সাদাকালো-একুশ শতকেও প্রদীপের নিচে অন্ধকার by আহমদ রফিক

দৈনিক পত্রিকায় ছোট্ট একটি খবর- কিন্তু তাৎপর্য বিবেচনায় ভয়ংকর, ইংরেজিতে যা 'বম্বশেল ফাটানোর'র মতো ঘটনা। স্থান প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজস্থান রাজ্যের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম- দেবদা। খবরে প্রকাশ, আড়াই হাজার গ্রামবাসীর মধ্যে মেয়ে বলতে হাতেগোনা কয়েকজন, বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ সবই ছেলে। অঙ্কের হিসাব মিলাতে গেলে মনে হয় বয়স্কদের মধ্যেও রয়েছে নারী-পুরুষের ব্যাপক বৈষম্য।


এর কারণ প্রাকৃতিক নয়, সামাজিক। সামাজিক বলতে কুসংস্কারের আদিম প্রকাশ আধুনিক যুগের একুশ শতকে। ওই খবরে এক স্থানীয় কৃষকের জবানিতে বলা হয়েছে যে সেখানে কন্যাশিশুর জন্ম অশুভ মনে করে অনেক ক্ষেত্রে তাকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু তারা কখনো ভেবে দেখেনি যে এভাবে কন্যাশিশুর মৃত্যু ঘটানোর ফলে ভবিষ্যতে এমন দিন আসতে পারে যখন পুত্রশিশু জন্ম দেওয়ার জন্য কোনো নারীই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন স্থানীয় প্রজাতি রক্ষায় অন্যত্র হানা দিতে হবে।
রাজপুতানা যা এখন রাজস্থান সংস্কার-কুসংস্কারের জন্য প্রবাদপ্রতিম। এই আধুনিক যুগে পৌঁছেও কয়েক দশক আগে দেশের আইন অমান্য করে রূপসী তরুণী-বিধবা রূপ কানোয়ারকে মৃত স্বামীর চিতায় চড়ানো হয়েছিল। কাগজে এ খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। বিষয়টি ছিল আধুনিক ভারতীয় সমাজের জন্য লজ্জার। কাকতালীয় হয়েই সত্য যে পূর্বোক্ত দেবদা গ্রামের স্কুলের একটি ক্লাসে ২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে একমাত্র ছাত্রীর নাম পদ্মা কানোয়ার।
আদিম হন্তারক কুসংস্কারের ধারাবাহিকতা নিয়ে আধুনিক যুগেও জেন্ডার তথা স্ত্রী-পুরুষ বৈষম্যের সামাজিক উপস্থিতি বাস্তবিকই বিস্ময়কর। ভাবতে পারা যায় না, শিক্ষিত মননেও মানবিক চেতনার কোনো স্থান নেই, বরং সেখানে জেগে আছে সুপ্রাচীন একখণ্ড অন্ধকার। 'মানুষ' শব্দটি সেখানে নারী-পুরুষ ভেদে ভিন্ন মূল্যমান বহন করে, বিশেষ করে গোষ্ঠী, গোত্র বা সমাজ (আধুনিক হয়েও) যখন পুরুষশাসিত। নারী তখন জেন্ডার ভেদে নির্যাতিত। নির্যাতিত সামাজিক বিচার বিচেনায়। এ যেন এক সামাজিক ব্যাধি।
শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতার টানে (যে শাস্ত্রীয় রীতিনীতি পুরুষ কর্তৃক প্রণীত) সমাজে নারীর প্রতি যে নির্যাতন প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা ও আরো নানা প্রথায় চলে এসেছে, তা উনিশ শতকেও বঙ্গীয় সমাজেও প্রচলিত ছিল। শুধু সতীদাহের সতীত্বগর্বের প্রকাশেই তা শেষ নয়, গঙ্গাসাগরে কন্যাসন্তান বিসর্জনের চরম অমানবিকতার প্রকাশও দেখা গেছে বঙ্গীয় সমাজে। শাস্ত্রজ্ঞানী বা ইংরেজি শিক্ষায় আধুনিক চেতনায়ও তা আঘাত করেনি মহাত্মা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের আগে।
কিন্তু রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথার আইনগত বিলোপ (১৮২৯) সত্ত্বেও সমাজ থেকে এ দুষ্টক্ষত বিশ শতকেও শেষ হয়নি। আর কন্যাসন্তান হত্যার ঘটনা তো একুশ শতকেও এক মর্মান্তিক সত্য। পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে সে সত্যের প্রকাশ আমাদের বুঝিয়ে দেয় মানবিক চেতনার ক্ষেত্রে এখনো আমাদের অবস্থান কতটা পেছনে। অর্থাৎ মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এখনো আমরা উন্নত বিশ্বের তুলনায় কতটা পিছিয়ে আছি।
নারী নির্যাতন, নারী হত্যা, শিশু হত্যা ইত্যাদির ইতিহাস বিচারে দেখা যায় যে উনিশ শতকের জনাকয় সমাজসেবাব্রতার চেষ্টায় যেমন বিধবা বিবাহ আইন পাস (১৮৫৬), বিলেতে মেয়েদের সম্মতি বয়স আইন পাস (১৮৯১), এমনকি বিশ শতকে বাল্যবিবাহ রোধ আইন (১৯২৯) পাসের মতো ঘটনা সত্ত্বেও বর্তমান সময়ে নারী নির্যাতন, নারী মৃত্যু, বাল্যবিবাহ ঘটেই চলেছে।
চলছে বাংলাদেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও মোল্লা মৌলবিদের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড, যার ফলে অনেক হতভাগ্য মেয়ে, তরুণী বা নারীর মৃত্যু ঘটছে। ফতোয়াবাজির মধ্যযুগীয় বর্বরতা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বখাটে ছেলেদের যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের দৌরাত্ম্যে মৃত্যু ঘটছে অনেক কিশোরী বা তরুণীর। এই তো কিছুদিন আগে হেনা নামের এক কিশোরী যৌন নির্যাতনের পরও উল্টো ফতোয়াবাজির শিকার, অবশেষে মৃত্যু। বলতে হয় আমাদের সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বদমাশ বখাটে ছেলেটা অপরাধী হয়েও সমাজের বিচারে দিব্যি বহাল তবিয়তে।
পুরুষশাসিত সমাজ বলে কথা। তাই অপরাধী পুরুষ-তরুণ বা পরিণত-বয়সী যেই হোক, তারা প্রায়ই নানা ফাঁকফোকরে শাস্তির হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়। বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে যেখানে মোল্লাতন্ত্রের দাপট, ফতোয়াবাজির প্রতাপ এখনো প্রবল। এবং যেখানে আধুনিক শহুরে বিচারব্যবস্থার বাস্তব ছায়াপাত কম, সেখানে রক্ষণশীল সমাজপতিদের প্রাধান্য অনেক বেশি।
সুশিক্ষার যেখানে অভাব সেখানকার সমাজে পিছুটান যে প্রবল হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপমহাদেশের রাজধানীগুলোতে যেখানে আধুনিকতার আলো ঝলমলে রূপ, সেখানেও নারী সব সময় সুবিচার পায় না। তা বৃহৎ দেশের অত্যাধুনিক রাজধানী দিলি্ল থেকে কিংবা হোক ছোটখাটো রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ভোগবাদী পাশ্চাত্য সমাজের ধারায় সেসব স্থানে নারী প্রায়শ ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত। দুঃখজনক, নারী সেসব সমাজে প্রায়ই প্রতিবাদী ভূমিকা নিতে পারে না বা নেয় না।
কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো এ উপমহাদেশের তিন তিনটে রাষ্ট্রের মৌল সামাজিক চরিত্র ভিন্ন নয়- বিশেষ করে নারী-পুরুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে। এর সবচেয়ে বড় প্রকাশ হলো আলোর নিচে অন্ধকারের উপস্থিতি। সেটা বিশেষভাবে প্রকট গ্রামাঞ্চলে, ছোটখাটো শহরে, যেখানে শুদ্ধ আধুনিকতার মূল্যবোধ সামান্যই উপস্থিত।
প্রতিদিনের সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়া যাদের অভ্যাস তারা দেখতে পাবেন কতসংখ্যক শিশু, কিশোরী বা তরুণী নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। সমাজব্যবস্থা এমনি যে প্রায়ই দেখা যায়, অপরাধী তার অর্থ এবং আভিজাত্য বা কৌলিন্যের জোরে বিচারকের পাশে উপবিষ্ট। শহরে-গ্রামে পণ প্রথার বলি অসংখ্য অসহায় গৃহবধূ। এসব ঘটনা সমাজে উপদ্রব তৈরি করা দূরে থাক, কোনো প্রকার ঢেউ তোলে না।
অথচ আমাদের বর্তমান সমাজে শিক্ষিত নারী, চাকরিজীবী বা পেশাজীবী নারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। জাতীয় সংসদে রয়েছেন নারী সদস্য। তা সত্ত্বেও নারী নির্যাতনের যথাযথ শাস্তি সব ক্ষেত্রে দেখা যায় না। নারীর ওপর অবিচারের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় একটা ফয়সালা হয় না। সমাজের উঁচুস্তরের অধিবাসী নারীদেরও (পুরুষদের তো বটেই) নড়েচড়ে বসতে দেখা যায় না। উচ্চপদস্থ নারী ব্যস্ত থাকেন সাজসজ্জায়, প্রসাধনে- সামাজিক সমস্যা ও সংকট (বিশেষভাবে নারীবিষয়ক) তাদের তাড়িত করে না।
দেশের দুই নেত্রী দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা পর্যায়ক্রমে শাসনকর্ত্রী বা বিরোধীদলীয় প্রধান, তাঁরা নারী হয়েও সমাজে নারীর দুর্গতি, দুর্দশা নিয়ে তাঁদের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। ভাবলে এবং সঠিক ব্যবস্থা নিলে, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে নারীর ব্যক্তিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করলে তাদের ওপর নির্যাতনের হার ক্রমেই কমে যেত। একসময় বন্ধ হতো।
সামাজিক সুবিচারের ক্ষেত্রে তাঁদের অনীহা ও অবহেলার কারণে নারীর ওপর নির্যাতন ও পীড়নের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে সাহসী (!) পুরুষ নারীকে অসহায় জ্ঞান করে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে। নারীর অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হওয়ার সুযোগ থাকে না। হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে ন্যায়বিচার প্রায়শ পেছন দরজা দিয়ে পালায়।
আমরা এমন এক ভোগবাদী আধুনিক সমাজে বাস করছি, যেখানে আধুনিকতার সুপ্রভাব প্রায়ই নারীর সাহায্যে আসে না। আধুনিক সমাজ পুরুষশাসিত বিধায় তা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ যে ভূ-গোলকে হোক- নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করা সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম, সমাজ, শ্রেণী- কোনো দিকেই নারী শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুরুষ ওই শোষণের সুফলভোগী। পুরুষ নিজ স্বার্থেই নারীর স্বাধীন, স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা মেনে নেওয়ার মতো উদারতা দেখাতে পারেনি। উদারপন্থী পুরুষের সংখ্যা সমাজে যথেষ্ট নয় বলেই নারী-পুরুষ বৈষম্যের অবসান ঘটছে না।
আমাদের দেশেও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সত্ত্বেও নারী তার কর্মক্ষেত্রে কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো প্রচ্ছন্নভাবে বৈষম্যের অন্যায় থেকে মুক্ত নয়। নারীর স্বাধীন ব্যক্তিপরিচয় সমাজে কতটা গ্রাহ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সমাজে, পরিবারে পিতৃপরিচয়েই সন্তানের পরিচয়। 'পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম' ইত্যাদি আপ্তবাক্য মুসলমান সমাজে জলচল না হলেও বাস্তব ঘটনা ভিন্ন নয়।
নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এখনো সমাজে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজস্থান থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরত্বে অবস্থিত হলেও এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে সরাসরি কন্যাসন্তানের মৃত্যু ঘটানো না হলেও উভয় সমাজেই নারীর প্রকৃত অধিকার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত নয়, অন্তত প্রত্যেকের ক্ষেত্রে স্বীকৃত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্যা-জায়া-জননী পরিচয় নিয়ে তারা পরনির্ভরশীল। পরিবারে কন্যাসন্তানের প্রতি অবহেলা বহুলদৃষ্ট ঘটনা। কন্যাও এটা স্বাভাবিক মনে করে আসছে। এটা নিছক সামাজিক প্রভাব।
আলোচনার ইতি টানতে চাই পূর্বোক্ত ভয়ংকর খবরে ফিরে। এ খবর পড়ে আমাদের সমাজেরই এক জননীর মন্তব্য : 'এ ঘটনা শুধু স্পর্শকাতরই নয়, ভয়াবহ রকম অস্বস্তিকর। শুনেছি, আরবে অন্ধকার যুগে পিতা স্বয়ং কন্যাসন্তানের মুখ বেঁধে তাকে কুয়ায় ফেলে দিয়ে আসত। কী বৈষম্যমূলক, অন্যায়, অমানবিক আচরণ! তাই বলে তা এই আধুনিক যুগেও ঘটবে, আধুনিক ভারতের একটি গ্রামে কন্যাশিশুকে মা-বাবাই শিশুর মুখে বালিশচাপা দিয়ে তাকে মেরে ফেলবে?' হ্যাঁ, খবরে তেমনটাই প্রকাশ। এ ঘটনা সত্য হলেও অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য মায়ের হাতে তার শিশু সন্তানের মৃত্যু। এ সামাজিক অপরাধের বিচার অবশ্যই কাম্য। কাম্য প্রদীপের নিচে অন্ধকারের অবসান।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক,
কবি ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.