চারদিক-একদিন সীমান্ত শহরে
হোটেল-বাজারজুড়ে ভোরের অলসতা। বাসের কাউন্টার ছাড়া কোথাও কেউ নেই। জবুথবু একটা চায়ের দোকানে কোনোমতে চুলা জ্বলছে মাত্র। দৌড়ে গিয়ে দুধচায়ের কথা বললাম, ‘লিকার বেশি দিয়ে এক কাপ বানান। আগে এক গ্লাস পানি দিয়েন।’
মুখে ‘হবে’ বলেই খলানি দিয়ে কচলে কচলে গ্লাস পরিষ্কার করলেন দোকানি। ধীরেসুস্থে গ্লাস ভরে সামনে ধরলেন, ‘ভাই, নেন।’ ব্যবহার দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার দোকান দেখে তো মনে হচ্ছে, হাজার টাকার মালও নেই; সংসার চালাতে পারেন!’
এ রকম ব্যক্তিগত প্রশ্নে রাগের পরিবর্তে উল্টো টুল টানলেন তিনি। বললেন, ‘ভাই, বসেন না ক্যানে, বসেন।’
বসার পর বলতে শুরু করলেন, ‘শোনেন ভাই, আগে তো মেকারি কত্তাম, সাইকেলের। তো, একদিন কাজ কত্তে গিয়ে আঙুলে হাতুড়ির চোট পড়ে গেল। সেদিনই বুঝলাম, আমার দ্বারা আর হবে নাকো। তা ছাড়া বলে (শক্তি) তেমন পাল্লাম না। তাই ও-কাজ ফেলে চায়ের দোকান দিলাম। এখন দু-তিন শ হয়, চালানের মালিক ওই একজন আল্লাহতালা।’
শান্তিপুরি ভাষায় গাফফারের এহেন বয়ান শুনে পুলকিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার লেখাপড়া কত দূর?’ প্রশ্ন শুনে চিন্তিত হলেন না; বরং লাজুক হাসলেন, ‘লিখাপড়াটা কত্তি পারি নাই, কোনোমতে নাম সইডা কত্তি পারি।’ চা-ওয়ালার মুখে এ রকম উত্তর আশা করিনি। ভালো করে কথা বলতে পারাটা লেখাপড়ার চেয়ে কম কিসে! দাম মিটিয়ে ভ্রমণের কথা বললাম। অগত্যা সময় নিয়ে পথ বাতলালেন তিনি—‘কী তেমন দ্যাকপেন, তয় মুজিবনগরে যেতি পারেন। আমঝুপিতেও যেইতি পারেন। একন তো বাস-গাড়ি কিছু পাবেন নাকো, তবে আলগামনে যেইতি পারেন।’
নছিমন-করিমনের নাম শুনেছি, কিন্তু আলগামন মানে! গাফফার হেসে উঠলেন, ‘এখানে চার রকমের ভটভটি আছে—আলমসাধু, নছিমন, করিমন আর আলগামন। মালটানা খোলা গাড়ির নাম আলমসাধু। ছইওয়ালা ভ্যানমতোন হলো করিমন। আর ছই ছাড়া আলগা করিমনগুলানই আলগামন।’
মেহেরপুরকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। পাঁজরে সীমান্ত নিয়ে এক লাইনের ছোট্ট শহর। করিমনে উঠে বসলাম। টালমাটাল রোদ-হাওয়ায় ছুটতে ছুটতে নীলকুঠি। বারান্দা-বরাবর ঘাট। একসময় বিহার, ওডিশার বজরা এসে ভিড়ত কুঠির দোরগোড়ায়। সদর দরজা খুললেই জলসাখানা। ঘুঙুরের ছমছম শব্দ উঠত এখানে আর ফায়ার প্লেসের আঁচ এসে গরম করত নায়েব সাহেবের শরীর। রংমহল ছেড়ে গোলাকারে বৃদ্ধ বৈঠকখানা। লাগোয়া খাসকামরায় বাঁধানো মেঝে। আড়াই শ বছর আগে কেমন করে জাম্বো সাইজের জলপাই পাথরগুলো ইংরেজরা কুঠিতে এনেছিল, ভাবাই যাচ্ছে না। মলিনতা নেই, বরং সুমসৃণ আর এমন চকচকে যে সাপ পর্যন্ত ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলতে পারে না। ফটকের সাদা পাথরে লেখা আছে নীল বেদনার ইতিহাস। জনশ্রুতি আছে, কুঠিতেই নাকি ক্লাইভ-ঘসেটিরা নবাবকে মারার নকশা এঁকেছিল। এখান থেকেই চাবুক হাতে সাহেবরা ঘোড়া ছোটাত। ঘোড়া থেকেই চাবুক কষাত বাংলার কৃষকের গায়ে। মরা কাজলা ধরে থরে থরে নীলগাছগুলোর দিকে একনাগাড়ে চেয়ে থাকি। পূর্বপুরুষের রক্তছোপ আর ষড়যন্ত্রের নীল পদাবলি যেন ছবি হয়ে যায়।
মুজিবনগর যাব বলে জল-জংলার মায়া থেকে শ্যামলা চোখজোড়া সরিয়ে যাত্রীবাহী বাসে উঠে পড়ি। দুই পাশে সবুজ খিলান করা উজাড়-পথ। পিচের কিনারে ধুয়ে ধুয়ে ঝাঁকা ভর্তি হচ্ছে শান্ত-স্বভাবী মুখিকচু। এমন ভালো জাত আর নেই। জাইলিক এসিড নগণ্য বলে গলা ধরে না। আরও দক্ষিণে ছুটে চলে মুজিবনগরমুখো বাস। পথের পাশেই ভৈরব। তলপেটে কোমরজল নিয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণের কাঁটাতার ছুঁয়ে ভারতে ঢুকে গেছে। পাড়ের বারান্দা কেটে খাঁজে খাঁজে শসার রসালো আবাদ করে রেখেছেন দারিয়াপুরের কৃষকেরা। ফসলি জমি ছেড়ে মোনখালির হাঁসের ময়দান। চুপে চুপে চলে আসে কেদারগঞ্জ। ঝুপড়িবাজার ফেলে আম্রকানন। এক ধাক্কায় একাত্তরের ১৭ এপ্রিল। শপথভূমি। মুজিবনগর। ভবেরপাড়ার যে ১২ জন আনসার অস্থায়ী সরকারকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন, তাঁদের দু-পাঁচজন এখনো বেঁচে আছেন। আনসার লিয়াকত শপথের গল্প বলেন। মঞ্চ কারিগর সুভাষের মুখের দিকে চেয়ে থেকে মায়া হয়। ১৭ এপ্রিল থেকে আজ অবধি সৌধ আঁকড়ে পড়ে আছেন। পর্যটকদের বিনে পয়সায় চোখে দেখা ইতিহাস বর্ণনা করেন তিনি। ক্ষুদ্রতম জনপদের বৃহত্তম গল্প। বাংলাদেশের উদ্বোধনী ভূমিতে দাঁড়িয়ে চারদিক চেয়ে দেখি। সুমিষ্ট আম, বলবান গবাদি, প্রাচুর্যময় আবাদ, পর্যাপ্ত গাছগাছালি আর নদী-নেওটা গ্রামবসতি অদ্ভুত এক ছায়া এনে দিয়েছে মুজিবনগরকে।
স্মৃতিকেন্দ্র দেখতে গেলাম। একটানে এত বড় বাংলাদেশ আর কোথাও নেই। সিমেন্টের শিল্পে বানানো বাংলাদেশ। জেলায় জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-বঙ্গোপসাগর। বয়ে বয়ে সীমান্ত। কাঁটাতার, করিডর, কালো বিএসএফ। সাজানো আছে ভাস্কর্য দল। থিমেটিক ভাস্কর্যগুলো দেখতে গিয়ে সূর্য তেতে ওঠে। আম্রকাননের ছায়াতলে ফেরত আসি ফেরার জন্য। পিকনিক পার্টির লোকজন খাবার পাতে করে ঘাসেই ল্যাটা দিয়েছে। উটকো পর্যটকের জন্য খাবারের ভালো হোটেল নেই এখানে। মাঝারি খাবার পেতে হলে জেলা শহর ছাড়া গতি নেই। হুট করে বাস পাওয়া যাবে না। আলমসাধুতে করে কেদারগঞ্জ পৌঁছে তবে লোকাল বাস ধরতে হবে। মাথাপ্রতি দুই টাকা ভাড়ায় এত আরামসে ভ্রমণ আর হয় না! শ্যালোমেশিন কায়দা করে তলায় সেট করা হয়েছে। চালককে ড্রাইভার না বলাই ভালো। নেহাত আবালজন। মালকোঁচা মেরে দুই হাতে ত্যাড়াব্যাড়া করে চালাচ্ছে। দুই পাশের দৃশ্যগুলো ফালা ফালা করে আমরা ফের উত্তরে যেতে থাকি। ওপারের হাওয়া এসে আঁছড়ে পড়ছে বাংলাদেশের পাথারে। আর ফটফট শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে আমাদের ভটভটি।
আজাদুর রহমান
এ রকম ব্যক্তিগত প্রশ্নে রাগের পরিবর্তে উল্টো টুল টানলেন তিনি। বললেন, ‘ভাই, বসেন না ক্যানে, বসেন।’
বসার পর বলতে শুরু করলেন, ‘শোনেন ভাই, আগে তো মেকারি কত্তাম, সাইকেলের। তো, একদিন কাজ কত্তে গিয়ে আঙুলে হাতুড়ির চোট পড়ে গেল। সেদিনই বুঝলাম, আমার দ্বারা আর হবে নাকো। তা ছাড়া বলে (শক্তি) তেমন পাল্লাম না। তাই ও-কাজ ফেলে চায়ের দোকান দিলাম। এখন দু-তিন শ হয়, চালানের মালিক ওই একজন আল্লাহতালা।’
শান্তিপুরি ভাষায় গাফফারের এহেন বয়ান শুনে পুলকিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার লেখাপড়া কত দূর?’ প্রশ্ন শুনে চিন্তিত হলেন না; বরং লাজুক হাসলেন, ‘লিখাপড়াটা কত্তি পারি নাই, কোনোমতে নাম সইডা কত্তি পারি।’ চা-ওয়ালার মুখে এ রকম উত্তর আশা করিনি। ভালো করে কথা বলতে পারাটা লেখাপড়ার চেয়ে কম কিসে! দাম মিটিয়ে ভ্রমণের কথা বললাম। অগত্যা সময় নিয়ে পথ বাতলালেন তিনি—‘কী তেমন দ্যাকপেন, তয় মুজিবনগরে যেতি পারেন। আমঝুপিতেও যেইতি পারেন। একন তো বাস-গাড়ি কিছু পাবেন নাকো, তবে আলগামনে যেইতি পারেন।’
নছিমন-করিমনের নাম শুনেছি, কিন্তু আলগামন মানে! গাফফার হেসে উঠলেন, ‘এখানে চার রকমের ভটভটি আছে—আলমসাধু, নছিমন, করিমন আর আলগামন। মালটানা খোলা গাড়ির নাম আলমসাধু। ছইওয়ালা ভ্যানমতোন হলো করিমন। আর ছই ছাড়া আলগা করিমনগুলানই আলগামন।’
মেহেরপুরকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। পাঁজরে সীমান্ত নিয়ে এক লাইনের ছোট্ট শহর। করিমনে উঠে বসলাম। টালমাটাল রোদ-হাওয়ায় ছুটতে ছুটতে নীলকুঠি। বারান্দা-বরাবর ঘাট। একসময় বিহার, ওডিশার বজরা এসে ভিড়ত কুঠির দোরগোড়ায়। সদর দরজা খুললেই জলসাখানা। ঘুঙুরের ছমছম শব্দ উঠত এখানে আর ফায়ার প্লেসের আঁচ এসে গরম করত নায়েব সাহেবের শরীর। রংমহল ছেড়ে গোলাকারে বৃদ্ধ বৈঠকখানা। লাগোয়া খাসকামরায় বাঁধানো মেঝে। আড়াই শ বছর আগে কেমন করে জাম্বো সাইজের জলপাই পাথরগুলো ইংরেজরা কুঠিতে এনেছিল, ভাবাই যাচ্ছে না। মলিনতা নেই, বরং সুমসৃণ আর এমন চকচকে যে সাপ পর্যন্ত ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলতে পারে না। ফটকের সাদা পাথরে লেখা আছে নীল বেদনার ইতিহাস। জনশ্রুতি আছে, কুঠিতেই নাকি ক্লাইভ-ঘসেটিরা নবাবকে মারার নকশা এঁকেছিল। এখান থেকেই চাবুক হাতে সাহেবরা ঘোড়া ছোটাত। ঘোড়া থেকেই চাবুক কষাত বাংলার কৃষকের গায়ে। মরা কাজলা ধরে থরে থরে নীলগাছগুলোর দিকে একনাগাড়ে চেয়ে থাকি। পূর্বপুরুষের রক্তছোপ আর ষড়যন্ত্রের নীল পদাবলি যেন ছবি হয়ে যায়।
মুজিবনগর যাব বলে জল-জংলার মায়া থেকে শ্যামলা চোখজোড়া সরিয়ে যাত্রীবাহী বাসে উঠে পড়ি। দুই পাশে সবুজ খিলান করা উজাড়-পথ। পিচের কিনারে ধুয়ে ধুয়ে ঝাঁকা ভর্তি হচ্ছে শান্ত-স্বভাবী মুখিকচু। এমন ভালো জাত আর নেই। জাইলিক এসিড নগণ্য বলে গলা ধরে না। আরও দক্ষিণে ছুটে চলে মুজিবনগরমুখো বাস। পথের পাশেই ভৈরব। তলপেটে কোমরজল নিয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণের কাঁটাতার ছুঁয়ে ভারতে ঢুকে গেছে। পাড়ের বারান্দা কেটে খাঁজে খাঁজে শসার রসালো আবাদ করে রেখেছেন দারিয়াপুরের কৃষকেরা। ফসলি জমি ছেড়ে মোনখালির হাঁসের ময়দান। চুপে চুপে চলে আসে কেদারগঞ্জ। ঝুপড়িবাজার ফেলে আম্রকানন। এক ধাক্কায় একাত্তরের ১৭ এপ্রিল। শপথভূমি। মুজিবনগর। ভবেরপাড়ার যে ১২ জন আনসার অস্থায়ী সরকারকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন, তাঁদের দু-পাঁচজন এখনো বেঁচে আছেন। আনসার লিয়াকত শপথের গল্প বলেন। মঞ্চ কারিগর সুভাষের মুখের দিকে চেয়ে থেকে মায়া হয়। ১৭ এপ্রিল থেকে আজ অবধি সৌধ আঁকড়ে পড়ে আছেন। পর্যটকদের বিনে পয়সায় চোখে দেখা ইতিহাস বর্ণনা করেন তিনি। ক্ষুদ্রতম জনপদের বৃহত্তম গল্প। বাংলাদেশের উদ্বোধনী ভূমিতে দাঁড়িয়ে চারদিক চেয়ে দেখি। সুমিষ্ট আম, বলবান গবাদি, প্রাচুর্যময় আবাদ, পর্যাপ্ত গাছগাছালি আর নদী-নেওটা গ্রামবসতি অদ্ভুত এক ছায়া এনে দিয়েছে মুজিবনগরকে।
স্মৃতিকেন্দ্র দেখতে গেলাম। একটানে এত বড় বাংলাদেশ আর কোথাও নেই। সিমেন্টের শিল্পে বানানো বাংলাদেশ। জেলায় জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-বঙ্গোপসাগর। বয়ে বয়ে সীমান্ত। কাঁটাতার, করিডর, কালো বিএসএফ। সাজানো আছে ভাস্কর্য দল। থিমেটিক ভাস্কর্যগুলো দেখতে গিয়ে সূর্য তেতে ওঠে। আম্রকাননের ছায়াতলে ফেরত আসি ফেরার জন্য। পিকনিক পার্টির লোকজন খাবার পাতে করে ঘাসেই ল্যাটা দিয়েছে। উটকো পর্যটকের জন্য খাবারের ভালো হোটেল নেই এখানে। মাঝারি খাবার পেতে হলে জেলা শহর ছাড়া গতি নেই। হুট করে বাস পাওয়া যাবে না। আলমসাধুতে করে কেদারগঞ্জ পৌঁছে তবে লোকাল বাস ধরতে হবে। মাথাপ্রতি দুই টাকা ভাড়ায় এত আরামসে ভ্রমণ আর হয় না! শ্যালোমেশিন কায়দা করে তলায় সেট করা হয়েছে। চালককে ড্রাইভার না বলাই ভালো। নেহাত আবালজন। মালকোঁচা মেরে দুই হাতে ত্যাড়াব্যাড়া করে চালাচ্ছে। দুই পাশের দৃশ্যগুলো ফালা ফালা করে আমরা ফের উত্তরে যেতে থাকি। ওপারের হাওয়া এসে আঁছড়ে পড়ছে বাংলাদেশের পাথারে। আর ফটফট শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে আমাদের ভটভটি।
আজাদুর রহমান
No comments