষয়ে একটি সমঝোতায় পেঁৗছানো যেত।' দি হিন্দু পত্রিকা সীমান্তে একজন বাংলাদেশির ওপর নির্যাতন ও অভব্য আচরণ্যের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ভারত সরকার নিশ্চয়ই এসব বক্তব্যের প্রতি অধিক মনোযোগ দেবে। সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টিতে সংকীর্ণতার অবসান ঘটানোর প্রয়োজন রয়েছে এবং প্রণব মুখার্জির আসন্ন সফরে এ বিষয়ে কেবল কথা নয়, কাজও আমরা দেখতে চাই। তারা কোন কাজটি কতদিনে সম্পাদন করবে, সে বিষয়েও থাকা চাই সুনির্দিষ্ট সময়সূচি। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের তরফে সমস্যা থাকতে পারে, আদালতের প্রসঙ্গ উঠতে পারে, সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথাও তোলা হতে পারে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়নে তা দূর করার সম্পূর্ণ দায় তাদের এবং এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমি সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রসঙ্গেও বলতে চাই। এর পুনর্গঠনের তাগিদ অনেক দিনের। কেবল ব্যক্তি বদলের মধ্যে নয়, সমাধান নিহিত রয়েছে নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের মধ্যে। আমাদের কাছেই রয়েছে ভারত ও চীনের মতো দুটি জনবহুল দেশ, যাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে এবং তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে উন্নত করা যায় এবং আমাদের প্রয়োজন মেটাতে বেইজিং-দিলি্ল কী করতে পারে তার রূপরেখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই তুলে ধরতে হবে। ভারতের সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, দর কষাকষি করার মতো দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ইস্যুতে বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় সমঝোতাও কিন্তু এ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।
আশফাকুর রহমান : সাবেক রাষ্ট্রদূত
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের পর 'পরবর্তী শীর্ষ বৈঠকটি কবে হবে?' শিরোনামে সমকালে লিখেছিলাম :'এক যুগ পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় সফর কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারেনি। আমি সফরকে ব্যর্থ বলব না, তবে উভয় পক্ষের হতাশা যে চরমে তাতে সন্দেহ নেই।'
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে অনেক কিছু মিলবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু মনমোহন সিংয়ের ঝুলি খুলে দেখা গেল, তাতে তেমন কিছু আসলে ছিলই না। সংবাদপত্রে দেখেছি, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এই ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা আসছেন। একটি সংবাদপত্র এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে শিরোনাম দিয়েছে :'সম্পর্কে গতি আনতে আসছেন প্রণব'। একটি মহলের আশাবাদ : বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি ও প্রটোকলের বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি পূরণে ভারত বদ্ধপরিকর। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে দিলি্লর আন্তরিকতার কথাও ফের জানাবেন তিনি।
আন্তর্জাতিক কূটনীতির খবরাখবর যারা রাখেন অনেকেই হয়তো বলবেন, কেবল সদিচ্ছা ব্যক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সফরের আয়োজন কম ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। কূটনৈতিক বার্তা পাঠাতে এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক। দিলি্লর তা জানা আছে। প্রণব মুখার্জি ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ। তার প্রভাব অনেক। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর তিনি আস্থাভাজন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দিলি্লতে তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের গার্ডিয়ান অ্যান্ড ফ্রেন্ড। মাত্র পাঁচ মাস আগে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় তিনি ঢাকা আসেননি। প্রত্যাশায় জল ঢেলে দেওয়া ওই সফরের মাত্র একদিন আগে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফরসঙ্গী তো হচ্ছেনই না, এমনকি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতেও তার ঘোরতর আপত্তি। সফরের পর দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলেছে, তিন মাসের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হবে। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের তরফে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল বলে মনে হয় না। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা ত্যাগ করার আগেই দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল, পানি বণ্টন হবে 'ফেয়ার অ্যান্ড ইক্যুইটেবল বেসিসে'। এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অধিকর্তার অঙ্গীকার। তাদের বিভিন্ন রাজ্য কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো দফতরকে এ বিষয়ে ঐকমত্যে আনার দায় সম্পূর্ণই তাদের। এরপর চুক্তি সম্পাদনে কোনো বাধা থাকার কথা ছিল না। দুই দেশের পানিসম্পদ দফতরের মন্ত্রীরাই এ কাজটি করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। প্রণব মুখার্জি কি এ বিষয়ে কেবল ব্যাখ্যা দিতে ঢাকায় আসবেন, নাকি কোনো কার্যকর ফর্মুলা নিয়ে আসবেন? সম্প্রতি তিনি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলেছেন বিভিন্ন ইস্যুতে। তিস্তা ইস্যু এতে ছিল কি-না, সেটা জানা নেই। এ নদীর পানি বণ্টনের ইস্যুতে ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠান এবং সম্মতি আদায় তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একই কথা বলা চলে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বিষয়ে। গত কয়েক মাসে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গীকার পূরণে কার্যকর অগ্রগতি হয়েছে কি-না সেটা প্রণব মুখার্জিই বলতে পারবেন। তবে লক্ষণীয় কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না। বরং এই সময় আমরা লক্ষ্য করলাম নতুন করে টিপাইমুখ ইস্যুটি সামনে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে সর্বত্র এ ইস্যুতে উদ্বেগ রয়েছে। সিলেট অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ ব্যক্ত হচ্ছে নানাভাবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও এ ইস্যুটি গুরুত্ব পাচ্ছে। দিলি্ল নিশ্চয়ই তার খবর রাখে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিলি্ল সফরের পর দুই বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এর ফিরতি সফরে মনমোহন সিং ঢাকা এসেছিলেন। আপাতত শেখ হাসিনার দিলি্ল যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সেটা সঙ্গতও হবে না। এর পটভূমি নতুন করে তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। যৌথ নদী কমিশন, সীমান্ত সংক্রান্ত কমিটি, ট্রানজিট কমিটি, বাণিজ্য কমিটি প্রভৃতি যেসব ফোরাম রয়েছে সেগুলো পুরোদমে কাজ করে তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। শেখ হাসিনা সম্প্রতি ত্রিপুরা সফর করেছেন। তার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি বড় দল ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছিল সন্তোষজনক। আমি মনে করি, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও আলোচনা চলতে পারে। বাংলাদেশ কেবল দিলি্লর সঙ্গে কথা বলবে, এমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সব সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তাকে ঢাকা সফরের জন্য বিশেষ আমন্ত্রণও জানাতে পারি। তিনি একবার আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হননি, সে কারণে চিরকাল মুখ ফিরিয়ে রাখা কূটনীতির দর্শনে পড়ে না।
ভারত ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা ঘোষণা করেছে। তা কাজে লাগানোর পথে অশুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) কী আসবে, সেটা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এ বিষয়ে গতি আনায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখার্জি ভূমিকা রাখতে পারবেন। অভিন্ন নদনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান, সীমান্তে বিএসএফের অবন্ধুসুলভ কার্যকলাপ বন্ধ, ছিটমহল বিনিময়_ এসব ইস্যুতে সমঝোতার বাস্তবায়ন একান্তই ভারতের দায়। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি না হওয়ায় ভারতীয় নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমাদের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে বলেছিলেন, দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে। কিন্তু চুক্তিই হয়নি। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, তিন মাসের মধ্যে চুক্তি হবে। কিন্তু হলো না। এখন প্রণব মুখার্জি আসছেন আমাদের অর্থমন্ত্রীর আমন্ত্রণে। তারা দু'জনে গত জানুয়ারি মাসে যশোর সীমান্তের পেট্রাপোল স্থলবন্দরে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তারা অনুষ্ঠানসূচির বাইরেও কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। দুই দেশের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে প্রণব মুখার্জি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন যে, দুই প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে যেসব ইস্যুতে চুক্তি ও সহমত হয়েছে তার বাস্তবায়নই হচ্ছে সম্পর্কে গতি আনার ভিত্তি। এ ক্ষেত্রে বাধা আসছে ভারতেরই একটি রাজ্য থেকে। পরিণতিতে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। এটা কীভাবে দূর করা হবে, সেটা নিশ্চয়ই ভারতের অর্থমন্ত্রী জানাবেন। তিনি যদি নিছক বাংলাদেশের হতাশা-যন্ত্রণায় সান্ত্বনা দিতে সচেষ্ট থাকেন এবং কার্যকর কিছু অগ্রগতির দিকনির্দেশনা তুলে না ধরেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারত এক পরীক্ষিত বন্ধু হারাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে। সাধারণ নির্বাচন বেশি দূরে নয় এবং বরাবরের মতো এতেও ভারত-ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশও ভারতকে আস্থায় নিতে দ্বিধা করবে। আমাদের এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় দেশ হিসেবে ভারতের ভূমিকার কথা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু সে ভূমিকা আমরা দেখছি না। ভারতের গণমাধ্যমও কিন্তু এ বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছে। ঢাকায় আমরা যা বলছি, তার প্রতিধ্বনি দেখছি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আনন্দবাজার ও দি হিন্দুর সম্পাদকীয় কলামে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে : 'বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিতে মমতা ব্যানার্জি রাজি না হওয়ায় ভারত চমৎকার একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে। শেখ হাসিনার জন্য নয়, ভারতের স্বার্থেও ওই চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। এতে করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে খুব সহজে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করার বিষয়ে একটি সমঝোতায় পেঁৗছানো যেত।' দি হিন্দু পত্রিকা সীমান্তে একজন বাংলাদেশির ওপর নির্যাতন ও অভব্য আচরণ্যের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ভারত সরকার নিশ্চয়ই এসব বক্তব্যের প্রতি অধিক মনোযোগ দেবে। সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টিতে সংকীর্ণতার অবসান ঘটানোর প্রয়োজন রয়েছে এবং প্রণব মুখার্জির আসন্ন সফরে এ বিষয়ে কেবল কথা নয়, কাজও আমরা দেখতে চাই। তারা কোন কাজটি কতদিনে সম্পাদন করবে, সে বিষয়েও থাকা চাই সুনির্দিষ্ট সময়সূচি। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের তরফে সমস্যা থাকতে পারে, আদালতের প্রসঙ্গ উঠতে পারে, সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথাও তোলা হতে পারে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়নে তা দূর করার সম্পূর্ণ দায় তাদের এবং এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমি সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রসঙ্গেও বলতে চাই। এর পুনর্গঠনের তাগিদ অনেক দিনের। কেবল ব্যক্তি বদলের মধ্যে নয়, সমাধান নিহিত রয়েছে নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের মধ্যে। আমাদের কাছেই রয়েছে ভারত ও চীনের মতো দুটি জনবহুল দেশ, যাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে এবং তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে উন্নত করা যায় এবং আমাদের প্রয়োজন মেটাতে বেইজিং-দিলি্ল কী করতে পারে তার রূপরেখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই তুলে ধরতে হবে। ভারতের সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, দর কষাকষি করার মতো দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ইস্যুতে বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় সমঝোতাও কিন্তু এ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।
আশফাকুর রহমান : সাবেক রাষ্ট্রদূত
No comments